ঘুরে এলাম গণচীন

কাজী রাশেদ
Published : 7 Dec 2016, 04:10 PM
Updated : 7 Dec 2016, 04:10 PM

আমার বিদেশ যাত্রার ভাগ্যটা খুবই খারাপ। প্রায় শুনি অমুকে ইউরোপ গেলো। কেউ আমেরিকা যাচ্ছে। আবার কেউবা সুদূর আফ্রিকা থেকে হাই-হ্যালো করে জানান দিয়ে যায়। আর আমি বাংলাদেশের সবুজ মাটিতে দাঁড়িয়ে সেইসব বন্ধুদের বিদেশ যাবার স্বপ্নীল মুহূর্তগুলোর কথা চিন্তা করে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। মনে মনে বিদেশ যাবার স্বপ্নটা আরো তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠে।

সেই দুই হাজার সাত সালে গিয়েছিলাম মহাচীনে। সেবারই প্রথম ছিলো আমার মতো চীনপ্রেমী মানুষের প্রথম চীন যাত্রা। আমার সংঘঠনের অনেক নেতা কর্মীরই চীন সফরের অভিজ্ঞতা থাকলেও আমার কোন সুযোগ হয়ে উঠে নি। তাই চাকরী সুত্রে যখন চীন সফরে যাওয়ার সুযোগ এলো তখন নিজের ভাগ্যকে অনেক ধন্যবাদ দিয়েছিলাম। সেই দশ বছর আগের চীন দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। একটি দেশ কতো দ্রুত নিজেদের উন্নয়ন করতে পারে তা না দেখলে বিশ্বাস করাই কঠিন।

২০০৭ সালে আমি গুয়ানযো প্রদেশের এক ডিস্ট্রিক্ট শহর সেনজেনে ছিলাম। সেখান থেকেই আশেপাশের সমুদ্র বন্দ্রর শহরসহ বেশ কিছু শহর দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো। সেই সময় ছিলো বেইজিং অলিম্পিকের আগের বছর। সারা চীন জুড়ে ছিলো অলিম্পিক কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠার সময়। শত শত স্থাপনা আর যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে চীন দ্রুত পাল্টে যাচ্ছিলো। সে এক বিস্ময়কর পরিবর্তন।

আমরা সবাই জানি একটা সময় ছিলো চীন আফিম খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। আফিম খাওয়ানো শিখিয়ে ছিলো ব্রিটিশ আর জাপানিজ সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্তে। হাজার জাহার বছরের ঐতিহ্যকে ধ্বংস করার নীল নকশায় চীন হারিয়ে যেতে বসেছিলে পৃথিবীর ইতিহাস থেকে। সেই চীন আজ সারা বিশ্বের বিস্ময়ে পরিনত হয়েছে। আধুনিক চীন চীনের জনক কমরেড মাও সে তুং, মহান নেতা তে শিয়াও পেং এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিন পিয়েনের যোগ্য নেতৃত্বে আজ চীন শুধুমাত্র এশিয়া মহাদেশ নয় সারা বিশ্বের নেতৃত্বে চলে পথে দিন দিন এগিয়ে চলেছে।

যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। আমরা উন্নয়নের মডেল হিসবে আজো ইউরোপ আমেরিকার দিকে তাকিয়ে থাকি। যোগাযোগের ব্যবস্থার উদাহরণ হিসেবে এখনো আমরা ইউরোপ এমেরিকার উদাহরণ দিয়ে থাকি। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য চীনের যোগাযোগ ব্যবস্থা আজ ঈর্ষনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। দোতালা-তিনতলা-চারতলা ফ্লাইওভারে সারাদেশ ভরে গেছে। মেত্রো রেলের চিরুনি সর্বত্র। হাইওয়ে গুলোতে ১০০ কিলোমিটার সরকারি গতিবেগ। এবং সবচেয়ে মজার ব্যাপার চীনের মানুষ এখন আর দূরত্ব কিলোমটারে নির্ধারণ করে না, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গার দূরত্ব বলে দেয় ঘন্টা হিসেবে। ননএসি বাসের দেখা পাওয়া যায়নি এবার। অথচ ২০০৭ সালেও কিছু কিছু ননএসি বাসের দেখা পাওয়া যেতো।

আবাসিক ভবনগুলো প্রতিদিন আকাশ ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো করে তৈরী হয়ে চলেছে। প্রতিটি আবাসিক এলাকায় ২০ থেকে ২৫ টি বিশ ত্রিশ তলার ফ্লাট। সকল প্রকার নাগরিক সুবিধা সম্পন্ন এইসব আবাসিক এলাকাগূলোতে মানুষ বাস করছে অত্যন্ত নিশ্চিন্তে। বাচ্চাদের স্কুল থেকে শুরু করে প্লে গ্রাউন্ড, সুইমিং পুল সহ সকল ধরনের সুবিধা দিয়ে তৈরী করা হয়েছে এইসব আবাসিক ফ্লাট। এই ২০১৬ সালে এসে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত এইসব আবাসিক সুবিধা সম্প্রসারিত হচ্ছে। মানুষের জীবনে পরিবর্তনের ছোঁয়া এসেছে খুবই স্পষ্ট ভাবে। মানুষজন নিজেদের কাজে এতোই মনোযোগী যে উৎপাদন ছাড়া তাদের অন্য কোনো চিন্তা কল্পনাতে আনে না।

১৯৬০ সালে চীনের মাথাপিছু আয় ছিলো মাত্র ৮৭.১ মার্কিন ডলার অন্যদিকে একই সময়ে বাংলাদেশের মাথাপিছু ছিল ৮৮.৭ মার্কিন ডলার, ভারতের ছিলো ৮৩.৮ ডলার। পক্ষান্তরে ২০১৫ সালে এসে বাংলাদেশের মাথাপিছু দাড়িয়েছে ১২১১ মার্কিন ডলার, ভারতের ১৫৮১ মার্কিন ডলার অন্যদিকে চীনের মাথাপিছু আয় দাড়িয়েছে ৭৯৯২ মার্কিন ডলার।(তথ্যঃ গুগুল তথ্য ভাণ্ডার)

২০০৭ সালেও দেখেছি খাওয়ার দোকানগুলোতে ভিড় ছিলো তবে এবার সেই ভিড় সীমা ছাড়িয়েছে। কাজের চাপ এবং সময়ের সম্বন্বয়হীনতা মানুষকে হোটেলগুলোর দিকে নিয়ে গেছে। সারা চীন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা থেকে সাতটার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। শুধুমাত্র খাওয়ার দোকান আর আবাসিক এলাকাগুলোর মুদির দোকান ছাড়া খোলা থাকে না। তবে একথা কথা ঠিক মানুষের মাঝে কিছুটা হলেও আন্তরিকতার অভাব এসেছে। সারা পৃথিবী থেকে মানুষ জড়ো হচ্ছে মহাচীনের বিভিন্ন শহরের হোটেলগুলোতে। যেন চীনের উন্নয়নের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে চলার তাগিদে সব জায়গা থেকে ছু্টে আসছে মানুষ। এ যেন মিলাবে আর মিলিবে সারা বিশ্বের সকল মানুষকে।

সারা দেশ জুড়ে চলছে নানা উন্নয়ন আর উৎপাদনের  জোয়ার । এই জোয়ারে সামিল হয়েছে প্রতিটি নারী এবং পুরুষ।  সত্যিকার অর্থে পুরুষের চাইতে নারীর অংশগ্রহন চোখে পড়ার মতো। শুধু অংশগ্রহনই নয় সব ব্যাপারে নারীদের মতামত এবং সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দেয়ার মানসিকতা তৈরী হয়েছে সমাজের সর্বস্তরে। ভোর বেলায় যে ছুটে চলা শুরু হয় তা এসে  থামে  রাত নয়টা দশটায়। এরমধ্যেই শিশু পালন, শরীর চর্চা, আনন্দ বেদনার কাব্য সব চলছে। এ যেন এক মহাকাব্যিক সৃষ্টিশীলতা। যেখানে নারী-পুরুষের ভেদাভেদ নেই।