‘কৃষ্ণচূড়া আড্ডা’–কী যে ভালো লাগলো!

কাজী শহীদ শওকত
Published : 14 May 2016, 07:37 PM
Updated : 14 May 2016, 07:37 PM

আড্ডা কখনও ফরমাল হয় না। আর সেজন্যই 'কৃষ্ণচূড়া আড্ডা'র সময় আর স্থানের বাইরেও আরও কিছু যেমন কী কী বিষয়ে আড্ডা হবে, কয়টা পর্যন্ত হবে ইত্যাদির ধারও কেউ ধারেনি। আড্ডার নামটা দারুণ। এমন নাম আগে শুনিনি। ওদিকে চন্দ্রিমা উদ্যানে এবং তার আশেপাশে কৃষ্ণচূড়ার বাহার ক'দিন আগে যেমন ব্যাপক ছিলো তেমনটি নেই। তবে তাতে কারও খেদ ছিলো না। সময় ও স্রোতের মতো কৃষ্ণচূড়াও কারও জন্য অপেক্ষা করে না। তাই ফাগুনের ফুল এই গ্রীষ্মের মাঝামাঝিতে এসেও যে ফুটে আছে — তাতেই সবাই তুষ্ট ভীষণ।

সেদিন বৃষ্টিধোয়া সতেজ বিকেলে আমরা বসেছিলাম। শুক্রবার থাকায় আর পাঁচ-ছ'দিনের মতো কাজের ঝামেলা ছিলো না। যেটুকু ব্যক্তিগত কাজটাজ থাকার কথা সেটাকে অগ্রাহ্য করা কষ্টকর নয়। এর আগে শেষ কবে ঢাকা গিয়েছিলাম মনে নেই।

প্রিয় ব্লগার জাহেদ-উর রহমান ভাই, ফারদিন ফেরদৌস ভাই-এর সাথে মোনেম অপু ভাই, আইরিন সুলতানা আপু, শফিক মিতুল ভাইকে ব্লগের গত বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানের ভিডিওতে দেখেছি। এবার কৃষ্ণচূড়া আড্ডায় এঁদের প্রায় সবাইকে পেয়েছি যদিও প্রথমোক্ত দুজনের উপস্থিতি খুব মিস করেছি। তাঁরা আসেননি—এটা স্বচক্ষে দেখার আগে মনেও আসেনি এমনটি দেখতে হবে। একই রকম অনুভূতি আতা স্বপন ভাইয়ের অনুপস্থিতির ব্যাপারেও। তাঁর মতো আরও অনেকেরই বৃষ্টি-বাদলার কারণে আসা হয়নি। আর তাই জাকির ভাই, নারায়ন দা আসবেন না –এটাও মেনে নেওয়া যেতো না যদি এই বৃষ্টির অজুহাতটা না থাকতো। ওয়াসিম ফারুক হ্যাভেন ভাই, দিব্যেন্দু দ্বীপ ভাই, গালিব মেহেদি ভাই, কাজী রাশেদ ভাই, সুমিত বণিক ভাই, নুরুন্নাহার লিলিয়ান আপু, সুমনা শারমিন আপু—এরকম যাঁরা যাঁরা নিয়মিত লিখছেন তাঁদের সবার কথা মনে পড়েছে। ইশ্‌! সবাই যদি এক সাথে হতে পারতাম! সদাহাস্য মজিবর ভাইয়ের সাথেও এবারই প্রথম কথা হলো। রাজ্জাক ভাইয়ের অবস্থান মাত্র পাঁচ হাজার মাইল দূরে স্বত্ত্বেও আসতে পারেননি। আগের বার আড্ডায় তিনি ছিলেন। ওরকম দূরত্বে থাকা মহিউদ্‌-দ্বীন ভাই  আর আলাউদ্দিন ভাই কিংবা বাংগাল ভাইও আসবেন না–জানা ছিলো।

আরও এসেছিলেন কবি, গল্পকার ফারুক আবদুল্লাহ ভাই। আশিকের সাথে পরিচয়টাও আগে ছিলো না। জানা গেলো অন্ধদের লিখন পদ্ধতি ব্রেইল নিয়ে তার সম্পৃক্তির কথা। এ ব্যাপারে আইরিন আপুর সাম্প্রতিক কাজের কথা শুনলাম। তিনি আর তাঁর আরও কয়েকজন লেখক বন্ধু মিলে যা করছেন তা চমৎকার। চর্মচক্ষুর ব্যবহার করতে পারেন না এমন শিক্ষিতজনদের জন্যে সমসাময়িক গল্প, কবিতাকে ব্রেইলে পড়ার উপযোগি করে উপস্থাপনের এই চেষ্টাটি দারুণ। ওহ! যে কথা বলতে ভুলিনি, তাঁর সাথে আরও দু'জন প্রাণোচ্ছ্বল ছোট্ট বন্ধু এসেছিলো আমাদের আড্ডায়ঃ সুমনা এবং শ্রাবণ; যদিও দুজনের কেউই এখনও স্কুলের গণ্ডি পেরোয়নি, ব্লগের লেখা পড়া হয় তাদের। নগর নাব্যের সাম্প্রতিক প্রকাশনা থেকে লেখাগুলোর নাম চটপট বলে দিতে পারলো। আমাদের একজন নবীন ব্লগারও ছিলেন আড্ডায়। ওঁর নাম সীমান্ত। আশা করছি সীমান্ত ভাইয়ের ডেবিউ পোস্টটি ব্লগে সহসাই দেখতে পাবো।

এই ব্লগে একজন আছেন যিনি ব্লগ লেখার চেয়ে মন্তব্য করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। অবশ্য গুরুত্ব এবং আকার বিবেচনায় তাঁর মন্তব্যগুলোও কখনও কখনও একটা পূর্ণ ব্লগপোস্টের সমান বড়ো হয়ে থাকে। তাঁর মন্তব্যে সমালোচনা, পরামর্শের পাশাপাশি যে বিরল জিনিষটা পাঠকের মনে আনন্দ যোগায় সেটি হলো তাঁর লেখার স্টাইল—অদ্ভুত সুন্দর হিউমারে ভরে থাকে তাঁর প্রায় প্রতিটি মন্তব্য। এই বিশেষ দক্ষতা দীর্ঘ চর্চা আর অভিজ্ঞতার ফসল—সেটি নিঃসন্দেহে বলা যায়। এতোদিনে অন্তত এটুকু বুঝতে পেরেছি, ব্লগ লেখার চেয়ে ব্লগে মন্তব্য লেখা অনেক বেশি কঠিন। এই প্রিয় ব্লগারকেও দেখার সাধ ছিলো। সাধ পূর্ণ হলো। মজিবর ভাই এই গুণী ব্লগারের নামের আদ্যাক্ষর দিয়ে সুন্দর নিক বানিয়েছেনঃ জুজু।

নিতাই দা সকাল থেকেই তাড়া দিচ্ছিলেন রওনা দেওয়ার জন্য। ময়মনসিংহে গতকাল সকালে সাড়ে এগারোটা অবধি কোনো বৃষ্টি ছিলো না। বাসের টিকিটটা নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি অবস্থা বেগতিক। বাসটা ছাড়লো বারোটায়। আব্দুল্লাহপুর পর্যন্ত ঝুম বৃষ্টি। সাথে দমকা বাতাসও ছিলো কখনও কখনও।চন্দ্রিমা উদ্যানের সামনে, লেইক ব্রিজটার গোড়ায় নেমে দেখি চারটা বাজে। ব্রিজের মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে আছেন সবাই। রোদ ওঠেনি; তবে দিনটা আগের চেয়ে উজ্জ্বল হলো। আমরা গিয়ে বসলাম উদ্যানের ভেতর। ঘাসের শরীর তখনও শুকায়নি। পরিচয় পর্বের সূত্র ধরে জানা হলো ব্লগিং ছাড়াও আর কে কী করছি। এরই মাঝে জুবায়ের ভাই তানজির ভাইয়ের বহুবিধ আইডেন্টিটি নিয়ে তাঁর মধুর বিশ্লেষণ শুরু করে দিলেন। নিজের হিউমারময় লেখার মতোই চনমনে, প্রাণবন্ত মানুষ জুলফিকার জুবায়ের।

কিছুক্ষণ কথাটথা বলে চানাচুর, চিপ্‌স আর চকোলেট চিবিয়ে নিলাম সবাই। ঘড়িতে তখন পাঁচটা কি সোয়া পাঁচটা। আড্ডা জমে ওঠলো। শিল্প-সাহিত্য নিয়ে কথা হলো। কথা হলো ব্লগিংকে আরও তুমুল করতে নানারূপ ভাবনার। মোনেম অপু ভাই তাঁর লেখালেখির শুরুর গল্প শোনালেন। এর আগে তাঁর লেখা পড়ে আমার ধারণা জন্মেছিলো তিনি হয় ফিলোসফির কিংবা ইংরেজি সাহিত্যের মানুষ হবেন। কিন্তু এবার দেখা হলো বলেই জানা গেলো, অনুমানের কোনোটিই ঠিক নেই। ইলেকট্রনিক্স-এ একাডেমিক সাফল্যের অধিকারী কারও স্টেরিওটিপিক্যাল যেসব গুণাবলী আছে বলে সাধারণভাবে ভাবা যেতে পারে তাতে ব্লগিংটা সম্ভবের জায়গায় থাকে না। কিন্তু অপু ভাইয়ের বেলায় হিসবটা এভাবে মেলে না। এই মানুষটার ভালোবাসা ছায়া হয়ে সারাক্ষণ সাথে আছে–টের পাই।

ছোটবেলায় দেওয়াল পত্রিকায় লেখালেখি থেকেই আনুষ্ঠানিক লেখা প্রকাশের শুরু হয়েছিলো তাঁর। জিজ্ঞেস করলাম, কখনও বই বের করেননি কেনো? উত্তরে যা বললেন তার অর্থ হলো, লেখার সম্পূর্ণতা নিয়ে তাঁর খুঁতখুঁতে ভাবটা আছে। একটা বই মানে একটা সম্পূর্ণতার তাড়া, যেটা অনেক সময়ের ব্যাপারও বটে। কিন্তু ব্লগ লেখাটা তেমন নয়। চিন্তার একটা পর্যায়কে তুলে ধরে ব্লগ লিখে ফেলা যায়; পরবর্তি অংশটুকু আরও কোনোদিন অন্য একটি লেখায় সময় করে সাজিয়ে লেখা যায়। আর পাঠকের নৈকট্যের ব্যাপারটি তো আছেই। কথা হলো সমসাময়িক রাজনীতি, নৈতিকতাকতা, শিক্ষাদীক্ষার নানা প্রসঙ্গ নিয়ে। দেশের এবং নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। আশার কথা। হতাশার কথা। জাবি'র মিতুল ভাই জানালেন তনু হত্যার প্রতিবাদে ওখানকার স্টুডেন্টদের মুভম্যান্টের সর্বসাম্প্রতিক অবস্থার কথা। কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে চলছে ক্যামেরার ক্লিক। আমাদের দুটো সেমি ডিএসএলআর আর প্রত্যেকের ফোনের ক্যামেরা। এখানে যে ছবিগুলো দেখা যাচ্ছে, এগুলোর বেশ কয়েকটি মিতুল ভাইয়ের তোলা।

নিতাই দা বিদায় নিলেন। তিনি একটি এনজিও-র কোষাধ্যক্ষ্য। সন্ধ্যার পরই কিছু অফিসিয়াল কাজ তাঁর না করলেই নয়। তাই তাঁকে যেতে দিতেই হলো। তাঁকে বিদায় দিয়ে আমরা উদ্যানের এক পাশে ঘাসের উপর পুরনো পত্রিকার কাগজ বিছিয়ে নিজেদেরকে বসালাম। জুলফিকার জুবায়ের ভাই আর মজিবর ভাই কেটারিং-এর গুরু দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে ফাইফ স্টারে গিয়ে যেনো হারিয়ে গেলেন। ফিরে এলেন প্রায় ঘণ্টা খানেক পরে। সাথে চিকেন বল, ফ্রাই, কোল্ড ড্রিংক, দই-মিষ্টির প্যাকেটগুলো। শুধু গল্পে মন ভরে। পেট ভরে না। নিবেদিত এই দুই প্রাণ মেজবান নিজ হাতে সবাইকে খাওয়ালেন। নিজেরাও অভুক্ত থাকেননি। আড্ডাও ননস্টপ। খাওয়াটাও। চানাচুর, চকলেটে, আর চিপ্‌স-এ গেছে কয়েক ঘণ্টা । একটু ভারী কিছুর দরকার ছিলো। তারপরও সবাই যথাসাধ্য চেষ্টা করলেন; খাবারগুলো শেষ করা গেলো না। শেষে জুবায়ের ভাই একটা বিহিত করলেন উপযুক্ত পাত্রে। ফুল বিক্রেতা ওই শিশুরা নিশ্চয়ই এমন খাবার বহুদিন কিংবা কোনোদিনই খায়নি। খাবার পেয়েই কিনা কে জানে, চল্লিশ টাকার বেলী আর বকুল ফুলের মালা  ত্রিশ টাকায় দিলো। আরেক দরদি ভাই দশ টাকার ফুল স্বেচ্ছায় বিশ টাকায় কিনে নিলেন। এদিকে কথায় কথায় সময় বয়ে যাচ্ছিলো। গোল আড্ডাটায় তখন আলো বাড়ছিলো। বাইরে তখন উত্তীর্ণ সন্ধ্যা।

বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় এগারোটা। স্ত্রী আর দুই ছেলেমেয়ে অপেক্ষায়। মায়ের ফোন কিছুক্ষণ পরপর। ব্লগারদেরকে নিয়ে আজকাল খুনখারাবি হচ্ছে বলে মায়ের উৎকণ্ঠার শেষ নেই। আপাদমস্তক অক্ষত ফিরেছি জেনে উৎকণ্ঠা দূর হয়েছে। প্রতিদিনের আনা এটা-সেটার মতো খাবার কিছু একটা বাবা আনবে এমনটি শৈলী আর নীলের জানাই ছিলো। কিন্তু ওদের জন্য এত্তো ঘ্রাণের ফুল নিয়ে আসবো, এমনটি ভাবেনি। বকুল আর বেলীর গন্ধ নিতে নিতে ওরা ঘুমিয়ে গেলো। রাতের খাবার শেষ করে ভাবলাম গরম গরম একটা পোস্ট দিয়ে দিই। কিন্তু ক্লান্তিটা বেয়াড়া, আর সেই সাথে তাজা বকুল আর বেলীর গন্ধ—ঘুমটাকে ঠেকানো গেলো না।

ব্লগারদের ভালোবাসা অন্য লেভেলের হয়। এই ভালোবাসার দাবি এরকম আড্ডা ছাড়া শুধু লেখা দিয়ে মেটানো দায়—আগে বুঝিনি। বেলী কিংবা বকুলের মতো একেকজন ব্লগারও একেকটা ঘ্রাণের ফুল।