গণশিক্ষায় কেসস্টাডি ‘হৈমন্তি’র অপুরুষ বনাম ‘সমাপ্তি’র পুরুষ

এস এম রেজাউল করিম
Published : 6 August 2010, 03:23 AM
Updated : 6 August 2010, 03:23 AM

একাডেমি নাকি রবীন্দ্রনাথের ভালো লাগতো না, কিন্তু সেই রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের সকল একাডেমিতে খবরদারি করে যাইতেছেন এখন পর্যন্ত। রবীন্দ্রনাথের এই প্রতিশোধস্পৃহা আমার ভালো লাগে, একাডেমির জন্য এইটা মর্যাদাহানির কারণ হইতে পারতো; কিন্তু সেটা যাতে না হইতে পারে সেজন্যই সম্ভবতঃ একাডেমি তাঁরে অমানুষ (দেবতা) করে রেখেছে। ঈশ্বর শ্রীকৃষ্ণের ননী চুরি যেমন চুরি নয়, দেবতার ঐ অধিষ্ঠানও তেমন একাডেমির ইজ্জতে হামলা চালায় না। একাডেমি মারফতে জানা যায়, গুরুদেব ছোটগল্পের সংজ্ঞা দিয়েছেন যে, এই সাহিত্যিক পদার্থ শেষ হইয়াও শেষ হইবে না। গুরুদেব যতদিন মানব ছিলেন ততদিন কিছু মানবিক ভুল করেছেন, 'সমাপ্তি' গল্প এইরকম একটা ভুলের উদাহরণ। একটি মৃম্ময়খণ্ডের 'নারী' হবার গল্প এটি, ঠিক 'নারী' হবার নয়, বরং মৃম্ময়খণ্ড দিয়া 'নারী' গড়ার গল্প, ভাস্কর হইলেন একজন নর। পুরুষ হওয়া আবার নরের ক্যারিয়ার সাফল্য, একজন নর-অপূর্ব এই নারী গড়েন, ঠিকঠাক গড়বার মধ্য দিয়া তাঁর ক্যারিয়ার সাফল্য অর্জন করেন–মানে 'পুরুষ' হন। গল্পটি 'নারী' গড়ার মাধ্যমে একজন নরের পুরুষ হওয়ার আদ্যন্ত বৃত্তান্ত, ফলে 'শেষ হইয়া ঠিক শেষ-ই হইয়া যায়' গল্পটি। এই মানবিক ভুলের কারণে গল্পটি গুরুদেবের নিক্তিতে 'গল্প' হইলো না ঠিক, তবে পুরুষতান্ত্রিক নন্দনতত্ত্বের কারণে গণশিক্ষার বড়ো উপাদান/টেকস্ট/কেসস্টাডি হইয়া পড়লো।

নারী হওয়ার সকল শরীরী যোগ্যতা ছিলো মৃম্ময়খণ্ডটির কিন্তু সংস্কৃতি'র অভাব ছিলো প্রকট। তাঁর প্রধান প্রধান অযোগ্যতা এইগুলো: সে দ্যাখে-"…হরিণশিশুর মতো নির্ভীক কৌতূহলে দাঁড়াইয়া চাহিয়া চাহিয়া দেখিতে থাকে,অবশেষে আপন দলের বালকসঙ্গীদের নিকট ফিরিয়া গিয়া এই নবাগত প্রাণীর আচারব্যবহার সম্বন্ধে বিস্তর বাহুল্য বর্ণনা করে।" ; শুধু দ্যাখে তাই না, অপূর্ব যখন আছাড় খেয়ে পড়ে মৃম্ময়খণ্ডটি তখন "সুমিষ্ট উচ্চকণ্ঠে তরল হাস্যলহরী"-র মাধ্যমে জানান দেয় তাঁর দেখা; "গ্রামের যত ছেলেদের সহিতই ইহার খেলা; সমবয়সী মেয়েদের প্রতি অবজ্ঞার সীমা নাই। শিশুরাজ্যে এই মেয়েটি একটি ছোটোখাটো বর্গির উপদ্রব বলিলেই হয়।", "ঠিক যেন বালকের মতো মুখের ভাব। মস্ত মস্ত দুটি কালো চক্ষুতে না আছে লজ্জা, না আছে ভয়, না আছে হাবভাবলীলার লেশমাত্র।"।

এই অসংস্কৃত মৃম্ময়খণ্ডের বিপরীতে রবীন্দ্রনাথ যে নর অপূর্বকৃষ্ণ সৃষ্টি করেন তাঁর মধ্যে প্রয়োজনীয় অহমসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব দেন রবীন্দ্রনাথ। পতনে লজ্জিত হওয়া এই ব্যক্তিত্ব মাকে বলে, "মেয়ে না দেখিয়া বিবাহ করিতে পারিব না।", এবং পরে, "…মৃন্ময়ীকে ছাড়া আর কাহাকেও বিবাহ করিব না।"। দেখা যাচ্ছে, মৃম্ময়ী অপূর্বর ব্যক্তিত্বে যে আঘাত করেছে, বিবাহ ব্যতিরেকে তার উপশম হবার নয়। অতঃপর বিবাহ হইলো। মৃম্ময়ীও ঘোষণা দিয়েছিলো–"আমি বিবাহ করিব না।", কিন্তু তাঁকে পরাজিত করলেন রবীন্দ্রনাথ। এক ধরনের শাস্তি ছাড়া বিবাহের আর কোনো অর্থময়তা মৃম্ময়ীর কাছে ধরা পড়ে না, সে বেদনাহত হয়।

পতনে বা পরাজয়ে বেদনাহত হওয়া 'আধুনিক' ব্যক্তির লক্ষণ। মৃম্ময়ীর ব্যক্তিসত্তা তখনো প্রবল; অপূর্বকৃষ্ণ তাঁর প্রবল শত্রু। কিন্তু অপূর্বর মাঝে শত্রুতা দেখতে পায় না মৃম্ময়ী, অন্তত শত্রুতা বলে এতোদিন যা চিনে এসেছে, বরং "অপূর্বকৃষ্ণ বিছানার মধ্যে অতি ধীরে ধীরে মৃন্ময়ীর কাছে ঈষৎ অগ্রসর হইয়া তাহাকে কানে কানে মৃদুস্বরে কহিল, "মৃন্ময়ী, তুমি আমাকে ভালোবাস না? "।"

এই দুই ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে বা রবীন্দ্রনাথের কাছে শিখতে শিখতে ক্রমশঃ পুরুষ ও নারী হতে থাকে, অথবা যা হতে থাকে তাকেই পুরুষ ও নারী হওয়া বলে। নর ব্যক্তিসত্তা অপূর্বকে পুরুষ হবার জন্য গুরুদেবের প্রথম নির্দেশ বলপ্রয়োগ না করা, "অপূর্বর বড়ো কঠিন পণ। দস্যুবৃত্তি করিয়া কাড়িয়া লুটিয়া লওয়া সে আত্মাবমাননা মনে করে। সে দেবতার ন্যায় সগৌরবে থাকিয়া স্বেচ্ছানীত উপহার চায়, নিজের হাতে কিছুই তুলিয়া লইবে না।" ব্যক্তি মৃম্ময়ীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধের ক্ষণিক আনন্দের বিপরীতে আছে 'নারী' সৃষ্টির অনাবিল সুখ। অতএব, স্বেচ্ছানীত মৃম্ময়ী লোভে রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে অপূর্ব মৃম্ময়খণ্ড দিয়ে 'নারী' সৃষ্টি করতে বাড়িয়ে দেয় মৈত্রীর হাত। বন্দি মৃম্ময়ীর দ্বার খুলে দেয়, খেলার সাথি বালক রাখালকে এনে দেয়, এই রাখালকে সে ঈর্ষা করে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে তাঁর ক্ষোভ বা ক্রোধ হয় না, কিন্তু ভিতরে খুব লাগে, দুঃখ হয় তাঁর। তবু হাতে মৈত্রীসহ ধৈর্যধারণ করে সে। কিন্তু এসবে কাজ হয় না খুব, তখন রবীন্দ্রনাথ অপূর্বকে বুদ্ধি দেয়; এইবার সে ব্যবহার করে মোক্ষম অস্ত্র–মায়ের অমতে পালিয়ে মৃম্ময়ীকে নিয়ে যায় তাঁর বাবার কাছে, এর প্রতিদানে মৃম্ময়ীকে অপূর্বর হাত ধরতে নির্দেশ দেন গুরুদেব। এরপর অপূর্ব তাঁর 'নারী' সৃষ্টির অগ্রগতি পরখ করে–প্রতিদান হিসাবে মৃম্ময়ীর কাছে "ভালোবাসিয়া একটি চুম্বন" দাবি করে। মৃম্ময়ী চুম্বনের চেষ্টা করতে থাকে, কিন্তু ভালোবাসাহীন ঠাট্টার হাসির কারণে পেরে ওঠে না, অভিমানে অপূর্ব মৃম্ময়ীর ইচ্ছায় মৃম্ময়ীর মায়ের বাড়িতে তাঁকে রেখে কলিকাতা চলে যায়, এই বলে যে, মৃম্ময়ী চিঠি না লিখলে সে আর ফিরবে না। অতঃপর মৃম্ময়ীর আর রাখাল ভালো লাগে না, মায়ের বাড়ি ভালো লাগে না, অপূর্বর ছোঁয়া লেগে থাকা বালিশ ভালো লাগে, তাঁর শ্বাশুরি দেখতে পায়, দস্যি বধুকে "…আর একজন অদৃশ্য সংশোধনকর্তা একটি অজ্ঞাত সংক্ষেপ উপায় অবলম্বন করিয়া মৃন্ময়ীকে যেন নতুন জন্ম পরিগ্রহ করাইয়া দিলেন।", মৃম্ময়ী অনুতপ্ত হয় অপূর্বর প্রতি আচরণের কথা মনে করে, অপূর্বর প্রতি মনে মনে অনুযোগ করে, জোর না করবার জন্য, ঠিকানাবিহীন চিঠি লেখে, কিন্তু অপূর্ব আসে না। ইত্যকার ঘটনান্তে অপূর্বর ভগ্নিপতির কলিকাতার বাড়ির অন্ধকার কক্ষে মৃম্ময়ী নিজ চোখের রসে ভেজা চুম্বনে শোধ দেয় অপূর্বর বকেয়া পাওনা। অপূর্বর 'নারী'সৃষ্টি প্রকল্প সফল করে দেন রবীন্দ্রনাথ, আর এই সাফল্য অর্জনের পর্বে পর্বে অপূর্ব ক্রমে পুরুষ হয়ে ওঠে। শেষ হবার কিছুই বাকি থাকে না আর।

'সমাপ্তি' গল্প গণশিক্ষার প্রয়োজনে 'নারী' গড়বার মধ্য দিয়ে 'পুরুষ' হয়ে ওঠার ব্যাকরণ, এই গাঢ় চিত্রকল্পের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ দেখাইয়া দেন–নারীর কোন হয়ে ওঠা নাই, 'নারী' গড়ে তোলা কর্মময় পুরুষের একটা আবশ্যিক কর্ম, এমনকি পুরুষ হবার শর্ত।

'সমাপ্তি'র অপূর্বকৃষ্ণ এই শর্ত পূরণ করতে পেরেছে, কিন্তু 'হৈমন্তি'র অপু পারে নাই। 'হৈমন্তি'র অপু "ঘরের কাছে ঘরের মানুষকে বলি" দিয়েছে। অপুর শিক্ষা ছিলো কিন্তু পৌরুষের লক্ষণ হিসাবে প্রয়োজনীয় ব্যক্তিত্বের কিছু ঘাটতি ছিলো; অপূর্বকৃষ্ণ মায়ের অমতে মৃম্ময়ীর বাবার কাছে নিয়ে গেছে কিন্তু অপু পরিবারের বিপরীতে হৈমন্তিকে তাঁর বাবার কাছে দিয়ে আসতে পারে নাই। অপুর এই ব্যর্থতার অর্থ হলো–হৈমন্তির 'ব্যক্তিসত্তা' হত্যা করে নারী গড়ার জন্য প্রয়োজনীয় পৌরুষ অপুর নেই, অর্থাৎ হৈমন্তির 'ব্যক্তিসত্তা' বহাল থাকা; শ্বাশুরির সাথে সংঘর্ষ হয় হৈমন্তির, মৃম্ময়ীরও হতো, কিন্তু অপূর্বকৃষ্ণের বিপরীতে অপুর ব্যর্থতা–হৈমন্তিকে মেলাতে পারেনি শ্বাশুরির সাথে, পরিণতি মারাত্মক–হৈমন্তির শরীর আর তাঁর ব্যক্তিসত্তার সংঘর্ষে শরীরকে মরতে হয়েছে। অপূর্বকৃষ্ণের পৌরুষ মৃম্ময়ী'র ব্যক্তিসত্তাকে হত্যা করবার মাধ্যমে যেমন তাঁকে পুরুষ করেছে, তেমনি মৃম্ময়ীর শরীরকে জীবিত রাখতে পেরেছে। রবীন্দ্রনাথ অপূর্বকে দিয়েছেন প্রয়োজনীয় শৈলী আর মৃন্ময়ীকে আত্মবিসর্জনের অসম্ভব ইচ্ছাশক্তি; মৃন্ময়ী রাজী হয়ে উপবিষ্ট মৃন্ময়খণ্ড হয়ে থাকেন আর অপূর্ব কেটেছেঁটে নিজের মানসপ্রতিমা তৈরি করেন। অন্যদিকে, অপুর ব্যর্থতায় হৈমন্তির বিপর্যয়–এই চিত্রকল্প গণশিক্ষার আরেকটি টেক্সট হবার যোগ্যতা দিয়েছে 'হৈমন্তি' গল্পকে, সমাজে অপূর্বকৃষ্ণ না থাকলে কী ঘটতে পারে তার 'কেস স্টাডি' 'হৈমন্তি'। এছাড়া নারীর জন্য বিবাহের আদর্শ বয়স কত–তার কেসস্টাডিও ভাবা যেতে পারে, কেননা বিবাহের সময় হৈমন্তি সতের বছরের যুবতী যেখানে কিনা মৃম্ময়ীর বয়স সম্ভবতঃ বারো/তেরো (মৃম্ময়ীর বয়স বলেন নাই রবীন্দ্রনাথ, তবে বালিকা বলেছেন একস্থানে, আবার বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে বলেছেন। স্মর্তব্য যে, রবীন্দ্রনাথ নিজের মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন দশ/এগারো বছরে।) । এই কেসস্টাডি সফল হবার জন্য অপুর শৈলীর ঘাটতি দরকার ছিলো, রবীন্দ্রনাথ তাই অপুকে দরকারি শৈলী দেননি। কেননা, 'সমাপ্তি'র উল্টা চিত্রকল্প হবার জন্য হৈমন্তির মৃত্যু দরকারি; এই সাহিত্যিক হত্যার দায় মেটান অবশ্য রবীন্দ্রনাথ, সম্ভবতঃ 'হৈমন্তি' গল্প অপুর জবানীতে উত্তমপুরুষে লিখে।