মধ্যবিত্তের বিনোদন ‘সিনেমা’ আজ পথহারা

কাজী রাশেদ
Published : 3 Sept 2017, 06:03 AM
Updated : 3 Sept 2017, 06:03 AM

বাঙালির সাংস্কৃতিক পদচারণা আর চলচ্চিত্র একটা সময় পর্যন্ত একই ধারায় প্রবাহিত হতো। গ্রাম-গঞ্জে যদিও যাত্রা, পালাগান, জারী, সারি বা কবিগানের আসর একটা মৌসুম ভিত্তিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে বহু যুগ ধরে প্রচলিত ছিল কিন্ত চলচ্চিত্র বা সিনেমা ছিলো শহর বন্দর গ্রামাঞ্চলের সার্বজনীন বিনোদন। ঘরের বউ শাশুড়ির যতোই মান অভিমান থাকুক না কেনো সিনেমা দেখার ব্যাপারে বরাবরই ছিলো গলায় গলায় ভাব। সেই বাঙালি হঠাৎ করেই সিনেমা বিমুখ হয়ে গেলো। যে সিনেমা হলগুলোতে প্রায় সময়ে হাউজফুল লেখা ঝুলতো সেই সিনেমা হল গুলো দর্শকের অভাবে রুগ্ন, ধ্বংসপ্রায়। কিছু কিছু সিনেমা হল গুদামে পরিণত হয়েছে, কিছু সিনেমা হল ভেংগে বহুতল বিশিষ্ট শপিংমলে পরিণত হয়েছে।

ঢাকা নগরের ঐতিহাসিক সিনেমা গুলোর মধ্যে গুলিস্তান ছিলো প্রাণকেন্দ্র। যেকোন চলচ্চিত্র মুক্তি পেলে গুলিস্তানে যদি মুক্তি না পেতো তবে সেই চলচ্চিত্রের মান এবং ব্যবসা সম্পর্কে অনেকের ভ্রু কুঁচকে উঠতো। এটি যদিও একটি মিথ।

.

গুলিস্তান সিনেমাহলে একসময় লুঙ্গি পড়ে কোন দর্শক ঢুকতে পারতো না। এখানেই তার আভিজাত্য টিকিয়ে রেখেছিলো দীর্ঘদিন। গুলিস্তানের আগেও ঢাকা শহরে অনেক সিনেমা হল ছিলো বা আজো আছে, আবার অত্যাধুনিক ধরনের সিনেমা হলও হয়েছে কিন্তু সারাদেশে গুলিস্তানের ইমেজ কেউ ভাংগতে পারেনি যতদিন সে ছিলো। আজ গুলিস্তান সিনেমা হল নেই কিন্তু গুলিস্তান নাম নিয়ে পুরো এলাকা পরিচিতি পেয়েছে। পুরো জায়গার নাম অন্য হলেও সর্বসাধারণের কাছে পুরো এলাকা গুলিস্তান নামেই জনপ্রিয়।

একটা সময় এসেছিলো বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পে, জোয়ার এসেছিলো। মানে এবং ব্যবসা দুই দিক থেকেই চলচ্চিত্র শিল্প মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছিলো। প্রযোজক, পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রী, কলাকশুলী আর পরিবেশকরা জনগণের আকাঙ্খাকে মূল্য দিয়ে চলচ্চিত্র শিল্পের প্রভুত উন্নয়নে নিয়োজিত হয়েছিলো। ঢাকা সহ বাংলাদেশের সকল জেলায় দর্শকদের রুচি আর চাহিদার কথা চিন্তা করে নতুন নতুন সিনেমা হল তৈরীতে মনোনিবেশ করেছিলো। ঢাকা শহরের মধুমিতা হলের আধুনিকায়ন, আনন্দ, শ্যামলী, বলাকার আধুনিকায়ক, রাজমনি কম্পলেক্স, চট্রগ্রামের বনানী কম্পলেক্স, আলমাস, যশোহরের মনিহার, রাজশাহীর বর্ণালী, দিনাজপুরের চৌরংগী, রংপুরের শাপলা, সহ ময়মনসিংহ বরিশাল, খুলনা এবং বিভিন্ন গ্রাম গঞ্জে পর্যন্ত সিনেমা হল নির্মাণের হিড়িক পরে গিয়েছিলো। কে কত দর্শকদের সুবিধা, আরাম দায়ক এবং সাউন্ড সিস্টেম ভালো করতে পারে তার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিলেন।

সেই আশির দশকের প্রথম দিকেই মধুমিতা যেমন তার ভিতরের আদল, সুযোগ-সুবিধা আর সাউন্ডের পরিবর্তন এনেছিলো ঠিক তেমনি ভাবে প্রথম থেকেই আনন্দ আর শ্যামলী সিমেনা হল তাদের ভিতর-বাহিরের অংগসজ্জায়, সিঁড়িতে আর ঝর্নার সংযোজন ঘটিয়ে দর্শক হৃদয়ে এক অভুতপূর্ব আলোড়ণ সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছিলো। বিভিন্ন জেলা শহর থেকে দর্শকশ্রোতা ছুটে আসতো এইসব সিনেমা হলে ছবি দেখতে। অভিসার সিনেমা হলের ডলবি সাউন্ড দর্শকের চমকিত করে তুলতো। অগ্রীম টিকেটের লাইনে থাকতো ভয়াবহ লাইন। সিনেমার টিকিট নিয়ে মারামারি হয়নি ঢাকা কলেজ আর সিটি কলেজের মধ্যে, এমন ঘটনা বা দিনের কথা কল্পনাই করা যেতো না।

স্কুল জীবনে শুক্রবারের মর্ণিং শো ছিলো ছাত্রদের জন্য এক মহানন্দের ব্যাপার। স্কুলের ক্লাস ফাঁকি দিয়ে মর্ণিং শো দেখে নাই এমন ছাত্রের সংখ্যা হাতে গোনা মাত্র। আর শনিবার ক্লাসে যেয়ে এই অপরাধে নীল ডাউন বা ক্লাসে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকার কথাও ভুলা যায় না আজো। অনেকসময় দেখা গেছে ক্লাসে গুটিকয়েক স্টেডিয়াম বয় (মানে যারা শুধু স্টাডিতেই ব্যস্ত) ছাড়া সকল ছাত্র কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে। দলমিলে কিন্তু কখনোই যাওয়া হতো না।

সিনেমা বা চলচ্চিত্রের মড়ক শুরু হয় আশির দশকের শেষ প্রান্তে এসে। ভিসিআর, ভিডিওর আগমনে চলচ্চিত্র শিল্প প্রথম মার খেতে শুরু করে। ভিসিআ এ ভারতীয় হিন্দী ছবির বা বিদেশী ছবির ঘরে বসে উপভোগের যে ট্রেন্ড তা বাংলা সিনেমার দর্শকদের সিনেমা হল বিমুখ করে তোলে। সিনেমাওয়ালারাও একটা সময় নিজেদের টিকে থাকার যুদ্ধে হিন্দী ছবির বা বিদেশী ছবির নকল, নগ্ন অর্ধ নগ্ন যৌন সুড়সুড়ি মার্কা ছবি বানানোর দিকে ঝুঁকে পরলেন। সিনেমা হলগুলো হয়ে পড়লো রিক্সাওয়ালা, খেটে খাওয়া মানুষের বিনোদনের আশ্রয়স্থল। ভদ্রলোক বা আপামর ছাত্রসমাজ সিনেমা হলে যেয়ে সিনেমা দেখা ছেড়ে দিলো।

এরই মধ্যে অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি ধর্মের দোহাই দিয়ে কিছু ধর্ম ব্যবসায়ী আর একাত্তরের পরাজিত শক্তি বাঙালির সাংস্কৃতিক চর্চ্চাকে সমূলে উৎখাত করার লক্ষ্যে ময়মনসিংহ সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন সিনেমা হলে বোমা ফাটিয়ে, মানুষ মেরে সিনেমা শিল্পকে বন্ধ করার পাঁয়তারা চালিয়েছিলো।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে শুধুমাত্র ডিস, ভিসি আর বা বিদেশি চলচ্চিত্রই কি বাংলাদেশের সিনেমা শিল্পের এই দুরাবস্থার জন্য দায়ী? আমরা যারা অশ্লীলতার দোহাই দিয়ে বাংলাদেশের সিনেমা না দেখার অজুহাত দিচ্ছি, তারাই কিন্তু ঘরে বসে পরিবারের সবাইকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ হিন্দী সিনেমা এবং টিভি সিরিয়াল দেখছি। কখনো হাততালী দিচ্ছি কখনো চোখের জল মুছছি। বুঝে হোক না বুঝে হোক নিজেরা বা সন্তানদের মুখে বাজে গানের কলি শুনেও না শোনার ভান করছি, কখনো আবার বাহবাও দিচ্ছি। যেমন আরবী সাহিত্যিক ইমরুল কায়েসের পর্ণ সর্বস্ব আরবী সাহিত্য পড়ানো হচ্ছে মাদ্রাসার কোমলমতি শিক্ষার্থীদের।

সমস্যা টা কোথায়? সমস্যা হলো সিনেমা সম্পর্কে পড়াশুনার অভাব, মেধা সম্পন্ন পরিচালক, কলাকসুলীর অভাব। আমাদের দেশের অভিনেতা অভিনেত্রীরা যখন বিদেশে যেয়ে ভালো করছে, নাম করছে তখন আমাদের দেশে এসে তারা দিশেহারা হয়ে পরছে।

আধুনিক যন্ত্রপাতি, ডিজিটালাইজেশন বা কম্পিউটারাইজিং ব্যবস্থার আজো কোন সদ্যবহারের সমন্বয় ঘটাতে পারে নাই এদেশের সিনেমা শিল্প। যার ফলশ্রুতি হিন্দি সিনেমার নাচে দর্শকদের চোখ এবং চিত্তের আরাম বোধ এলেও সেই একই নাচ বাংলা সিনেমায় বিরক্তির উদ্রেক করে, বিসদৃশ লাগছে। একই ভাবে সিনেমার কালারের সংমিশ্রণে আকাশ-পাতাল তফাত। কোডাক ফিল্ম বা ফুজি ফিল্ম ব্যবহার করেও বাংলাদেশের সিনেমা এখন পর্যন্ত রঙের যথাযথ ব্যবহার আনতে পারছে না। বাংলাদেশের রঙিণ সিনেমা দেখলে সস্তা রূপবান মার্কা রঙিন ঢেউটিনের সুটকেসের কথা মনে চলে আসে। কথা বা গান ডাবিং এ-ও নিম্নমানের টেকনোলজি সিনেমার প্রতি অনাগ্রহ তৈরি করে। কথা এবং লিপটিং এর সমন্বয়ে এতোই পার্থক্য যে মাঝে মাঝে মনে হয় পর্দায় যেয়ে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের গালে চড় মারি।

আগেই বলেছি আমাদের অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী পশ্চিম বাংলার বাংলা সিনেমায় অভিনয় করে দারুণ প্রশংসা অর্জন করছেন। তাদের শব্দ প্রেক্ষাপন, অভিনয় শৈলী, বা নাচের মুদ্রার প্রয়োগ দেখে মনেই হয় না এই একই অভিনেতা অভিনেত্রী বাংলাদেশ থেকে গেছেন।

সিনেমা হলো নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্তের মানসিক শান্তির একটি বিনোদন মাধ্যম। সেই বিনোদন উপভোগ করতে যেয়ে যদি বিরক্তির উদ্রেক হয় তবে পয়সা খরচ করে কেনো কোন মানুষ বিরক্ত কিনবে? ফলে সিনেমা হল গুলো কিছুতেই দর্শক টানতে পারছে না। কিছু সুন্দর ছবি হলগুলোতে এলেও হলের পরিবেশের কারণে মধ্যবিত্ত হলমুখো হতে পারছেন না। আবার ইদানিং কালে তৈরী হওয়া সিনে কমপ্লেক্স গুলোর টিকেটের মুল্য এতো চড়া যে তা অধিকাংশ মধ্যবিত্ত পরিবারের সাধ্যের বাইরে। আর ঢাকার বাইরে তো সেই পুরানো সিনেমা হলগুলোই ভরসা। সেখানে সিনে কমপ্লেক্স তৈরী হয় নি, তাই পরিবেশ আর বোমাতাঙ্ক সিনেমা হল থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে কিছু কিছু ভালো সিনেমা মুক্তি পেলেও।

এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে চলচ্চিত্র শিল্পের আধুনিকায়ন আজ সময়ের দাবি। ধীর গতির নাচ, ডাবিং, মান্ধাত্তা আমলের ক্যামেরা আর সেটের পরিবর্তন আনতে হবে। আজ এই দ্রুতগতির বিশ্বে অন্যান্যের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকলে হলে ডিজিটালাইজেশনের বিকল্প থাকতে পারে না।

মধ্যবিত্তের সেরা বিনোদন মাধ্যম সিনেমা আবারো সিনেমা হলে দর্শকদের ফিরিয়ে আনবে তার সকল কারিগরি ত্রুটি কাটিয়ে,  ভালো গল্পের সমাহার দিয়ে আরে সিনেমা হলগুলোর পরিবেশ রুচিশীল তৈরী করে।