অনলাইন সাংবাদিকতা: মান ও পেশাদারিত্ব রক্ষা হচ্ছে কি?

আইরিন সুলতানাআইরিন সুলতানা
Published : 21 Sept 2014, 06:30 AM
Updated : 21 Sept 2014, 06:30 AM

আমাদের দেশে দুই যুগ আগেও এত এত মুদ্রিত পত্রিকা ছিল না। পাঁচ বছর আগেও ছিল না অনলাইন পত্রিকার এতটা চল। বর্তমানে অসংখ্য মুদ্রিত পত্রিকা, সম্পূর্ণ অনলাইন পত্রিকার সঙ্গে সঙ্গে ছাপা পত্রিকাগুলোর অনলাইন সংস্করণও পাঠকের চায়ের টেবিল থেকে ফেসবুক টাইম লাইনে পৌঁছে দিচ্ছে নগরীর আনাচেকানাচের খবর। সর্বাধিক কাটতি ধরে রেখেছে হাতেগোনা কিছু ছাপা পত্রিকা। অনলাইন পত্রিকাগুলোর মধ্যে দু'চারটি নামই মুখ্য। তথাপি অনলাইনের গলিতে প্রতিদিন ছড়িয়ে পড়ছে অসংখ্য অনলাইনভিত্তিক পত্রিকা। এগুলো কোনোটা জেলা খবরভিত্তিক। কোনোটা বিষয়ভিত্তিক। কোনোটা মিশ্র। কোনোটা দেশ থেকে পরিচালিত হচ্ছে। কোনোটা প্রবাসীরা পরিচালনা করছেন। প্রচারণার জন্য সহজপন্থা হিসেবে ফেসবুক পাতা, টুইটার পাতা ব্যবহার করে এসব পত্রিকার লিংক ছড়িয়ে পড়ছে অনলাইন চরাচরে সহজেই।

রাজনৈতিক খবর, আন্তর্জাতিক খবর, তারকা সংবাদ অথবা অপরাধ জগতের খবর- শীর্ষস্থানীয় পত্রিকাগুলোয় জায়গা করে নিতে পারেনি এমন অনেক খবরও পাওয়া যায় অনলাইন পত্রিকাগুলোয়। আশঙ্কার জায়গা হলো, কিছু অনলাইন পত্রিকা কেবল চটকদার শিরোনামই নয়, রীতিমতো রগরগে শিরোনামের খবর প্রকাশ করে একাধারে। পত্রিকাগুলোর ফেসবুক পাতা বা অন্য কোনো উৎস থেকে সংবাদ লিংক ফেসবুকে শেয়ার হলে সেটা এ-হাত সে-হাত হয়ে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিংয়ে বহুবার শেয়ার হতেই থাকে।
প্রসঙ্গটা এসব খবরের সত্যতা নিয়ে। প্রতিবেদনের মান নিয়ে। সংবাদ পরিবেশনে নৈতিকতার দায় নিয়ে। দুই যুগ আগে সংবাদপত্রে ধর্ষণ ঘটনার খবরে নারী ছিল মুখ্য উপজীব্য। ধর্ষিতার বয়স ১৪ হোক আর ২৪, তার একটা পাসপোর্ট সাইজের ছবি খবরের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া ছিল ধর্ষণ খবরের প্রধান ধর্ম। সঙ্গে ধর্ষিতার গ্রামের নাম, ধর্ষিতার পিতার নাম। বিপরীতে ধর্ষকের বিবরণ প্রকাশে ছিল ঔদাসীন্য। এক পর্যায়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হলে ধর্ষিত নারীর ছবি আর অন্যান্য বিবরণ প্রকাশে সংবাদ পত্রিকাগুলো ক্রমান্বয়ে একটা নৈতিক সীমারেখা মেনে চলার চেষ্টা করে। কিন্তু আজকাল অসংখ্য পত্রিকার ভিড়ে সেই পরিমিত বোধের ক্ষয় ঘটেছে। ভিকটিমের নামের সঙ্গে ছবি, বাড়ির পূর্ণ ঠিকানা, বাবার নাম ইত্যাদি তথ্যজুড়ে প্রতিবেদন প্রকাশের চর্চা পুনরায় শুরু হয়েছে।

কিছুদিন আগে দুই তরুণীর মালাবদল নিয়ে একটি প্রতিবেদন আলোচিত হয়। প্রতিবেদনে দুই তরুণীর সমকামিতার কথা লেখা ছিল। সংবাদের লিংক ফেসবুকে শেয়ার হতেই সমকামিতার সামাজিক-ধর্মীয়-রাষ্ট্রীয়-ব্যক্তিক গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে নানা জনে নানা মত প্রকাশে দেরি করেনি। দুই তরুণীর সমকামিতার খবর একাধিক অনলাইন পত্রিকায় পুনরাবৃত্তি হতে থাকে। ফেসবুকে চলতে থাকে লিংক শেয়ার। প্রথম প্রতিবেদনটি প্রকাশ হয়েছিল দুই তরুণীর বড় আকারের ছবিসমেত। অপরাপর অনলাইন পত্রিকাতেও এ খবর ছবিসহ প্রকাশ হচ্ছিল।

দিনকয়েক নানা জল্পনা-কল্পনার পর আলোচনা যখন প্রায় স্তিমিত, তখন অন্য একটি প্রথম সারির অনলাইন পত্রিকা থেকে প্রথমবারের মতো জানা যায়, এ ঘটনার পেছনে মূলত পরিকল্পিতভাবে একটি অপহরণকারী চক্র কাজ করছিল। এক তরুণী অন্য তরুণীকে ফুসলিয়ে নিয়ে আসে। দুই তরুণীকে নিয়ে বড় বড় শিরোনামে যে রগরগে খবর প্রকাশ করেছিল কিছু অর্বাচীন অনলাইন পত্রিকা, শেষ পর্যন্ত তার যবনিকাপাত ঘটিয়ে প্রকৃত ঘটনায় আলোকপাত করল একটি দায়িত্বশীল প্রতিবেদন।

সমকামিতার স্বীকৃতি-অস্বীকৃতি এখন বৈশ্বিক পর্যায়ে বিশ্লেষিত হচ্ছে নানাভাবে। চিকিৎসাবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, ধর্ম, সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় এবং সর্বোপরি আইনগত প্রেক্ষাপট পর্যন্ত এ মত বিস্তৃত। একজন প্রতিবেদক ও পত্রিকা সম্পাদক ব্যক্তিমতের ঊধর্ে্ব উঠে একটি সংবাদকে উপস্থাপন করবেন, এটাই নৈতিকতা। ব্যক্তিগতভাবে প্রতিবেদকের বা পত্রিকা কর্তৃপক্ষের সমকামিতা নিয়ে, সমকামী নারী নিয়ে আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে আর আট-দশজনের মতো ভ্রূকুটি থাকতেই পারে, তবে তরুণীর বয়স বিবেচনা করে ও প্রকৃত ঘটনা যাচাই না করে যেভাবে এ ধরনের সচিত্র সংবাদ প্রকাশিত হলো একাধারে বেশ কয়েকটি অনলাইন পত্রিকায়, তা এলাকায়-পরিবারে-সমাজে এই তরুণীকে হেয় করার পথ উন্মুক্ত করে দেয়। যদি সমকামিতার ঘটনাটি সত্যিই হতো, তথাপি তরুণীর ছবি, বাড়ির পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা, পিতার নাম প্রকাশ কোনোভাবেই পেশাদারিত্বের আওতায় পড়ে না। কারণ এই তরুণীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও সুস্থ ভবিষ্যৎকে ব্যাহত করবে ওইসব প্রতিবেদনগুলো।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, অনলাইনে একটা ওয়েবসাইট খুলে বসার প্রযুক্তিগত সুবিধা পত্রিকাগুলোর দায়িত্বের জায়গাটুকুকে শিথিল করে দিচ্ছে। এ ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশের দায়ে মানহানির মামলা এবং সাংবাদিকতার নৈতিক বিধি লঙ্ঘনের দায়ে ওইসব পত্রিকার বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া আবশ্যক। আমাদের সংবাদমাধ্যমগুলোর আরও নৈতিক পেশাদারিত্ব প্রদর্শন জরুরি। বাংলাদেশ সংবাদ সমিতি, সাংবাদিক ফোরাম, গণমাধ্যম ফোরামগুলো পেশাদারিত্ব, ব্যক্তি ও সামাজিক নৈতিকতাবোধ থেকে সক্রিয় হয়ে একটি সচেতনতা-প্রতিবাদমূলক ক্যাম্পেইন করলে অনলাইনে গজিয়ে ওঠা পত্রিকাগুলো সংবাদচর্চায় মান বজায় রাখতে সচেষ্ট হবে এমনটাই প্রত্যাশা।