ঘুম বাতাসের দ্বীপে সবুজ বিহারে একদিন

কাজী শহীদ শওকত
Published : 2 July 2017, 08:47 AM
Updated : 2 July 2017, 08:47 AM

একটা প্রজাপতির পিছু ছুটছি। পতঙ্গ কখনও সুস্থির খুব একটা হয় না। কিন্তু এ যেনো একটু বেশিই অস্থির। ফুল-পাতা ছুঁয়ে দিয়েই ছুট। বসছে না তেমন কোথাও। আবার বসতে গেলেও টিকতে পারছে না; কারণ বাতাসের ঢেউ। পাশেই আরেক ক্ষেতে গরুর পিঠে চড়ে বসেছে সৌখিন ফিঙে এক। গাভীর ওলানে মত্ত, মায়ের মতো দেখতে একটি বাছুর। শিকারের আশায় চুপচাপ বসে থাকা বিষণ্ণমুখ বাজপাখি। ওদিকে আরও প্রায় তিরিশটি শালিক হৈচৈ করছে বিদ্যুতের তারে বসে। দুপুরের কড়া রোদ।

.

প্রজাপতির যেহেতু রক্ত শীতল, রোদ ওর চাই-ই। বাতাস থাকুক আর না থাকুক। তবে এরকম রোদে, বাতাসের আরাম না জুটলে, পাখিদের পক্ষে বেশিক্ষণ টেকা মুশকিল। দেখে বোঝা যায়, ঘাসের, কচুরির ফুল পেয়ে প্রজাপতি খুশি। আর যেহেতু খেত-খামারে পানি আছে, আর পোকামাকড়, ফড়িং, মাছ-টাছ ইত্যাদি পাওয়া যাচ্ছে, তাই পাখিগুলোরও অন্তত পানাহার নিয়ে টেনশন নেই। মেঘের রঙ চমৎকার। এই রোদ, এই ছায়া। দূরের রাস্তায় সাঁই-সাঁই ট্রাফিক। তাই বলে ওদিকের শব্দ এদিকে দূষণ ঘটানোর সামর্থ্য রাখে না। এখানে শব্দ বাতাসের, পাখির, জলের এবং পতঙ্গের।

.

.

বন্ধু শঙ্করের হ্যাচারি এখানে। বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির মৎস্যচাষ হয়। ঈদের ছুটিতে যাবার সুযোগটা হয়ে গেলো। দেশি মাগুরের স্ট্রিপিং হবে। মেয়ে মাগুরের পেট থেকে চেপে ডিম বের করে, তার সাথে কিভাবে ছেলে মাগুরের শরীর থেকে নেওয়া শুক্রানু  মিশিয়ে পানিতে ছাড়া হয় তা দেখবো। ময়মনসিংহে মৎস্যচাষে বিপ্লবের সূচনা অনেক আগেই হয়েছে। এবং পথ চলতে গিয়ে দূর থেকে ডানে-বায়ে অনেক হ্যাচারির অবকাঠামোতে  চোখ পড়েছে। কাছে গিয়ে এরকম দেখার অভিজ্ঞতা হয়নি কখনও।

.

.

কৃত্রিম প্রজননের এই প্রক্রিয়া দেখা হয়েছে। আর তার সাথে এখানকার সতেজ প্রকৃতি আর জীববৈচিত্র‍্য। দারুণ শুশ্রূষায় বুকের বিষ অনেকটাই ঝরিয়ে দিয়েছে। বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠের বুকে এই টিনের ছাউনিটা যেনো একখণ্ড দ্বীপ। তুমুল সবুজের শরীর বেয়ে গ্রামীণ ঘ্রাণ, আর দূর কোনো বৃষ্টি মাড়িয়ে আসা হুড়মুড় বাতাসের সতেজ ঝাপটা। পৃথিবীর আর সব বৈভবকে নগণ্য করে এই রূপ-রস-গন্ধের এতো আয়োজন জীবনকে উদ্ধার করে। নিরাময় দেয়।

.

.

নগরের বাতাসে সীসা, কার্বন, চিকনগুনিয়াসহ বিবিধ বিষের সংসার। তার উপর আকাশ ঢেকে রাখে উন্মত্ত দেয়াল, ফোনের টাওয়ার। নাগরিক গাছপালা ধূলো-ময়লায় আকীর্ণ থাকে। বৃষ্টিতেও তার সব ধুয়ে যায় না; আঠালো, কালচে প্রলেপের মতো লেগে থাকে। তার মানে ওখানে বিষ থাকে। ধীরে ধীরে সেরকম বিষাক্ত ক্লেদ জমতে থাকে বুকের ভেতর। আর তখন কাঠখোট্টা নগর ভীষণ বিরক্তিকর ঠেকে। কেউ একেবারেই বন্দি কিংবা প্রতিবন্ধি হলে অন্য কথা। কিন্তু সামর্থ্যবানদের কাছে, অর্থাৎ কেবল মানিয়ে না নিয়ে যারা মুক্তির উপায় অনুসন্ধানে আন্তরিক, তাদের কাছে এরকম জায়গা স্বর্গসমান– সন্দেহ নেই। এরকম টলমল জলের পুকুর, ঘাসের মখমল, কোমল আকাশের সাদা-নীল প্রেম, ফড়িং আর প্রজাপতির দুরন্তপনা, রোদ মাখামাখি– পুরো অঞ্চলজুড়ে কী যে দৃশ্যের ঢেউ! নাগরিক ছটফট জীবনকে বিষণ্ণ করে। বিষণ্ণতার ওষুধ এখানে, এই বাতাসের দ্বীপে সবার জন্যে ফ্রি।

.

.

যেমনটি  বলছিলাম, বাইরে তখন ভীষণ রোদ, আর ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। চারপাশে অবাধে বাড়ন্ত কচুরির সবুজ, দূর্বা, কচু এবং হেলেঞ্চার সবুজ ছাড়াও আরও আরও ঘাস-পাতার সবুজ। গাঢ় এবং কম গাঢ়  অন্তত চার ধরণের সবুজ। মিলেমিশে ঘন হয়ে আছে। বুকের কোথাও এ রঙ জমা হয়। চোখের শান্তি হয়। এই সবুজকে মুখর করে ওই দূরাগত চপল বাতাসের তোড়। দখিনা বাতাস। খিড়কি দিয়ে এসে ঘরটা ভাসিয়ে দিচ্ছে। গা শিরশির। ঠাণ্ডা। ভালো লাগার এসব সময়ের গতি আরও মন্থর হল আরও ভালো লাগতো। ভাবছিলাম, এখানে ভরা পূর্ণিমার রাতে এলে কেমন লাগবে।

.

ঠিক জানলার ধার ঘেঁষে চৌকি পাতা। বসতে গেলে শুতে মন চায়। শুতে গেলে চোখের পাতা বুঁজে আসে। তবু আকাশ দেখার আরাম পেতে চোখ খোলা রাখা চাই। যেদিকে চোখ ফেরানো যায়, মাঠের পরে মাঠ সবুজময়। আর উপরে মেঘের কোলে ঝলমলে রোদ। সহসা দেখি, একটু বাঁ-দিকে, কালচে মেঘের ব্যাকগ্রাউন্ডে উড়ন্ত বকের এক প্রস্থ ঝকঝকে সাদা। দুই খেত পরেই আরেকটা বককে দেখা গেলো খাবার খুঁজছে।হ্যাচারির মাছেদের সুবিধে হলো, ওদেরকে খাবার খুঁজে খেতে হয় না। মাছেদের যত্নে যেনো গাফিলতি না হয়, সেজন্য এখানে সার্বক্ষণিক বিদ্যুতের ব্যবস্থা রাখতে হয়। জেনারেটর আছে। যে পাঁচজন কর্মী মাছগুলোর এবং তাদের ছানাপোনার দেখভাল করেন, তাদের বিনোদনের জন্য টিভিও আছে। ফোনের নেটওয়ার্ক বেশ ভালো। কিন্তু এখানে কোনো ফ্যান নেই। নেই মানে দরকার হয় না। এস্কিমোদের ইগলুতে যেমন ফ্রিজ নেই।

.

.

একবার কয়েক মিনিটের জন্য বাতাস পড়ে গেলো। পাখিরা চিৎকার করতে করতে দূরে কোথাও গেলো। বৃষ্টি হবে– সেরকম লক্ষণও নেই। বাতাস ফিরলো। পাখিরাও তারে এসে দলবেঁধে বসলো। রোদটাকে আর অসহ্য লাগলো না। আকাশের নীল, রোদ আর সবুজের সামগ্রিক চিত্র ক্যামেরার জন্যও ছিলো পারফেক্ট। ওহ, শুরুতে বলতে ভুলে গেছি। আমরা দুজন বেরিয়েছিলাম বারোটার দিকে। তিরিশ জুন। একটার বেশ আগেই পৌঁছানো গেলো। ময়মনসিংহ থেকে ঢাকার দিকে, হাইওয়ে ধরে কিছুদূর এগিয়ে গেলেই হাতের ডানে। জায়গাটার নাম উকিলবাড়ি, বইলর। পথের ঠিক পাশেই রিলায়েন্স একুয়া কালচার। ওখান থেকে আদিগন্ত মাঠ। পুকুর এবং ক্ষেতের ধার দিয়ে হেঁটে যেতে হয়। ঘাসমোড়া মাটির পথ ধরে যেতে যেতে শঙ্করের হ্যাচারিটা চোখে পড়ে।

.

.

যাতায়াতের ও পরিবহণের সুবিধের জন্য বাঁশের সাঁকো তৈরি করা হয়েছে। সাঁকোর পাশেই ক্ষেতের পানিতে মাছ ধরায় ব্যস্ত কয়েকজন। খুব সাধারণ দৃশ্য। তাছাড়া নিজের শৈশব, কৈশোর গ্রামেই কেটেছে। তবু কেমন করে যেনো এগুলো অসাধারণ হয়ে ওঠছে। মনে হলো, এই ফুরফুরে বাতাসে কিছু একটা আছে। বিরলজাত মুগ্ধতা আর আনন্দকে সহজলভ্য করে দেয়।

.

.

মাছের স্ট্রিপিং–এর দৃশ্য সুন্দর নয়। প্রথমে মেয়ে মাছের পেট ডিম বের করে একটা বাড়িতে রাখা হয়। কালচে, হলুদাভ ডিম। থকথকে সুজির মতো নরম, দানাদানা, পিচ্ছিল। এরপর ছেলে মাছের পেট কেটে ছোট সাদা ফিতের মতো শুক্রাণুর দলা বের করে নিয়ে, ব্লেড দিয়ে কেটে এবং পিষে ওই বাটি ভরা ডিমের সাথে মেশানো হয়। তারপর আগে থেকে পানি দিয়ে রেডি করে রাখা হাউজে এগুলোকে ছেড়ে দেওয়া হয়। আটচল্লিশ ঘণ্টা পর এগুলো থেকে বিন্দু বিন্দু প্রাণ তথা মাছের রেণু ফুটবে। এরপর ওগুলোর বাসা বদল…ওদেরকে ডিমের কুসুম খাওয়ানো….ইত্যাদি ধারাবাহিক পালন প্রক্রিয়া। স্ট্রিপিং চলছে। ওদিকে রান্না ঘরেও কাটাকুটি চলছে। মাগুর মাছের ঝোল আর একটু আগে ক্ষেত থেকে ধরে আনা পুঁটি মাছের চচ্চড়ি। দুপুরের খাবারের মেনু।

.

.

রান্না শেষ হতে সময় নেবে। ভাবলাম আরও কিছুক্ষণ বাতাস খাওয়া যায়। জানলার ধারে চৌকিতে বালিশ পাতা। শুয়ে শুয়ে বাতাস খাই। আকাশ, মেঘ, সবুজ পান করি। হুট একটা বাচ্চা দোয়েল চলে এসেছে ঘরের ভেতর। নির্দ্বিধায় লাফাচ্ছে, বেড়াচ্ছে। এরই মাঝে পানির পাম্প চালু হলো। প্লাস্টিকের পাইপ বেয়ে সে পানি যাচ্ছে সামনের এক পুকুরে। মাটির খুব গভীর থেকে উঠে আসা এ জলে গলা ভেজাতেই শরীর আরও প্রশান্ত হয়ে এলো। আমাদের গ্রামের বাড়ির বাঁশঝাড়তলার টিউবওয়েলের জলের স্বাদ ঠিক এরকমই। আকাশে মেঘের রঙ আরও কালচে হচ্ছে। সূর্যের তেজ কমে আসছে। বিকেল হয়ে এলো। এ সময়ে ঘুমোনোর অভ্যেস নেই। কিন্তু বাতাসে গা বিছিয়ে আকাশ, মেঘ আর মাঠের সবুজ দেখতে দেখতে সত্যিই ঘুমিয়ে পড়লাম।

.

.

শঙ্করের ডাকে ঘুম ভাঙলো। ভাত-মাছ দিয়ে দুপুরের খাবার খেলাম আমরা বিকেলবেলা।  এরপর ফেরায় সময়। ফিরতে ফিরতে ভাবছি, কিছু কাজ বাকি রইলো। প্রথমত, বকের  ওড়ার দৃশ্য ক্যামেরায় ঠিকঠাক ধরা গেলো না, খুব চেষ্টা করেও। দ্বিতীয়ত, বহুদিনের শখ, এক ঝাঁক উড়ন্ত পাখির ছবি তোলার। অথচ সেদিন প্রায় শ'দেড়েক পাখির একটা ঝাঁক চোখের সামনে দিয়ে উড়ে যেতে দেখেও কাজের কাজটি হয়ে ওঠলো না। তৃতীয়ত, হ্যাচারি ঘরে বসে টিনের চালে বৃষ্টি আর পুরো তল্লাটে ঝড়বাতাস মুখর একটা সময় কাটানো লোভটা ঝুলে রইলো। তবে ভালো খবর হলো, এবারই প্রথম এতো কাছ থেকে ফিঙের ছবি নিতে পেরেছি। এর আগে তোলা ফিঙের ছবিগুলোতে চোখ স্পষ্ট আসেনি। হ্যাচারিঘরের ঠিক সামনেই যে নাতিদীর্ঘ গাছটা, ওটাতে গায়ের পরে রোদ লাগিয়ে বসেছিলো একটা ফিঙে। ওর জ্বলজ্বলে লালচে চোখ খুব উজ্জ্বল হয়ে আলোকচিত্রে ধরা দিলো। এই বর্ষায় অন্তত আরেকবার চুপটি করে বৃষ্টির আগে আগে ওখানে চলে যাবো, ভাবছি।