দরজিনগরের ‘কালো’ মানুষ ও আলোকিত অর্থনীতি

হাসান ইমাম
Published : 18 Jan 2012, 03:46 AM
Updated : 28 May 2020, 09:48 AM

দিনে দিনে কত কিছু হয়, কেবল তাদের 'দিন' বদলায় না। উন্নয়নের উল্লম্ফনের সময়েও তাদের দিন কাটে কষ্টেসৃষ্টে, করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারীর দিনগুলোতে তারা আরও দুর্দশাগ্রস্ত; সাথে 'সংক্রমণ ঝুঁকি' ফ্রি! দরজিনগরের শ্রমিকদের জন্যে সকল দরজাই বন্ধ, কেবল দুঃখেরটি খোলা।

সরকারের সিংহদরজা পেরিয়ে তাদের না-মানুষি জীবনের দুঃখগাথা অন্দরমহলে পৌঁছায় না। মালিকদের আলিশান অট্টালিকা আরও সুরক্ষিত, শব্দরোধী—প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে সকল চাওয়া, দাবি-দাওয়া। আর ভীষণ বিবেকি পশ্চিমা ক্রেতা-বায়াররা যতটা না বললে চলে না, মেপে মেপে ততটাই শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে উচ্চকিত হন তারা। সুতরাং দরজায় দরজায় কেবল কড়াঘাতই সাড়া।

পোশাকশ্রমিকরা যেন এই দেশের 'কৃষাঙ্গ জনগোষ্ঠী'! কাগজে-কলমে সাম্য শতভাগ প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু বারোমেসে 'বাস্তবতা'র মধ্য দিয়ে যেতে হয় তাদেরই। যেটুকু না হলে ঠিক মানুষের জীবন যাপন করা যায় না, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তার জন্য (অক্সফামের হিসাবে) মাসে ২৫২ মার্কিন ডলার দরকার হলেও পোশাকশ্রমিকরা পান ৫০ ডলার। বিশ্বের সাত শীর্ষ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশের মধ্যে বাংলাদেশের পোশাকশ্রমিকদের মজুরি সবচেয়ে কম। এই মজুরি পেতেও কত না সাধ্য-সাধনা। বছরের তিনশ পঁয়ষট্টি দিনই কোথাও না কোথাও মজুরির জন্য শ্রমিকরা রাস্তায় নামছেন; এমনকী এই মহামারীর সময়েও। এই দৃশ্য অবশ্য রাষ্ট্রের গা-সওয়া, আমাদের চোখ-সওয়া। একই সংবাদ আর কাঁহাতক গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরা যায়! কাঁড়ি কাঁড়ি ডলারের পণ্যের চালান, ভূরি ভূরি লাভের হিসাব, বায়ারদের সঙ্গে দেনদরবার, নানা সভা-সেমিনার সামলে বিদেশে 'বেগমপাড়া'য় পরিবারের কাছে যাওয়া-আসা—ফুরসত কোথায় মালিক বা সিইওদের এসব দেখার? এক হিসাবে দেখা যায়, বিশ্বের তৈরি পোশাকশিল্পের বড় বড় কারখানার পাঁচজন সিইওর মাত্র চার দিনের সমান আয় করতে বাংলাদেশের একজন নারী পোশাকশ্রমিককে ব্যয় করতে হয় গোটা জীবন। সুতরাং হিসাব মেলার কথা নয়।

অথচ এই ম্লান মানুষদের শ্রমে-ঘামে খুলেছে কত না অসম্ভবের দরজা। রফতানি আয়ের বিপুল-বিশাল দরজা খুলেছে। সেই দরজা দিয়ে আসা আলোয় আলোকিত দেশের অর্থনীতি। ইউরোপ-আমেরিকায় কারখানামালিকদের 'স্থায়ী আবাস' গড়ার দরজাও হাট করে খোলা এরই সুবাদে। অর্থের আধিক্য দিয়েছে তাদের প্রভূত বল-ভরসা; ক্ষমতাবৃত্তের ভেতরে আজ তাদের অটুট অবস্থান। মহামারীর দুঃসময়েও তারা ততটাই সুরক্ষিত, নিরাপদ যতটা থাকেন শীত-গ্রীস্ম-বর্ষায়। একটা-দুটো কারখানায় লে-অফ বা দু-চারটে অর্ডার বাতিলে তাদের দিনলিপিতে কিছুমাত্র পরিবর্তন ঘটে না। বিদেশে সহিসালামত পরিবার, দেশের ব্যবস্থাক্ষেত্র থেকে অব্যাহত অর্থের ধারা।

কিন্তু একটা দিন কাজ নেই তো পেটে টান পড়ে শ্রমিকদের। এমনই এক 'ভারসাম্যপূর্ণ' ব্যবস্থা কায়েম করে রেখেছেন পুঁজির কারবারিরা; ২৫২ ডলারের বিপরীতে ৫০ ডলার। অর্থাৎ যতটা দিলে শ্রমিক মোটামুটি দাঁড়াতে পারেন, কিন্তু দৌড়াতে পারেন না, ঠিক ততটাই মজুরি নির্ধারিত। হিসাব পাক্কা। গাঁইগুঁই করবে তো গলাধাক্কা। কাজ টিকিয়ে রাখার প্রশ্নে তাই ব্যবস্থাগতভাবেই শ্রমিকরা অনন্যোপায়। আর এই 'সুযোগ'টাই সদা-সর্বদা কাজে লাগান ব্যবস্থাপকরা। ফলে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিলেই কেল্লা ফতে, কার্যকর হবে আপনা-আপনিই। কিছু 'ঘাড়ত্যাড়া' শ্রমিক বাগড়া দেওয়ার চেষ্টা যে করবেন না একেবারে, তা নয়। তবে মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত; তাদেরও শেষতক কাজ টিকিয়ে রাখতে গুটিয়ে যেতে হয়।

সুতরাং করোনাভাইরাস প্রতিরোধে যতই সামাজিক দূরত্বের জরুরতের কথা বলা হোক, আজ থেকে কারাখানা বন্ধ, সব ভাগো। নিরুপায় শ্রমিকরা গ্রামের বাড়ির পথ ধরেন। আবার বললেন, কাল থেকে খোলা। পড়িমরি ঢাকামুখী হন তারা। যাত্রাপথের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ, ঝক্কিঝামেলা আমলে না নিলেও চলে। দুর্দশা তো তাদের নিত্যসঙ্গী। কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকিও কি মুখ দেখে নির্ধারিত?

এর কোনো সদুত্তর কারো মুখে শোনা গেল না—না মালিকপক্ষের, না সরকারের। অথচ স্বাস্থ্যবিধি স্বাস্থ্যবিধি বলতে বলতে সবাই মুখে ফেনা তুলে ফেলছেন এবং এই মহামারী সামাল দেওয়ার অংশ হিসেবে সর্বপ্রথম তৈরি পোশাক বা রফতানিমুখী খাতের জন্য সরকারের তরফে প্রণোদনা প্যাকেজের ঘোষণা আসে। এরপরও কলকারখারা ও প্রতিষ্ঠান পরিদপ্তর বলল, শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে কারখানা খোলা রাখা যাবে। তাদের যেন জানা নেই, অধিকাংশ পোশাক কারখানায় শ্রমিকদের কাজ করতে হয় গা-ঘেঁষাঘেঁষি পরিবেশে। বিজেএমইএ, বিকেএমইএ যেভাবে কারখানা খোলা ও বন্ধের প্রশ্নে শ্রমিকদের নিয়ে 'ডিউজ বলের' মতো খেলল, তাতে স্পষ্ট, খেলার 'নিয়ম' তারাই বানায়; অন্য কোনো নিয়মের ধার তারা ধারে না। চোখ যাদের 'মুনাফা'য়, তারা হয়তো কারো মুখ দেখে না!

করোনাভাইরাসের ভয়াবহতায় ত্রাসিত বিশ্বে বাংলাদেশের পোশাকশ্রমিকরাই বা কেন এতটা 'ভয়ডরহীন'? সামাজিক দূরত্বের জরুরত তো তাদেরও অজানা থাকার কথা নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ঝুঁকি নিয়ে তারা কাজে ফিরছেন কেন? এর উত্তর লাখো শ্রমিকের 'অভিন্ন'—কাজ হারানোর ভয়। সম্প্রতি গণমাধ্যমের বহু প্রতিবেদনে ভিন্ন ভিন্ন শ্রমিকের বয়ানে বিষয়টি পরিষ্কার। পোশাক কারখানায় চাকরি যেতে এক মিনিটও লাগে না।

আর তারা যা মজুরি পান, তাতে টেনেটুনে দিন পার করাই দায়; সঞ্চয় করবেন কী? সুতরাং হিসাব পরিষ্কার, ক্ষুধার কাছে আত্মসমর্পণ। কাজ বন্ধ রাখার কোনো পথ নেই তাদের সামনে। তারা না পারছেন হাত পাততে, না তাদের দরজায় দরজায় সহায়তা পৌঁছাচ্ছে। শুধু পাওনা মজুরিটুকুই চাইতে পারেন। কিন্তু এর বিনিময়ে পেতে হয় টিয়ারশেলের অভিবাদন!

দেশের ৮০-৮৫ ভাগ রফতানি আয়ের গর্বে গর্বিত যে শিল্পমালিকরা প্রণোদনা সত্ত্বেও এক মাসও তাদের শ্রমিকদের 'দায়িত্ব' নিতে পারেন না, তারা কি ভাবছেন মহামারীতে একা একা বাঁচা যাবে? সংকট যেহেতু বৈশ্বিক, সমাধানেও থাকতে হবে বৈশ্বিক অ্যাপ্রোচ; যা করার করতে হবে সকলকে সাথে নিয়ে। করোনাভাইরাস কিন্তু উহানে আটকে থাকেনি, বর্ণ ও ধর্ম কোনোটারই তোয়াক্কা করে না মহামারী। তাই এক পক্ষ মরলে আরেক পক্ষ বাঁচবেই, হলফ করে বলা কঠিন।

জীবন নাকি জীবিকা—এই বিতর্কে যারা সব যুক্তি খরচ করছেন, তারা একবারের জন্যও দুটোকে একসাথে ভাবছেন না। অর্থনীতি মেরামতের সুযোগ তখনই পাওয়া যাবে যখন জীবন থাকবে।