উরচুঙ্গার জীবন নিরাপদ হোক

কাজী শহীদ শওকত
Published : 5 May 2016, 06:35 AM
Updated : 5 May 2016, 06:35 AM

উরচুঙ্গা আর সিঁধেল চোরের মধ্যে অমিল কোথায় সে নিয়ে আলোচনা আপাতত প্রাসঙ্গিক না হলেও উরচুঙ্গাদের জন্য উদ্বিগ্নতাকে ফেলনা মনে করা উচিত হবে না। রেস্টুরেন্টের রান্নাঘরে উরচুঙ্গার এই করুণ পরিণতি দেখে মনটা কার না খারাপ হবে? চায়নিজরা সাপ, ব্যাঙ, কাঁকড়া, কুকুর খায়  তা সবারই জানা, কিন্তু উরচুঙ্গাগুলোকেও যে এরা ধরে ধরে ফ্রাই করে সাবাড় করে দিচ্ছে –এটা জেনে মেনে নেয়া যায় না। চায়নিজ উরচুঙ্গারা সত্যিই বড্ড বিপদে।

 অবশ্য চায়নিজরা কী খাবে না খাবে তা নিয়ে আমাদের মাথা ব্যথা হওয়ার কথা নয়, যেহেতু এটা যার যার রুচি এবং সংস্কৃতির ব্যাপার। সে তো ঠিক আছে; এবং মাথা ব্যথাও হচ্ছে না। কিন্তু বুকটা যে ব্যথা করছে। এই ব্যথা অনেকেরই; কেউ কেউ এ্যসিডিটি ভেবে টেবলেট খেয়ে

উপশমের চেষ্টা জারি রেখেছেন। জীবের কষ্ট দেখলে বিবেকানন্দের জন্য মন খারাপ হয়। ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যেতে চায় কষ্টে। শুতে গেলে মশারি টানাতে ইচ্ছে করে না। মশাদের জন্য মায়া। জঙ্গলেরগুলো যেমন তেমন, ঘরের মশাগুলোকে নিরাপদে রাখার সামান্য দায়িত্বে অবহেলা করে অমানুষ হতে ইাচ্ছে করে না। রাস্তায় হাঁটতে গেলে পিঁপড়েদের কথা পড়ে– কোথাও পিষে মেরে দিলাম না তো! খাঁচার ভেতর ডিম দেখলে মুরগির যন্ত্রণার কথা মনে করে রুচি নষ্ট হয়। মুরগির ড্রামস্টিকে দাঁত বসানোর সময় এই পক্ষীর করুণ বন্দি জীবনের কথা ভেবে খারাপ লাগে। বাজারে কৈ কিংবা পাঙ্গাস মাছগুলোকে ছটফট করতে দেখে নিঃশ্বাস আটকে আসে। সব মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার না থাকলেও অন্য জীবের বেলায় তা থাকা উচিৎ। আর এ্যনিমেল রাইট তো শুধু টাইগার, ভালুক কিংবা কিউই'র জন্য নয়। উরচুঙ্গা  তো আর জড় জগতের কেউ নয়। চৈনিক উরচুঙ্গা আর আমাদের দেশী উরচুঙ্গার জাত ভিন্ন হতে পারে, তাই বলে তাদের নিরাপত্তার আশঙ্কা অমূলক নয়। উরচুঙ্গা হলো কৃষিবান্ধব পোকা।  এদেরকে মারতে নেই। এরা মাঠের কাঁচা-পাকা ধানের পাতায় পাতায় লাফিয়ে বেড়ায় আর মাজরা পোকা,পাতা মোড়ানো পোকা, লেদা পোকার ডিম ও বাচ্চা শিকার করে খায়।

ঘাসপাতাও খেয়ে থাকে।  এরা ক্ষিপ্র গতির, এবং সদা চঞ্চল প্রকৃতির হয়ে থাকে। তাই খালি হাতে এদেরকে ধরা মুশকিল। শুধু তা-ই নয়, এভাবে ধরতে যাওয়া বিপদজনকও হয়ে ওঠতে পারে কারণ এদের মুখের সামনের দিকটা কাঁচির মতো তীক্ষ্ণ এবং ধারালো। ধরতে গেলে হাতের আঙুলে কষে কামড় দিয়ে বসতে পারে। চায়নিজরা উরচুঙ্গা ধরতে যান্ত্রিক উপায় অবলম্বন করে নিশ্চয়ই। আমাদের দেশে অতি মাত্রায় কীটনাশকের ব্যবহার উরচুঙ্গার জীবনকে বিপন্ন করে তুলেছে। প্লিজ, ডোন্ট কিইল উরচুঙ্গা। লেট দ্যাম লিইভ। সকল পোকার জন্য সম্ভব না হলেও উরচুঙ্গার মতো উপকারি কীট-পতঙ্গের জীবনের নিরাপত্তা এবং স্বাধীন বিচরণ নিশ্চিত করা আমাদের সবার দায়িত্ব।

.

তবে এখানে একটা যৌক্তিক এবং করুণ ব্যাপার আছে। উরচুঙ্গার স্বাধীনতা রক্ষা করা মানেই আরও কয়েকটি নিরীহ পোকার বাঁচার অধিকার খর্ব হয়ে যাচ্ছে। মাজরা পোকা, লেদা পোকার কী হবে? কিন্তু মানুষের ধানের উৎপাদনে যে পোকা সর্বনাশ ডেকে আনে তাদেরকে দমন করা মানুষের দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনে যদি কোনো ইনসেক্ট এগিয়ে আসে তাকে সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্বটাও মানুষের উপরই বর্তায়। এতে করে পোকার অধিকার রক্ষার প্রয়াসে যে শুদ্ধতা আছে সেটির হেরফের হয় না মোটেও।  সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।

.

উরচুঙ্গার অধিকারের প্রশ্ন যখন ওঠছেই তখন ঝিঁঝিঁ'র অধিকারের প্রসঙ্গ স্বাভাবিক ভাবেই এসে যায় কারণ ঝিঁঝিঁ পোকারা উরচুঙ্গারই জ্ঞাতিগোষ্ঠি। কিন্তু ঝিঁঝিঁ কিংবা ঝিঝিঁর ডাক নিয়ে নতুন

কোনো কথা হবে না। কথা হবে উরচুঙ্গার অর্থনৈতিক গুরুত্ব নিয়ে। কথা হবে দেশকে উন্নত করার ইনোভেটিভ পরিকল্পনা নিয়ে। দেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করতে জোনাকির বংশবিস্তার বেগবান করার চেষ্টা না করে উরচুঙ্গার স্বাধীন বাঁচার নিশ্চয়তা বিধান করা যে অনেক বেশি সমীচীন– এটা শুধু পাগলের জানা থাকলে চলবে না। বিচক্ষণ জনগণ এবং সরকারের বিশ্বাসে ও কথায়-কাজে প্রমাণ করতে হবে। সরকার উদ্যোগি হলে মেইনস্ট্রিম মিডিয়াও তখন উরচুঙ্গা স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তা বিধানে কার্যকর ভূমিকা রাখার সুযোগ পাবে। আর সে সময় বয়ে যাচ্ছে।

.

তেলের দাম কমলে বাসভাড়া না কমালেও মানুষের কী যেতো আসতো? তেলের দাম পাঁচ টাকা যখন বেড়েছিলো তখন প্রতি কিলোমিটারে পনেরো পয়সা বেড়েছিলো বাসভাড়া। এখন তেলের

দাম তিন টাকা কমেছে বলে প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া কমেছে তিন পয়সা (খবরের লিংক)। তো কী হয়েছে? এক পয়সাও যদি না কমতো, তাতেই বা কী এমন ক্ষতিটা হতো যে তিন পয়সা কমিয়ে তা রোধ করা গেল না? এ ধরণের খবর নিউজ পেপারের ব্যাক পেইজে গুরুত্ব পায় অথচ উরচুঙ্গা নিয়ে কোনো কথা নেই। ওদিকে বসতঘরে ১২৭ সাপ শিরোনামের খবরটি ছাপা হয়েছে ভেতরের পাতায়। এতোগুলো সাপকে হত্যা করা হলো এতোগুলো প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীর সামনে, অথচ একটা মামলা পর্যন্ত হলো না থানায়? কী এক অদ্ভুত ট্রেন্ড! দিন-রাত পুলিশের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধারে ব্যস্ত মানুষগুলোর নিজেদের দায়িত্বে হুঁশ নেই। এখানেই উরচুঙ্গা রক্ষায় সরকারের এগিয়ে আসার গুরুত্বটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মানুষের সাথে সাথে নিউজ মিডিয়াও সৎ সাহস নিয়ে এগোনোর সাহস হারিয়ে ফেলছে। সুড়সুড় করে পেছন পেছেন যেতে মিডিয়ার আরাম হয়।

.

পোকাদের জীবন অবিমিশ্র পূণ্যময় নয়। পোকাদেরও স্বভাবের দোষ আছে। দোষে-গুণেই পোকা। উরচুঙ্গা চঞ্চল পোকা। একটু দুষ্টু তো হবেই। খিদে পেলে এরা ধানের পাতা ঝাঁঝরা করে দেয়। ক্ষেতের বর্ডার ভেদ করে গোপনে অন্য ক্ষেতে যাওয়ার সহজ রাস্তা বানিয়ে ফেলে কয়েকটা। ক্ষেতে পানি দিলে তখন এসব রাস্তা দিয়ে সেই পানি ক্ষেতান্তরিত হয়। আসলে উরচুঙ্গারা নিজেদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই এটা করে থাকে। অতি আদ্রতা এদের পছন্দ নয়। তাছাড়া এরা সাঁতারেও কাঁচা। কখন কী হয়ে যায়, বলা যায় না। সুতরাং এইটুকু ক্ষতি মেনে নেওয়া যায়। ফসলের তথা মানুষের বৃহত্তর কল্যাণে নিয়োজিত দরদীর কিঞ্চিৎ বদ অভ্যাসকে এতো অফেন্সিভ ভাবা মানুষের শোভা পায় না।

.

চারদিকে অনেক কিছুই দ্রুত বদলে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে চাহিদার স্বরূপ আর ধান্ধার স্টাইল। অস্ট্রেলিয়ানদের ইনোভেটিভ আইডিয়াটা কিন্তু অসাধারণ। ক্যানের ভেতর অক্সিজেন ভরে বিক্রি করার বুদ্ধিটা দারুণ! এই উদ্যোগের অর্থনৈতিক সাফল্যের ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। বোতলজাত পানি যখন প্রথম বিক্রির জন্য বাজারে এলো, তখনও লোকে ভ্রু কুঁচকিয়েছিলো। কিন্তু এখন পানির বোতল ছাড়া জীবন অচল। চাইনিজরা অলরেডি এই ক্যান আমদানি করে ব্যবহার করা শুরু করেছে। ঘরে বসে পার্কের বিশুদ্ধ বাতাস এখন শুয়ে শুয়ে ক্ষেতের তামাক খাওয়ার মতো সহজ। কদিন পর দেখা যাবে, চাইনিজরা এই ক্যান আমাদের কাছে বিক্রি করা শুরু করে দিয়েছে। ওদের কৃত্রিম ডিমের ব্যবসা ফ্লপ করেছে। এটা ওরা ভালোই জানে। আর ব্যবসার কথা যদি বলতে হয় তবে এরা অস্ট্রেলিয়ানদের চেয়ে কমপক্ষে দশ কাঠি সরেস। আসল কথাটি হলো, ইনোভেটিভ হতে হবে। আর চাইনিজরা কিছু না পারলেও আমরা পারবো না এমন তো নয়।