বিশ্বজিৎদের বিশ্বটা হেরেই যায়, জিতে যায় ওরা

খোরশেদ মাহমুদ
Published : 10 Nov 2017, 04:01 AM
Updated : 10 Nov 2017, 04:01 AM

এক.

"বিচারহীনতার এই দেশে আমিও বিচার চাই না"- এমন আশাহত বাক্য আমি বহু শুনেছি। কলেজ পড়ার সময় নাম ডাক ওলা এক উকিলের মহুরি থাকা অবস্থায়। কোর্ট পাড়ায়  এমন ক্ষোভ আর অসহায়ত্বের কথা খুব ভাবাত  আমাকে। আজ বিশ্বজিতের হত্যা মামলার আসামির মুক্তির খবর শুনে মনে হল দু'কথা লিখি। কারণ এই লেখার উপাদানের বয়স প্রায় ১৫ বছর তো হবেই। তাই কথাগুলো আর আমার ভেতর জায়গা হচ্ছেনা সে জন্য লিখার চেষ্টা।

মহুরীর কাজ শেষ করে বাসে চরতাম, তার পড় সিএনজি। মাঝে মাঝে লেগুনা করে বাসায় যেতাম। বয়স অল্প থাকায় শ্রোতার মত শুনতাম বিভিন্ন পেশাজিবি বাড়িফেরা মানুষের আলাপ- আলোচনা বাসের ভেতর, কখনো লেগুনাতে বসে। চালের দাম বেশি কেনো? পেয়াজ ঝাঁজ কেনো? আগের দিন আর বর্তমান নিয়ে এক লোক বলেন  "আগে হিন্দু হলে সরকারী চাকরী হত না অনেকের।" আরেক জজন বললেন, 'এখন বাবা মাদ্রাসার শিক্ষক হওয়ার অপরাধে পাস করেও চাকরী হচ্ছে না কারো কারো' (যেমনঃ ৩৪তম বিসিএস পরীক্ষায়)। বাবা, চাচা, মামা এই দল, সেই দল করলে বা বাড়ী বগুড়া-ফেনী (উদাহরণ অর্থে) হলেও নাকি সরকারী চাকরী নেই এখন!! নানা আগোছালো হরেক রকম কথা প্রতিদিন শুনতাম। তখন মহুরি থাকলেও উকিল হওয়ার নেশায় প্রচুর আইন বই পড়তাম। আর ভাবতাম তখন। এসব বৈষম্য বাংলাদেশ সংবিধানের ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী, এবং নৈতিকভাবে গুরুতর অপরাধ! কিন্তু এই দেশে কোন বিচার নেই এসবের। এত মানবাধিকার নেতা-কর্মী আছে, কিন্তু কেউ নেই এসব নিয়ে বলার!

দুই.

রাজধানীর পুরান ঢাকায় বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলায় হাইকোর্টে খালাস পাওয়া তিন জন কারাগার থেকে ছাড়া পেয়েছেন। এটাকে কিভাবে বিশ্লেষণ করা যায় ভাষা নেই আমার। চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকান্ডের বিচার নিয়ে কি নোংরামি না হল এটা আশা করিনি কখনো। মহুরি থাকা অবস্থায় যে কথাটা বাদী পক্ষের লোকজন বলতেন মামলায় হেরে যাবার পর, আমি প্রথমে বলেছিমা কথাটা। এখন হয়তো বিশ্বজিতের পরিবার একই কথা বলবেন। সে অনেক আগের কথা বিশ্বজিৎ হত্যা  মামলার রায় হওয়ার পর  ক্ষুব্ধ-বিস্মিত বিশ্বজিতের ভাই উত্তম দাশ। এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেছিলেন, 'এটা কেমন রায় হলো! এমনটা তো আমরা চাইনি। এটা বিচার না খেলা? আগের আদালত আট জনকে ফাঁসি দিলো। আর এখন দিলো মাত্র দুই জনকে। তাহলে আগের বিচারক কী দেখে রায় দিলেন?' তখনকার সে সসময় শুধু উত্তম দাসেরই প্রতিক্রিয়া নয়, দেশের শুশীল নাগরিকদের সবারই প্রতিক্রিয়া ছিলো।

আর আজকে ছাড়াই পেয়ে গেলো। নিম্ন আদালতের সঙ্গে উচ্চ আদালতের রায়ের পার্থক্য তুলে ধরে দেশের অধিকাংশ মানুষের মতো বিস্ময় প্রকাশ করে উত্তম দাস যথার্থই বলেছিলেন 'দুই রায়ে এত পার্থক্য হয় কিভাবে! এখন দেখি চারজনকে খালাসও দেওয়া হয়েছে। তার মানে এই চারজন জড়িত ছিল না।' সেদিনের সেই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গ টেনে তিনি আরো বলেছিলেন, 'এখানে তো লুকোচুরি করার কিছু নাই। সাক্ষী-প্রমাণ বানানো বা সাজানোও নয়। সব চোখের দেখা, বাস্তবের মতো। ভিডিও ফুটেজ আছে, ছবি আছে। তারপরও দুই রায়ে এত বেশ কম!'

এই কথাগুলো বিভিন্ন পত্রিকার পাতায় আসলেও খুব বেশি কাজে আসেনি। যাদের কানে যাওয়ার ধরকার ছিলো  তারা শুনেনি। সেদিন উওম দাসের কথা। আজ বিশ্বজিত হত্যা মামলার  বরিশালের আগৈলঝাড়ার চেংগুটিয়ার আতিকুর রহমানের ছেলে এএইচএম কিবরিয়া (৩১), মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার রাজৈরের আশেক উদ্দিনের ছেলে গোলাম মোস্তফা (২৬) এবং নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার চন্দনবাড়ির আব্দুল হাইয়ের ছেলে সাইফুল ইসলাম (২৪)। "২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ওই তিনজনসহ এ মামলার পাঁচ আসামিকে এ কারাগারে পাঠানো হয়। এ মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অন্য দুই আসামি নাহিদ ও শাকিল এই কারাগারে রয়েছেন।" এখন দেখার পালা এদের দু'জন কবে বের হচ্ছে।

খবরটা শুনেই আমি মর্মাহত, লজ্জিত, অতৃপ্তভোধ করলাম। এ কেমন রায়? ন্যায়বিচার পাওয়া দেশের প্রতিটি নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু বিশ্বজিতের পরিবার কি ন্যায় বিচার পেলো? যদি না পেয়ে থাকেন, তবে এর জন্য দায়ী কে? আপরাধীরা কি কোনও দিন চিহ্নিত হবে না? শাস্তি ভোগ করবে না? নাকি সুষ্ঠু বিচার না-পাওয়ায় হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে থাকবে ভূক্তভোগীরা। মেয়েকে ধর্ষণের পড় হত্যার বিচার না পেয়ে বাবার আত্মহত্যা এটা কি সমাধান? কোথাও কি বিচার নেই দেশে? না,  বিচার আছে দেশে, ন্যায় বিচার নেই। আগেই আমার ভেতর প্রবল সংশয় ছিলো যে  আইনের ফাঁকফোকরে তারা ছাড় পেয়ে যেতে পারে। শেষ পর্যন্ত সেই আশঙ্কাই সত্য প্রমাণিত। সত্যিই কী আসামিরা সবাই ছাত্রলীগের সদস্য বলে এমনটা হলো? তাহলে 'ন্যায়বিচার' কোথায় থাকলো? কোথায় থাকলো সাংবিধানিক ঘোষণা: আইনের চোখে সকলে সমান? সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বিচারের নামে এই প্রহসনের জবাব কি দেবেন? আমি মনে করি ছত্ররাজনীতি থেকেই ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক নেতৃত্ব এর ভিত্তি স্থাপন হয়।

রাজনীতি জনকল্যাণের জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য। কিন্তু সে ছাত্র রাজনীতির হাতেখড়িদের প্রথম স্টেপ হয় দিবালোকে মানুষ হত্যা করে গণতন্ত্রের কবর রচনা করা। তাই তাদের হাতে ভবিষ্যৎ দেশ নেতৃত্ব কতটা নিরাপদ ভেবে দেখা দরকার। এই হত্যাকাণ্ড দেখে স্তব্ধ হয়েছে গোটা জাতি। হত্যা শুধু বিশ্বজিৎকে করা হয়নি। হত্যা করা হয়েছে এদেশের শুভ বুদ্ধি, বিবেক ও সুস্থ রাজনীতির ধারাকে। জীবন বাঁচাতে বিশ্বজিৎ দাসের কাকুতি-মিনতি সন্ত্রাসীদের মন গলাতে পারেনি। সে সময়ের বিভিন্ন সংবাদপত্রের খবরে প্রকাশ, সন্ত্রাসীদের নিবৃত্ত করা দূরের কথা, মৃতপ্রায় অবস্থায় তাকে হাসপাতালে প্রেরণের মতো মানবিকতাও উপস্থিত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দেখাননি। এ নিয়ে পুলিশ সদর দফতর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করলেও হদিস মেলেনি সেই প্রতিবেদনের। বিশ্বজিৎ দাসকে এক রিকসাচালক মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যান এবং সেখানে তার মৃত্যু হয়। বিশ্বজিতের দুর্ভাগ্য, সে খুন হয়েছে সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ নামধারী কিছু সন্ত্রাসীর হাতে। বিশ্বজিতের পরিবার কোনও দিনই আর ছেলেকে ফিরে পাবে না, সেই শোক ও কষ্ট তাদের সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে। কেবল কান্না, হতাশা আর বিস্ময়! 'বিচারের নামে খেলা'ই দেখে যেতে হবে।

খোরশেদ মাহমুদ
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
ইউনিট ফাইভ, হেমার্স্কাল,
সাউথ আফ্রিকা।