হাত পা বেঁধে নদীতে সাঁতার

বিদিশা
Published : 9 Jan 2011, 11:44 AM
Updated : 23 May 2011, 02:25 PM

জীবনে আইনজীবীর প্রয়োজনীয়তা আমি প্রথম উপলব্ধি করি আজ থেকে ৬ বছর আগে। সেই মুহূর্তটির কথা এখনও খুব মনে আছে। আমি তখন থানা হাজতে, কংক্রিটের মেঝেতে শুয়ে ছিলাম। গরাদের ওপাশে দাঁড়িয়ে আব্বা বলছিলেন, আগে এখান থেকে বের হতে হবে। এ জন্য আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করা দরকার। তোমার পরিচিত কেউ কি আছে?

আমার পরিচিত কেউ ছিলো না। আব্বারও কেউ নেই। মনে হলো, থাকলে হয়তো সহজেই তিনি আমাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যেতে পারতেন। পরে অবশ্য, দেশের খ্যাতিমান আইনজীবী ড. কামাল হোসেনের প্রতিষ্ঠানই আমাকে জেল থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করে। আমি তাঁদেরকে চিনতাম না, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তারাই এগিয়ে এসেছিলেন আমাকে ওই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে।

জেলে গিয়েছিলাম আমি আমারই সেই সময়ের স্বামীর দেয়া মিথ্যা মামলার কারণে। মামলাটি যে মিথ্যা ছিলো, তা পরে প্রমাণও হয়েছে। আমার জীবনে সে-ই যে মামলা মোকাদ্দমার সঙ্গে জড়ালাম, এখনো বের হতে পারিনি। গত ৬ টি বছর এমন কোনো মাস নেই, যখন আমাকে আদালতে দৌড়াতে হয়নি, আইনজীবীদের সঙ্গে বসতে হয়নি। ৬ বছর অনেক লম্বা একটা সময়। অথচ আশ্চর্য, এত দীর্ঘ সময় এদের সঙ্গে চলাফেরা, কথাবার্তার পরও এখনও আমি আইনজীবীদের বুঝতে পারিনি। আদালত আর বিচারকদের বুঝতে পারিনি। বরং শুরুতে হয়তো কেবল অজ্ঞ ছিলাম, এখন সেই অজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিকট কিছু বিভ্রান্তি।

আমার কাছে আইনজীবী এবং বিচারক– সমার্থক বলে মনে হয়। উচ্চ আদালতে আইনজীবীরাই পরে বিচারক হন। উভয়েই যা কিছু বলেন, যা কিছু করেন, আইনের আলোকেই করেন। আমার এই শেষ বাক্যটি নিয়ে কেউ কেউ আপত্তি করতে পারেন। নানা অভিজ্ঞতার পর আমার নিজের মধ্যেও হয়তো এই বিষয়ে কিছুটা সন্দেহ ঢুকে গেছে। ইদানিং প্রতিদিনই যেনো আরও দৃঢ় হচ্ছে এই সন্দেহ।

দু'একটা ঘটনার কথা বলি। ক'দিন আগে নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হলো। এনিয়ে বিরাট হইচই। একদল আইনজীবী এর প্রতিবাদ করলেন, আর একদল সমর্থন। একই ঘটনা আগের প্রধান বিচারপতি নিয়েও ঘটেছে। বিএনপি সমর্থক হিসাবে পরিচিত আইনজীবীরা তার নিয়োগের বিরোধিতা করেছেন, কুশপুত্তলিকা দাহ করার মতো ঘটনাও দেখা গেছে। এবিএম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি পদে খুব বেশি দিন ছিলেন না। তিনি চলে যাওয়ার পর এটর্নী জেনারেল বললেন, খায়রুল হক ছিলেন শতাব্দির সবচেয়ে যোগ্য প্রধান বিচারপতি। দু'দিনের মধ্যেই প্রতিক্রিয়া এলো ব্যরিস্টার মওদুদ আহমেদের কাছ থেকে। তিনি বললেন সম্পূর্ণ উল্টা কথা। তার মতে, খায়রুল হকের মতো বিতর্কিত প্রধান বিচারপতি নাকি গত এক শতাব্দিতে আর আসেনি। এই দুই আইনজীবী আসলে দেশের চলমান দুই প্রধান রাজনৈতিক ধারার প্রতিনিধি। আর এই দুই ধারার বাইরে খুব বেশি কিছু আইনজীবী টিকে থাকতে পারছেন কিনা তা নিয়েও দারুন সন্দেহ রয়েছে।

আমার খুবই জানতে ইচ্ছা করে, সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি নিয়ে বরেণ্য দুই আইনজীবীর এই সম্পূর্ণ বিপরীতমূখী মন্তব্য জাতি হিসাবে আমাদেরকে সমৃদ্ধ করছে, নাকি আমাদের দেউলিয়াত্বকেই নগ্ন করে দিচ্ছে? এই দুই জ্ঞানী আইনজীবীর মন্তব্যের মধ্যে কি অতিরঞ্জিত কিছুই নেই? তারা কি নিজের বিবেকের তাড়নায় এই মন্তব্য করেছেন, নাকি নিজ নিজ নেত্রীকে খুশি করতে প্রতিযোগিতায় নেমেছেন?

একটা বিষয় আরও অনেকের সঙ্গে আমারও মনে হয়, দেশের অন্য সব সেক্টরের মতো বিচার বিভাগেও রাজনীতি ঢুকে গেছে। ওই যে বলেছিলাম, বিচারক ও আইনজীবীরা যা কিছু বলেন, যা কিছু করেন, আইনের আলোকেই করেন। রাজনীতির অযাচিত প্রভাবের কারণে এই ধারণাটি এখন অনেকটাই যেনো অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তা না হলে, সর্বোচ্চ আদালতের বিজ্ঞ আইনজীবীরা কেনো পাড়ার রাজনৈতিক কর্মী সমর্থকের মতো আচরণ করবেন?

বর্তমান প্রধান বিচারপতিকে যখন সংবর্ধনা দিচ্ছিলো সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতি, সেখানে সমিতির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক উপস্থিত ছিলেন না। তারা বাইরে, আদালত প্রাঙ্গনেই সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতির কুশপুত্তলিকা দাহ করছিলেন। যে ভদ্রলোক বিদায় নিয়ে চলে গেছেন, তার বিষয়ে এতো ক্ষোভ প্রকাশের যুক্তিটা কী? তারা অবশ্য একটা কারণ দেখিয়েছেন, বলেছেন, নতুন প্রধান বিচারপতি যদি তার পূর্বসূরির মতো আচরণ করেন, তাহলে তাঁর প্রতিও এই মনোভাব প্রকাশ করা হবে। প্রকারান্তরে, এই আচরণকে কি প্রধান বিচারপতির প্রতি একধরনের হুমকি হিসাবে বিবেচনা করা যায় না? বিজ্ঞ আইনজীবীদের জন্য এটা কি আদৌ শোভনীয় কিছু?

আইনজীবী সমিতির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ বেশিরভাগ পদেই এবার নির্বাচিত হয়েছেন বিএনপি সমর্থকরা। যেহেতু তারা বর্তমান প্রধান বিচারপতির নিয়োগকে সমর্থন করেন না, তাই তারা প্রধান বিচারপতির সংবর্ধনায় উপস্থিত হননি। আবার ধরা যাক, তাদের পছন্দের ব্যক্তিটিকে যদি প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দেয়া হতো, তাহলে হয়তো আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরা উপস্থিত হতেন না। বিএনপি যে সময় সরকারে ছিলো, তখন এধরনের আচরণ দেখা গেছে।

বিচারবিভাগের স্বাধীনতার কথা প্রায়ই বেশ ফলাও করে বলা হয়। বিদায়ের মাত্র ক'দিন আগে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ নিয়ে বেশ হতাশাও ব্যক্ত করলেন। বললেন, এটা নাকি অনেকটা হাত পা বেঁধে নদীতে সাঁতার কাটতে দেয়ার মতো স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। আমি বিষয়টা হয়তো অতটা বুঝি না। মানুষ তার নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে অনেক কিছু উপলব্ধি করে। তেমনি কিছু অভিজ্ঞতা থেকে আমার মনে হয়েছে বিচারবিভাগের স্বাধীনতার চেয়েও এই সময়ে বেশি দরকার বোধকরি বিচারবিভাগের জবাবদিহিতা।

আমার অভিজ্ঞতার কথাটা বলে শেষ করবো এই লেখা। আমার সাবেক স্বামীর সঙ্গে আমার চলমান বেশ কয়েকটি মামলার একটি হচ্ছে, আমাদের সন্তান এরিকের কাস্টডি কেস। আমি এরিককে আমার হেফাজতে রাখার জন্য আবেদন করেছি আদালতে। আবেদনে আমি বলেছি, এরিক স্বাভাবিক কোনো শিশু নয়। সে একজন স্পেশাল কিড। সে দুরারোগ্য সেরিব্রাল পলসি রোগে আক্রান্ত। এ ধরনের শিশুর প্রত্যাশিত বৃদ্ধির জন্য সার্বক্ষণিক দেখাশোনা জরুরী। সে কাজটা একজন মা যতটা সুচারুভাবে করতে পারবে ততটা সম্ভব  নয় বৃদ্ধ পিতার পক্ষে। তার উপর পিতা যদি হন একজন ব্যস্ত রাজনীতিবিদ, তাহলে বিষয়টা আরও কঠিন হয়ে পড়ে। যা হোক এধরনের আরও কিছু যুক্তিসহ আমি আবেদনটি করি আদালতের কাছে।

আদালতের রায় আমার বিপক্ষে যায়। আমি হতাশ হই, কিন্তু আমার আইনজীবীরা হন না। যারা আমার সুহৃদ, তারা, আমাকে দেশের রাজনীতির সঙ্গে রায়টিকে মিলিয়ে নিতে বলেন। বলেন, আমার নাকি মামলাটা করাই ঠিক হয়নি। কারণ, সরকার নিশ্চয়ই চাইবে না যে, এরকম একটি মামলায় তাদের প্রধান শরিক দলের শীর্ষ নেতার পরাজয় হোক। আমি নিজে অবশ্য তা মনে করি না, আমি বিশ্বাস করতে চাই বিচারক আইনের পথেই চলেন, আইনের ভাষাতেই কথা বলেন। আমি এই ভেবে নিজেকে সান্তনা দিলাম যে, আমার আইনজীবীরা হয়তো যথাযথভাবে বিষয়টি হ্যান্ডেল করতে পারেনি।

তারপরও আমি অপেক্ষা করছিলাম, রায়ের কপিটি নিজে একবার পড়ে দেখবার জন্য। দু'দিন আগে পেলাম সেটি। পড়লাম। আবারও হতাশ হলাম। তবে এবারকার হতাশা অন্য কারণে। কেনো আমি আমার সন্তানের কাস্টডি পেতে পারিনা, তার অনেক ক'টি যুক্তিও বিচারক দিয়েছেন তাঁর রায়ে। সেসব নিয়ে এখানে আমি কোনো মন্তব্য করবো না, কারণ এ বিষয়ে উচ্চতর আদালতে ইতোমধ্যেই আপিল করা হয়ে গেছে। সেখানেই হয়তো এর নিষ্পত্তি হবে। তবে আমি কেবল একটি প্রসঙ্গ তুলবো। রায়ে বিজ্ঞ বিচারক বলেছেন, এরিক যে সেরিব্রাল পলসি রোগে আক্রান্ত, আমি নাকি সে বিষয়ে কোনো দালিলিক প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারিনি। রায়ের এই বক্তব্যটি আমার কাছে বিস্ময়কর ঠেকলো। আমি যে সিঙ্গাপুর এবং ইন্ডিয়ার একাধিক ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন আদালতে জমা দিয়েছি, যেখানে ইংরেজীতে স্পষ্ট অক্ষরে 'সেরিব্রাল পলসি' রোগের কথা লেখা আছে, তা কি তিনি পড়ার সুযোগ পান নি? এ রোগটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, রোগীর মস্তিষ্ক আর দেহের মধ্যে যথাযথ সিনক্রোনাইজিং হয় না। বিষয়টি এক এক জনের ক্ষেত্রে এক একভাবে প্রকাশ পায়। এরিকের এ বিষয়ক প্রাথমিক প্রকাশটি ছিলো তার হাঁটাচলার ক্ষেত্রে। শুরুতে সে একেবারে হাঁটতেই পারতো না। ওর বয়স যখন ৩ বছর, তখন তার পায়ে একটি জটিল অপারেশনও করতে হয়। বিজ্ঞ বিচারক এরিককে একবার সশরীরে আদালতে হাজিরও করেন। নিজ চোখে দেখেন তিনি এরিকের পায়ের সেই অপারেশনের চিহ্ন। অপারেশনের পর এরিক এখন কিছুটা হাঁটতে পারে, তবে একা একা নয়। কারো না কারো হেল্প লাগে, যখন হাঁটে তখন কিছু না কিছু ধরে হাঁটতে হয়।

এতকিছুর পরেও বিচারক মনে করেছেন, আমি নাকি এমন কিছু দালিলিক প্রমাণ হাজির করতে পারিনি, যাতে মনে হয় যে এরিক সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত। তাহলে কি তিনি মনে করেছেন, এরিকের একসময় রোগটি ছিলো, এখন নেই? কিন্তু সেটাও তো সম্ভব নয়। কারণ এটি এমনই একটি জন্মগত রোগ, যা কখনোই ভালো হয় না। তাহলে?

আমার বিস্ময় বাড়তে থাকে। আর আমার সুহৃদরা, যারা আমাকে সান্তনা দিতে যেয়ে রাজনৈতিক প্রভাবের কথা বলেছিলেন, তাদের কথা মনে পড়তে থাকে।

বিদিশা: ফ্যাশন ডিজাইনার, লেখক এবং সাবেক সামরিক শাসকের সাবেক স্ত্রী।