ম্যাডাম, ২০ দলের আন্দোলন কোথায়?

আইরিন সুলতানাআইরিন সুলতানা
Published : 4 Feb 2015, 06:10 AM
Updated : 4 Feb 2015, 06:10 AM

রূপক ধার নিতে নাসিরুদ্দিন হোজ্জা তুলনাহীন। হোজ্জা সাহেবের বিড়াল গল্পটি জনশ্রুত হলেও দ্বিরুক্তি করছি। একবার হোজ্জা এক কেজি মাংস কিনে রাঁধুনিকে দিলেন রাঁধতে। সে মাংস এত সুস্বাদু রান্না হচ্ছিল যে রাঁধুনি রাঁধে আর খায়। খায় আর রাঁধে। খেতে খেতে রান্না করা মাংস পুরোটাই সাবাড়। খাবারের টেবিলে রাঁধুনি জানাল, বাড়ির বিড়াল হাঁড়িতে মুখ দিয়ে মাংস খেয়ে ফেলেছে। নাছোড়বান্দা হোজ্জা বিড়ালটাকে পাকড়াও করলেন। পাল্লার এক পাশে চড়িয়ে বাটখারা দিয়ে ওজন মাপতে লাগলেন। মাপে বিড়ালের ওজন এক কেজি হল, যা বিড়ালের প্রকৃত ওজন। হোজ্জা এবার রাঁধুনিকে জেরা করলেন, দাঁড়িপাল্লায় এ যদি বিড়াল হয় তবে মাংস কোথা? নয়তো এ যদি মাংস হয় তো বিড়াল কোথা?

**

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি-জামাত জোট আপন সিদ্ধান্তে নির্বাচন বয়কট করেছিল। নির্বাচন অংশ নেয়া কোনও একটি দলের অধিকারভুক্ত, বিপরীতে নির্বাচনে অংশ না নেয়ার অধিকারও একটি রাজনৈতিক দলের রয়েছে। তবে সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চা কোনটি হওয়া উচিৎ?

আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা প্রায়শই যে কোনও সভা-সমিতিতে কলের গানের মতো উচ্চারণ করতেন – 'ভোট ও ভাতের অধিকার'। ভোটের অধিকার আসলে কী? ভাতের অধিকারই বা কী?

সংবিধান মতে নির্দিষ্ট সময় পর পর জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং জনগণ ব্যালটে ছাপ্পড় মেরে জানিয়ে দেবে কোন দলটিকে তারা রাষ্ট্র পরিচালনার গুরুভার দিতে চায়। ভোট প্রদান জনগণের রাষ্ট্রীয় অধিকার, সে অধিকারের অংশ হল নির্বাচন আয়োজন। যে দলটি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না, তারা নিজ সমর্থকদের ভোট প্রদানে নিরুৎসাহিত করতে সুশৃঙ্খলভাবে নির্বাচনপূর্বে প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারে। গণতন্ত্রের স্বার্থে কোনও রাজনৈতিক দলের সপক্ষে জনমত গড়ে তোলার এই প্রক্রিয়াটিকে সমর্থন করা যেতেই পারে। তবে একজন নাগরিককে ভোট প্রদানে 'জোরপূর্বক' বাধা দেওয়াটা অবশ্যই গণতন্ত্র নয়।

জোরপূর্বক শব্দটাতে সঠিক চিত্র প্রকাশ পেল না বস্তুত। প্রকৃতপক্ষে দেশের রাজধানী থেকে প্রান্তিক পর্যায়ের সকল ভোট কেন্দ্রগুলোতে ভোটারদের আগমণ প্রতিহত করতে তাণ্ডব চলেছিল। হিন্দু সম্প্রদায়কে হত্যা-ধর্ষণ, হুমকি, হিন্দু পল্লীতে অগ্নিসংযোগ, যানবাহনে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে ত্রাস সৃষ্টি করে জনগণকে বাধ্য করা হয়েছিল ভোটকেন্দ্রে গমন থেকে বিরত থাকতে। ভোটকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত স্কুলঘরগুলোকে জ্বালিয়ে দেওয়া কি কোনও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মসূচি হতে পারে?

নির্বাচন পূর্বে বিএনপি-জামাত জোট এমন কোনও জনমত গড়ে তুলতে পারেনি, যার কারণে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট প্রদানে বিরত থেকেছিল বলে মনে করা যেতে পারে। যারা ভোটকেন্দ্রে যায়নি, তারা আত্মরক্ষার্থে যায়নি। এর বাইরে কিছু শিক্ষিত, শহুরে গোষ্ঠী ছিলেন, যারা এলাকায় নিজের 'রাজনৈতিক চিহ্ন' গোপন রাখতে ভোটকেন্দ্র যাওয়া থেকে বিরত থেকেছিলেন।

নির্বাচনে অংশ না নেওয়াটা বিএনপির রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত তো অবশ্যই, সেই সাথে ভোটার অধিকার হরণের মত অগণতান্ত্রিক পন্থাও তারা অবলম্বন করেছিল। তাহলে একটি রাজনৈতিক দল, যাদের ৩৫% থেকে ৪০% সমর্থক গোষ্ঠী রয়েছে বলে ধারণা করা হয়, তারা নাগরিকের ভোটাধিকার নিশ্চিতে ব্যর্থ হয়েছে তা প্রমাণিত। পক্ষান্তরে, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ইতিহাসে নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রথা বিদ্যমান।

ভাতের অধিকার কী? মানুষ অন্তত উপার্জন করে অন্ন সংস্থান করতে পারলে তার মানবিক ও নাগরিক মৌলিক অধিকার ন্যূনতম হলেও পূরণ হয়। এই চিত্রের বৃহত্তর কলেবর হচ্ছে, রাষ্ট্রে উন্নয়নমূলক কর্মাকাণ্ড ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। বঙ্গবন্ধু পরবর্তীতে এ জাতি উন্নয়নকে গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা, কর্মকাণ্ড ও সাফল্য এই প্রথম দেখছে। এই উন্নয়নের কৃতীত্ব সরকার নিলেও, নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার অংশই হচ্ছে এই উন্নয়ন। কিন্তু ২০ দলীয় শিবিরে চোখে নির্বাচন ও উন্নয়নের মতো দুটো নাগরিক অধিকারই চক্ষুশূল হয়ে দেখা দিল।

নির্বাচন পরবর্তীতে ক্রমে ক্রমে বিএনপি মৌখিক হম্বিতম্বিতে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখলেও, আওয়ামী লীগ সরকারের এক বছর পূর্তি অর্থ্যাৎ ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারিকে টার্গেট করে ২০ দলের নাশকতাতন্ত্র আবারো শুরু হয় এবং যা এখন পর্যন্ত চলছেই।

২০ দলীয় জোটের টানা হরতাল-অবরোধের ফলাফল হচ্ছে বার্ন ইউনিটে কন্যার পোড়া দেহ দেখে ক্রন্দনরত স্বজনদের উম্মাদের মত গড়াগড়ি। দগ্ধ মা নিজের যন্ত্রণায় উফ করার সুযোগ পাচ্ছে না। কারণ তার ছোট্ট শিশুর দেহও পুড়ে গেছে; মা-সন্তান ব্যান্ডেজ মোড়া পোড়া শরীর নিয়ে হাসপাতাল বেডে শুয়ে আছে শূন্য চোখে।

ইতিপূর্বে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বার্ন ইউনিটে গিয়েছিলেন। সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের মন্ত্রী-নেতারাও বার্ন ইউনিটে গিয়েছেন। সরকার থেকে কোনও কোনও ক্ষেত্রে চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সরকারি দল থেকে অনেকেই বার্ন ইউনিটে যাওয়ায়, বিএনপি'র প্রতি যখন সকলের দৃষ্টি ছিল, তখন নাম দস্তখতে বিএনপির এক নেতা কিছুক্ষণের জন্য বার্ন ইউনিট ঘুরে আসেন। ব্যস! ওইটুকুই! এর বাইরে ২০ দল দগ্ধ বাসযাত্রীদের জন্য শোকসভা করেনি, মৃতের স্বজনদের সান্ত্বনা দিতে তাদের জড়িয়ে ধরেনি, চিকিৎসা খরচ মেটাতে কোনও অর্থ প্রদান করেনি। যারা পেট্রোল বোমায় মারা গেল সেই সব নাগরিকদের পরিবারের কাছে কোন মুখে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ভোট চাইবে ২০ দল?

জাতীয় নির্বাচনকালীন সময়ে যখন বালুর ট্রাকে খালেদা জিয়ার কথিত গণতন্ত্রকে অবরুদ্ধ করা হল, টক-শোতে কিছু টিনের চশমাধারী বুদ্ধিজীবীরা বললেন, বালুর ট্রাক না থাকলে বেগম জিয়া নিশ্চয়ই বার্ন ইউনিটে যেতেন। বালুর ট্রাক সরে গিয়েছিল। খালেদা জিয়া তারপর ব্যস্ত-ত্রস্ত হয়ে কূটনীতিকদের সাথে দেখা করতে ছুটেছিলেন। ঠিক এই মুহূর্তে বেগম জিয়া অবরুদ্ধ নন। তথাপি তিনি তার বাসস্থানে ফিরছেন না। তিনি অবরুদ্ধ কি অবরুদ্ধ নন, এই নাটকে বেগম জিয়াকে কখনই বার্ন ইউনিটে যাওয়ার ইচ্ছাটুকুও প্রকাশ করতে দেখা যায়নি।

হরতাল-অবরোধের নামে সন্ত্রাসতন্ত্রের দায় নিতে সাফ অস্বীকার করা বিএনপি বারবার জানায়, জনগণ তাদের সাথে আন্দোলন কর্মসূচিতে আছে। কোন জনগণ? আর কোন কর্মসূচী? বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দল কি হরতাল-অবরোধে তাদের প্রতিদিনের কর্মসূচির সুনির্দিষ্ট তালিকা দিতে পারবে?

অন্যদিকে, সরকার যখন পেট্রোল বোমা মারা সন্ত্রাসীদের গুলি করার কথা ঘোষণা করছে, বিএনপি তাৎক্ষণিকভাবে নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। জনতাকে রক্ষার চেয়ে সন্ত্রাসী রক্ষায় ২০ দলের সচেষ্টতায় প্রতীয়মান হয়, বিএনপি'র মূল আন্দোলন কর্মসূচিই হচ্ছে নাগরিক জীবনযাত্রায় পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ। এ যেন তালেবানি হত্যা মিশন, এ যেন আইএস-এর হত্যা মিশন, যেখানে মানুষকে জিম্মি করে মুক্তিপণ হিসেবে ক্ষমতা চাওয়া হয়। এ ধারা অব্যাহত রাখলে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দল যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে তাতে জনগণের দগ্ধ লাশের স্তূপ দেখা যাবে কেবল।

২০ দল বলার চেষ্টা করছে যে, বিড়াল বেশে সরকারই পুরো গণতন্ত্র সাবাড় করে দিয়েছে। কিন্তু ইতিমধ্যে ধরা পড়া সন্ত্রাসীদের পরিচয়ও জানা গেছে। যাদের কেউ বিএনপি কর্মী, কেউ শিবির কর্মী। যেহেতু ২০ দলে জামায়াত রয়েছে, তাই শিবিরের সন্ত্রাসকে আলাদা করার সুযোগ নেই। পোড়া মাংসের গন্ধে ২০ দল এ রূপে মজে গেছে যে, তারা পেট্রোল বোমা মেরে গণ পুড়িয়ে গণতন্ত্র চায়। গণতন্ত্র চায় আর বাসে পেট্রোল বোমা মারে। আন্দোলনের প্রধান পাচক হিসেবে ২০ দলীয় নেত্রীর কাছে তাই প্রশ্ন রাখা- ম্যাডাম, এ যদি ২০ দলের মতে গণতান্ত্রিক আন্দোলন হয় তো সন্ত্রাস কোথা? আর এ যদি জনগণের মতে সন্ত্রাস হয় তো ২০ দলের ঘোষিত আন্দোলন কোথা?

——-