তার মৃত্যুতে পাহাড় হারিয়েছে সংস্কৃতির নিবেদিত প্রাণ আলোকবর্তিকা।
একদিন তাহার বিবাহ হইলো। প্রথম নাইওর হইতে আসিবার কালে পুঁটলাদির সঙ্গে দুইখানা ক্যাকটাস, গোটা পাঁচেক গোলাপ আর চন্দ্রমল্লিকার গাছ এবং আরও কী কী লতাটতা লইয়া উঠিলেন গাড়িতে। পতি তাহার এই সকল বৃক্ষকেন্দ্রিক আবেগের কদর বুঝিতে অপারগ ছিলেন। তাই বিরক্ত, বিস্মিত হইয়াছিলেন; মৃদু স্বরে বলিয়াছিলেন– এইসব কাঁটা-গুল্ম লইয়া ঝামেলার কী দরকার আবার? কিন্তু তাহাকে নিবৃত করা যায় নাই।.
.দিনে দিনে সংসার বড়ো হইয়াছে। বাসস্থান বদল হইয়াছে এইখান হইতে সেইখানে। কিন্তু তাহার পুষ্প-বৃক্ষ প্রেম বরাবরই ওইসব বৃক্ষ-লতা, ক্যাকটাস কাঁটা ইত্যাদির পরিবহণে, মাটি কিংবা জলের যোগানসহ প্রয়োজনীয় সব পরিচর্যায় তাহাকে অক্লান্ত রাখিয়াছে বরাবরই।
.এইখানে এই তিন কামরার বাসাটার এই এক চিলতে বারান্দা। এখন ঈষৎ শীত। সকালে এই দিকের দরজা খুলিয়া দিলে কুয়াশার সঙ্গে ওই কোণায় ফোটা গোলাপের ঘ্রাণ পাওয়া যায়। এই তো সেদিন এইখানে বেলিও ফুটিয়াছিলো কয়েকটা। বেলি তাহার খুব পছন্দের ফুল। প্রতি পতিই অধম হয় না হয়তো। কিন্তু তাহারটা, মানে এই আমিটা তেমন নাকি তেমন না তাহা বড়ো কথা নহে। বড়ো কথা হইলো, একদিন বেজায় বড়ো ঝগড়া হইলো। বাহিরে কাজে ছুটিয়া গিয়া ক্ষোভ ভুলিবার আয়োজন করিতে গিয়া অনুভব করিলাম, আতঙ্ক। কী আতঙ্ক? আদার ব্যাপারিসুলভ আমি মানুষটার সাথে তাহার থাকিয়া যাইবার মতো এই 'আমি'টা ছাড়া উল্লেখ করার মতো আর তো কিছুই উপস্থাপন করা হয় নাই এতো কাল। এইবার বুঝি তাহার সেই মায়াতেও কুঠার হানিলাম! চলিয়া যায় যদি! কিন্তু না, তেমন কিছু ঘটে নাই। সকলই ওই টবসব আর ওইখানে বড়ো হওয়া গাছগুলির কল্যাণে। মানে, সবগুলি গাছ লইয়া একা একা মুভ করা তাহার পক্ষে ডিফিকাল্ট ছিলো।.
.সেই সময়ের পর হইতে আমারও বৃক্ষ প্রেমে ব্যাপক প্রবৃদ্ধি ঘটিয়াছে। অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করিয়াছেন, আমি কেনো এতো লতাপাতাফুলের ছবি আপ্লোডাই, আল্লার দুইন্যাত কি আর কিছু নাই? আমি তাহাদের দিকে চাহিয়া মুচকি মুচকি হাসিয়াছি। কিছু বলি নাই কারণটারণ। আজ নিশ্চয়ই তাহারা সত্য জানিতে পারিবেন। আমি গাছাপালাফুলটুল সত্যিই খুব ভালোবাসি। ঠেকায় পড়িলে তুলসির পাতা, চন্দ্রমল্লিকার বড়া, ক্যাকটাস কুচি চাবাইয়া চাবাইয়া দুই-চার-পাঁচ দিন অনায়াসে কাটাইয়া দিতে পারিবো। এর বেশি পারিবো না কারণ এই বারান্দায় এখন খুব বেশি গাছ নাই। একদিন অনেক বড়ো বারান্দা হইলে, কিংবা একটা আস্ত ছাদের অধিকার পাইলে সেইদিন তিনি নিশ্চয়ই অনেক খুশি হইবেন। আর তখন ঠেকায় পড়িলে ফুল-পাতা-ক্যাকটাস খাইয়া আমিও অনেকদিন অনায়াসে কাটাইয়া দিতে পারিবো।.
.আরেকটা কথা তো বলিতে ভুলিয়াই গিয়াছিলাম প্রায়। এখন তিনি কোথাও বেড়াইতে গেলে গাছে পানি দেওয়ার কথা মনে করাইয়া দিয়া যখন জিজ্ঞেস করেন, 'তুমি খাইছো?', তখন তাহার পুষ্পপ্রেমের বয়স মনে করিয়া নিজেকে মালি ভাবিতে মোটেই আর খারাপ লাগে না। আমি এখন ফুল-পাখি-লতা-পাতা খুব ভালোবাসি। পাখির কথা বলিলাম কারণ এই বারান্দাতে পাখিও আসে। ভ্রমর আসে। মৌমাছিরা ভিড় করে। সেইবার তো এক বুলবুলি দম্পতি বাসাই বাঁধিয়াছিলো এই বারান্দায়। তখন বুলবুলির জীবনকে খুব নিকট হইতে দেখিবার সৌভাগ্য হইয়াছিলো।.
.দুই দিন আগে লক্ষ্য করিলাম আরেক কাণ্ড। আমাদের কন্যা শৈলী তাহার জীবনের প্রথম কবিতা লিখিয়াছে। কিন্তু আমাকে দেখাইতে তাহার লাজের অন্ত নাই। তাহার ধারণা, লেখাটা ভালো হয় নাই। পরে যখন দেখাইলো, তখন ভালোমন্দের চাইতেও বড়ো যে বিষয়টি বুঝিলাম তাহা হইলো, এইসব লতা-পাতা-ফুল-পাখির আছর তাহার উপরেও বেশ পড়িয়াছে। ছোটো আরেক জনের অবশ্য পাতা-ফুল ছেঁড়ার অভ্যাসটা কিঞ্চিত এখনও আছে। তবে আমরা আশাবাদী, সেও দলে চলিয়া আসিবে।