হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা

হাসান হাফিজহাসান হাফিজ
Published : 7 Sept 2011, 04:21 PM
Updated : 29 March 2022, 10:43 AM


আফজাল হোসেনের আঁকা হাসান হাফিজের প্রতিকৃতি

শূন্যতা ও কুহকের ডাক

অতিমারি কার নাম?
বিষের দংশনে ক্রমে বাগান উজাড়
লোকালয় ঢেকে আছে
সরল কাফনে…
অতিমারি, তুমি কী অনতিক্রম্য ভয়
জয় করা সম্ভব কী নয়
চারিদিক সুনসান কোথায় প্রত্যয়?
দৃঢ়তা কোথায়?
বেনোজলে সবই ভেসে যায়
স্বপ্ন শস্য সাজানো সংসার
বাকি নাই আর
নিঃস্বতা গোধূলি একা ত্রস্ত জেগে আছে
অসহায় আত্মসমর্পণ
সুপ্রিয় মোকাম ছাড়ো মন
অনিচ্ছায় চলো যাই শূন্যতার কাছে

সন্ধ্যার বন্দনা
নিশিন্দা পাতার ঘ্রাণ শুঁকতে শুঁকতে
সূর্য নিভতে থাকে
সান্ধ্য আয়োজন শুরু, মিইয়ে আসে পাখিদের
মিহিন কাকলি শব্দ
ঝিঁঝিঁ পোকা সচল সক্রিয় হয়
গাছের কোটর থেকে উঁকি দেয় ল²ীপ্যাঁচা
ফুটতে থাকে তারা একটি দু'টি
গোধূলি মিলিয়ে গেছে অনেক আগেই
ছায়ামন্দ্র অন্ধকার
আঁধারের জান্তব শরীর
বিস্তৃত চাদর হয়ে ঢেকে দিচ্ছে চরাচর
নিশাচর প্রাণীরা সচল

এমন সন্ধ্যার ক্ষণে রুগ্ণ এক বাউলের
একতারা কেঁদে ওঠে
সুরতৃষ্ণা কেঁপে ওঠে
নিভৃতির নিরালায়
অগোছালো জীবনের শান্তি সুধা
করুণ ক্রন্দন হয়ে
চতুর্দিকে সুরভি ছড়ায়।

আপন পর
একটি শব্দের জন্যে
এক জন্ম অপেক্ষা আমার
এক শব্দ এক ধ্যান
এক প্রজ্ঞা একমাত্র ডুবোচর
আমি এক বর্গাচাষী
হাভাতে সময় সামনে পড়ে থাকে
কাঙালের মতো আমি
চেয়ে থাকি ভাবলেশহীন
শূন্যের দিগন্তে ভাসে চোরামেঘ
বিজুলি ঝলকে ওরা
ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলায়
সেই শব্দ 'মোক্ষ' তার নাম…
আত্মধিক্কারের কষ্টে আমার জবান বন্ধ
আমার আপন বলতে ত্রিভুবনে
কেউই নাই, ছিল না কখনও…

শূন্যতার সঘন ঝঙ্কার
কবিতার নিজস্ব পিপাসা নাই, অন্যদের আছে
জীবনের সঘন চুমুক, যৌনতার বুনো ডাক রক্তমাঝে
যৎসামান্য অমরতা পাওয়া যেত যদি
বেশ হতো, চাইলেই কী পাওয়া যায় সব?
কবিতার আপন জিজ্ঞাসা বলে কোনো কিছু নাই
অন্যদের জিজ্ঞাসু করিয়ে ছাড়ে
গোলকধাঁধায় গর্তে ঘুরিয়েও মারে
প্রশ্ন খুঁজে ব্যর্থকাম, জল নেই, শুষ্কতার নিনাদিত
শূন্যতা ঝঙ্কার কিন্তু বিদ্যমান আছে
কতজনা যেতে পারি তার কাছে
পারি না বলেই হয়তো বেঁচে থাকছি অক্ষমের মতো
কিন্তু যা করার ছিল
স্বাভাবিক প্রাপ্যতা যা ছিল
কিচ্ছু তার মেলে নাই
আশঙ্কা প্রবলতর শেষতক কতটুকু পাই
না পেয়েই তৃষ্ণার ঘোরালো শব্দে
সম্মোহিত বুঁদ হয়ে মজে থাকি
এই ঘুম কোনোদিনই ভাঙবার নয়?

সতর্ক সংকেত
শূন্যতা ভরিয়ে দেয় ভালোবাসা
এর জন্যে দরকারি যাবতীয় জরিজুরি
করণকৌশল, ছল, মুসাবিদা
সবই তার আদি অন্ত জানা
যে দেবতা যে ভোগে আনন্দ পান
তাকে সেই ভোগ দিতে জানে ভালোবাসা,
সে কারণে নদী হয় উপমা ও চিত্রকল্প
রাজনৈতিক আশ্রয়েরও ঠাঁইনাড়া (?)
মন্ত্রপূত তাবিজ কবচ
কোমরে ও কণ্ঠদেশে বাহুতে মঞ্জুল হয়ে
কী আশ্চর্য শোভা পায়
দর্শকের স্তুতিও আদায় করে
ভালোবাসা এমন সজীব
এমনই সে অনড় পাথর
ভালোবাসা মানুষেরই সমব্যথী
ওকে তোমরা 'গুম' হতে দিয়ো না দিয়ো না
দিলে কিন্তু তোমরা নিজের জন্যে
ডেকে আনবে বিপর্যয় সমূহ বিপদ…

নদী নয় মানুষের মত অনুদার
নদী জানে,আমি কত নৈঃসঙ্গ্যপীড়িত একা।
মানুষের 'মেল'এ থেকে
আদি অন্ত নির্বান্ধব
নিজেরই ভিতরে পুষি অগ্নিজিভ
সমর্পণ-চুল্লির তীব্রতা।
নদী জানলে ক্ষতি নেই কিছুমাত্র
প্রতারণা শেখেনি সে
সবজান্তা মানুষের মত
মানুষ সংকীর্ণ বলে
খুঁচিয়ে প্রলম্ব করে
ব্যর্থতা ও ক্ষত,
এই দোষ জন্ম থেকে আছে
জানি বলে যেতে চাই না অতি ক্ষুদ্র মানুষের কাছে
তাদের স্বভাবে কালো
পালিয়ে বেঁচেছে আলো
কী দুঃখে দীপিত ওরা
জর্জরিত অবিরত
নদী ছোটো,অন্বিষ্ট সাগর খোঁজো,
যদি পাও ভাগ্য ভালো
পেয়ে গেলে আনন্দিত চক্ষুজোড়া বোজো।