রুবেল-হ্যাপী: বিসিবির শৃঙ্খলা ও ক্রিকেটভক্ত মনস্তত্ত্ব

আইরিন সুলতানাআইরিন সুলতানা
Published : 21 March 2015, 07:04 AM
Updated : 21 March 2015, 07:04 AM

শঙ্কাটা পূর্বেই করেছিলাম। 'রুবেলকে আমাদের দরকার' বলে বিসিবি বগলদাবা করে বিশ্বকাপ আসরে নিয়ে গেল। রুবেল ভাল খেলবে আর উল্লাসে রুবেল-রুবেল রবে ফেটে পড়বে গোটা জাতি। আর ততোবার হ্যাপীকে নষ্টা মেয়ে বানিয়ে ছাড়বে জয়ের আনন্দে জ্ঞানহারা ক্রিকেটভক্তরা। তারা তো হ্যাপীর চরিত্র নিয়ে অনুসন্ধানও মনে হয় করছেন আর বলছেন জাতীয় বীর রুবেলের কোনও 'দোষ' ছিল না।

মানুষের মনোজগতে ধর্ষণ, নারী, আইন নিয়ে বিচিত্র 'রাজনীতি' ঘুরপাক খায়। আইনি অধিকার, মিডিয়ার আচরণ নিয়ে ইতিপূর্বে বাংলা ট্রিবিউনের কলামে লিখেছিলাম 'রুবেল-হ্যাপী যৌন প্রতারণা মামলা: ধর্ষণ, মিডিয়া, আইন ও বিসিবি'। এর পরবর্তী ধাপ হিসেবে এ লেখার কারণ বিসিবি ও ক্রিকেটভক্তরা যে প্রভাব ও খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা লিপিবদ্ধ ও এর প্রতিবাদ করা জরুরি।

কেসস্টাডি: জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন মামলা
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ তখন উইকিলিকস হিরো। বিশ্ব রাজনীতির মুখোশ খুলে দিচ্ছেন। তার বিরুদ্ধে উঠল ধর্ষণ অভিযোগ। জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ নিজে তা স্বীকার তো করলেনই না, এই বঙ্গদেশের অ্যাসাঞ্জ ভক্তরাও তার পক্ষে মুখর হয়ে বলেছিলেন, এ আমেরিকার ষড়যন্ত্র! যদিও ধর্ষণ মামলাটির এখনও নিস্পত্তি হয়নি। তবে মামলার প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে এই বঙ্গসমাজ অন্তত বুঝতে সক্ষম হবেন, শুধু নির্যাতন ও নারীর অসম্মতিতে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করাটাই ধর্ষণ নয়। উন্নত বিশ্বে যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে এমনকি নারীর 'মানসিক' ও 'শারীরিক' সুরক্ষার অপরাপর দিকগুলোকেও গণ্য করা হয়।

দ্য টেলিগ্রাফের একটি প্রতিবেদনে তারিখক্রমে ২০১০ সালের আগস্ট মাসে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ও অভিযোগকারী অপর দুই নারীর মধ্যকার পরিচয়পর্বের বিবরণ প্রকাশ করা হয়েছিল। সেই সূত্রমতে, মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে দুই নারীর সাথে সম্পর্কিত হন অ্যাসাঞ্জ। বলে রাখা ভাল, এই নারীরা 'স্বেচ্ছায়' জুলিয়ানের সংস্পর্শে এসেছিলেন। প্রথম নারীর অভিযোগের বিশেষ কারণ ছিল, যৌন সম্পর্কে জুলিয়ান যৌনসুরক্ষা নিশ্চিত করেননি। দ্বিতীয় নারীর ক্ষেত্রেও একই অভিযোগ ছিল, যেখানে এও বলা ছিল, তার ঘুমন্ত অবস্থাতেও জুলিয়ান অরক্ষিত যৌনক্রিয়া করেন। ফলাফল, ধর্ষণ ও বেআইনিভাবে যৌনসম্পর্কের কারণে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে সুইডেন আদালতে মামলা। প্রাথমিকভাবে মামলাটি বাতিল হয়ে যাওয়ার পর পুনরায় উত্থাপিত হয়। ওই সময় পাবলিক প্রসিকিউশন পরিচালক ম্যারিয়েনে (Marianne Ny) খুব স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন, বিশ্বাস করার মতো কারণ অবশ্যই আছে যে, অপরাধ সংগঠিত হয়েছিল। বর্তমানে প্রাপ্ত তথ্যাদি বিবেচনা করে আমার রায়ে এই অপরাধের প্রকার হচ্ছে ধর্ষণ।

কেসস্টাডি: ধর্ষণ মামলা নিয়েও রুবেলের জামিন
মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত রুবেলকে কারাগারে প্রেরণ করলে বিসিবি আইনের ফাঁক গলে রুবেলকে ছাড়িয়ে আনতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। এর ধারাবাহিকতায় আকরাম খান কারাগারে রুবেলকে দেখতে গিয়ে আশ্বস্ত করে আসেন। জানিয়ে আসেন, তিনি রুবেলের 'পক্ষে' আছেন এবং সবরকম চেষ্টাই হচ্ছে তাকে ছাড়াতে। এরপর দায়রা জজ আদালতে জামিনপ্রাপ্ত হন রুবেল।

ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জয় ও রুবেলের বোলিং জাদুতে নারী-পুরুষ যখন মাতোয়ারা তখন বিসিবি নিজেদের কৃতিত্ব জাহিরে আগ্রহী হলেন। ১০ মার্চ প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিবেদনে আইসিসি সভাপতি ও পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের বক্তব্য উল্লেখ রয়েছে। তিনি বলেছেন, 'প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে রুবেলের জন্য আইনি লড়াই করে তাকে বিশ্বকাপে পাঠিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী ও আইন মন্ত্রণালয়ের দিক-নির্দেশনায় আইনি লড়াই করেই তাকে বিশ্বকাপে পাঠাতে আমরা সক্ষম হয়েছি।'

এই বক্তব্য প্রধানমন্ত্রী ও আইন মন্ত্রণালয়ের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ণ করতে যথেষ্ট। উপরন্তু এও প্রমাণ হয়, যেখানে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ আইনে অভিযোগকারীর হয়ে সরকার পক্ষের ‍উকিল লড়ে থাকেন, যেখানে সরকার পক্ষ লড়ছে অভিযুক্তের পক্ষে। রুবেলের হয়ে 'হাইকমান্ড' যে মামলায় জড়িত, সে মামলা আপনগতিতে কীভাবে চলতে সক্ষম হয়? মুস্তফা কামালের বক্তব্য সুস্পষ্টভাবে 'প্রভাব' ও 'ক্ষমতা' দেখিয়ে আইনি গতিতে বাধা দেওয়ার ইঙ্গিত দেয়।

কেসস্টাডি: বিসিবির শৃঙ্খলাবোধে দ্বৈততা
সাকিব আল হাসান স্টেডিয়ামে কিছু দর্শকের সাথে মারপিট করেছিলেন, যারা সম্ভবত তার স্ত্রীকে নিয়ে কটূক্তি করেছিল। ইভটিজিংয়ের সেই মামলাটির কী গতি হলো আজও জানা যায়নি। বিসিবির শৃঙ্খলাভঙ্গের রীতি মোতাবেক সাকিব আল হাসানের আচরণের প্রেক্ষিতে তাকে দেশি-বিদেশি ম্যাচ হতে সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ রাখা হয়। দেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাকিব আল হাসানের প্রয়োজনীয়তা তখনও তুঙ্গে ছিল। তবুও বিসিবি 'রুল ইজ রুল' নীতিতে অটল ছিল। তাহলে রুবেলের ক্ষেত্রে বিসিবি ব্যতিক্রম কেন?

ক্রিকেটার আল আমিনকে দ্রুতই দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে, বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ ছিনিয়ে নিয়ে। বিসিবির অভিযোগ আল আমিন শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন রাত দশটার পর হোটেলের বাইরে অবস্থান করে। দলের ম্যানেজার খালেদ মাহমুদ সুজন শৃঙ্খলাভঙ্গের কথা জানালেও আল আমিনের বিরুদ্ধে কোনও দুর্নীতির সাথে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়নি তা উল্লেখ করেন। বিসিবি কি মনে করে যে, ১১টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলা আল আমিনকে আমাদের ততটা দরকার নেই যতটা রুবেলকে দরকার?

শ্রীলঙ্কার সাথে ম্যাচ হারার পর খেলোয়াড়দের সাথে মিলে স্ট্র্যাটেজি ঠিক করাটাই স্বাভাবিক ছিল। আর নীতিমালা অনুযায়ী রাত ১০টার পর হোটেলেই অবস্থান করা উচিত। যে খালেদ মাহমুদ সুজন ক্রিকেটার আল আমিনের জন্য বিসিবির নীতিমালার ঝাঁপি খুলে বসেছিলেন, সেই তিনি ম্যাচ হেরে মধ্যরাতের পর অবস্থান করেছিলেন ক্যাসিনোতে। হয়ত জুয়াও খেলেছিলেন বা খেলেননি। কিন্তু রাত দশটার পর বাইরে অবস্থান করে নীতিমালা ভঙ্গের অনুমতি তাকে কে দিলেন? আল আমিনের জন্য যে নিয়ম প্রযোজ্য খালেদ মাহমুদ সুজনের জন্য সেই নিয়ম কোথায়?

প্রশ্ন হলো, ধর্ষণ অভিযোগে যার বিরুদ্ধে মামলা আছে তার জন্য বিসিবির কোনও নীতিমালা নেই কেন? ভাবতে অবাক লাগে, বিশ্বকাপ জেতার জন্য যৌন প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডকে 'ব্যক্তিগত বিষয়' বলে বিসিবি পুরো তরুণ প্রজন্মকে অনৈতিক শিক্ষায় কীভাবে উদ্বুদ্ধ করছে?

কেসস্টাডি: মামলায় দোষ প্রমাণিত না হওয়া অবদি রুবেল খেলতে পারেন নাকি পারেন না?
ভারতের পত্রিকা তেহেলকা এর সম্পাদক তেজপালের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন ও যৌন হয়রানির অভিযোগ উত্থাপিত হলে প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি অস্বীকার করেছিলেন। তবে তিনি সাময়িককালের জন্য পদত্যাগও করেছিলেন পত্রিকা থেকে। ২০১৩ সালে আটক হওয়ার পর আদালত ধারাবাহিকভাবে তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে। তবে তেজপালের মায়ের মৃত্যুর পর সুপ্রিম কোর্ট তাকে অন্তর্বতীকালীন জামিন প্রদান করেন এই শর্তে যে, আলামত নষ্ট করা ও সাক্ষীদের প্রভাবিত করার প্রচেষ্টা করা যাবে না।

প্রখ্যাত মার্কিন কৌতুক অভিনেতা বিল কসবির বিরুদ্ধে একের পর এক যৌন অসদাচরণের অভিযোগ উত্থাপিত হলেও অভিযোগগুলো অধিক পুরাতন হওয়ায় আইনি প্রমাণ হয়ত সম্ভব হবে না। তবে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩২ বছর জড়িত ছিলেন তিনি সেই টেম্পল ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ড থেকে পদত্যাগ করেন যৌন অসদাচরণের অভিযোগগুলো উত্থাপিত হওয়ার প্রেক্ষিতেই। একইভাবে ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস থেকেও তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক কর্মকর্তা রাজেন্দ্র পাচৌরির বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত শুধু মানসিকভাবে যৌন হয়রানির (ই-মেইল, এসএমএস, ফোনে যৌন হয়রানি) অভিযোগ রয়েছে। ২০০৭ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত পাচৌরি সব অভিযোগ অস্বীকার করলেও তাকে জাতিসংঘের আইপিসিসি থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছে।

যারা উচ্চবাচ্য করেন, অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া অবদি রুবেলেকে খেলতে দেওয়া উচিত, তাদের জন্য এরকম অসংখ্য উদাহরণ তুলে আনা যাবে। বিসিবির মতো প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা রক্ষায় তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্তিকর বার্তা না প্রদানে এবং আইনকে প্রভাবিত না করার জন্য উপরের দৃষ্টান্তগুলো অনুসরণ করা উচিত।

কেসস্টাডি: হ্যাপীর উকিল
হ্যাপীর আইনজীবী কুমার দেবুল দে সম্প্রতি নাটকীয়ভাবে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে রুবেলের বিরুদ্ধে মামলা থেকে নিজেকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। তিনি জানান, 'বাংলাদেশের এহেন সফলতায় রুবেলের বিপক্ষে মামলায় লড়ার আমার আর ইচ্ছে নেই। … রুবেল চাপমুক্ত থাকুক। তাকে চাপমুক্ত রাখতেই আমার এ সিদ্ধান্ত।' একজন পেশাদার আইনজীবী ফেসবুকে মামলা সংক্রান্ত স্ট্যাটাস দিয়ে 'পাবলিক ফিগার' হওয়ার বাসনায় নিজে তো আইনি আচরণ মানেননি উপরন্তু তিনি মামলাটিকে প্রভাবিত করার দৃশ্যমান চেষ্টা করেছেন।

আইজীবী কুমার দেবুল দের স্ট্যাটাস আমার প্রাথমিক শঙ্কাটিকে পুনরায় সত্যে পরিণত করে। এ ধরনের কাজে তরুণ প্রজন্ম বিভ্রান্ত হবে এবং মামলাটি সরাসরি প্রভাবিত হবে। আগামীতে কোনও আইনজীবী এভাবে ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে মামলার আপডেট যেন না দেন এ ব্যাপারে আদালতের নেক নজর প্রত্যাশা করি।

বস্তুত হ্যাপীর দায়েরকৃত মামলায় তার নিয়োগকৃত উকিল কখনোই সক্রিয় ছিলেন না। এর নানাবিধ কারণ থাকতে পারে। বিসিবির 'অতিসক্রিয়তা' হ্যাপীর অজান্তে তার আইজীবীদের নিস্ক্রিয় করতে সচেষ্ট হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকে না। হ্যাপীর আবেদনকৃত রিট খারিজ হলে তা সংবাদ শিরোনাম হয়েছিল। কিন্তু কেন উক্ত রিট খারিজ হয়েছিল তা আলোচনার বাইরে থেকে যায়। মূলত ওই রিট শুনানিতে হ্যাপীর আইনজীবী মো. ইউনুস আলী আকন্দর তিন দফা অনুপস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত বিচারক রিট খারিজ করে দেন।

আইন অনুযায়ী সরকার পক্ষের উকিল আক্রান্ত বা অভিযোগকারীর পক্ষে মামলা পরিচালনা করবেন। হ্যাপীর ক্ষেত্রে কেন সরকার পক্ষের উকিল কাজ করেননি সেটাও একটা প্রশ্ন। হতে পারে, এটা হ্যাপীর অজ্ঞতা। আবার হতে পারে বিসিবির ক্ষমতার প্রভাব!

কেসস্টাডি: হ্যাপীর ও রুবেলের ডিএনএ টেস্ট
ডা. নুজহাত আন্দালিব স্বাক্ষরিত ডিএনএ রিপোর্টে লেখা ছিল 'ভিকটিম হ্যাজ নট ফাউন্ড রিসেন্টলি ফোর্সফুলি সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স'। এরপর থেকেই হ্যাপীর ডিএনএ টেস্ট রিপোর্ট নিয়ে পত্রিকায় বারবার শিরোনাম করা হয়, 'হ্যাপীকে জোর করেননি রুবেল'। এই রিপোর্টের বরাতে ক্রিকেট ফ্যানরা বলছেন, যেহেতু জোর করা হয়নি, তাই হ্যাপীর দায়েরকৃত ধর্ষণ মামলার আইনগত কোনও ভিত্তিই নেই আর।

বস্তুত ধর্ষণ বলতে আমাদের মানসপটে একটা 'ধস্তাধস্তিমূলক' দৃশ্য ফুটে ওঠে। আইনি অধিকার নিয়ে সামাজিক প্রচারণার পর্যাপ্ত অভাব থাকায় আমরা জানি না যে, আমাদের মতো দেশেও ব্যক্তির (নারীর) মানবিক অধিকারবোধ নিশ্চিন্তে প্রগতিশীল চিন্তাধারার কোনও আইন কার্যকর থাকতে পারে।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ (২০০৩ এর সংশোধনীসহ) এর ৯(১ ) ধারা অথবা বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩৭৫ নং ধারাগুলো খুব স্পষ্ট করে প্রতারণামূলকভাবে 'সম্মতি' আদায় করে যৌনসম্পর্ক স্থাপনকে 'ধর্ষণ' আখ্যায়িত করেছে। এই আইনি ধারা থেকেই বোঝা যায়, এখানে জোরপূর্বক, নির্যাতকপূর্বক কোনও আলামত নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়।

আক্রান্ত (ভিকটিম) নারীর ডিএনএ বা মেডিকেল পরীক্ষা দ্রুত সম্পন্ন করাটা জরুরি বিধায় হ্যাপীর ডিএনএ টেস্টের সিদ্ধান্তটি সাহসী ও সঠিক ছিল। কিন্তু রুবেলের ডিএনএ টেস্টে বিলম্বের কারণ কী? গত ৩১ ‍ডিসেম্বর ঢাকার একটি আদালত রুবেল হোসেনের ডিএনএ পরীক্ষার অনুমতি দেওয়ার পর রুবেল ডিএনএ পরীক্ষা সম্পন্ন না করেই কেন বিশ্বকাপ আসরে উড়াল দিলেন?

কেসস্টাডি: হ্যাপীর চরিত্র হনন অথবা মানহানির মামলা
নারীর চরিত্র হননে বঙ্গসমাজ অতি উৎসাহী থাকে বরাবর। হ্যাপীকে যতবার ক্রিকেট ফ্যানরা পতিতা, নষ্টা মেয়ে উল্লেখ করেছে তা গুনে শেষ করা সম্ভব নয়। অনেক নারী রুবেলের বিরুদ্ধে করা মামলাটি পরিচালিত হোক তা চাইছেন। তবে সমাজে নিজের 'সতি' চরিত্র সংরক্ষণে 'সেইফ সাইড' মন্তব্য জুড়ে দিচ্ছেন, 'দোষ হ্যাপীরও ছিল বটে'!

আচমকা আমাদের সমাজ সৌদি সমাজের লেবাস ধারণ করেছে। ফেসবুকে একটি ভিডিও পোস্টে দেখা যাচ্ছে, একজন ম্যাজিস্ট্রেট প্রেমের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে পার্কে অবস্থানরত যুগলদের গণহারে আটক করছেন, ধমকে দিচ্ছেন! যেন এ সমাজে প্রেম করা নিষিদ্ধ।

প্রেমের সম্পর্ক দুজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত বিশ্বাসকে উপজীব্য করে সামাজিক পরিণতি পায়। আমাদের পক্ষে কারও বিশ্বাসযুক্ত সম্পর্কের গভীরতাকে নিয়ন্ত্রণ করার দৃশ্যত সুযোগ নেই। আবেগের বশবর্তী হয়ে কারও ব্যক্তিগত অনিয়ন্ত্রণ মানে সে নষ্টা-ভ্রষ্টা-চরিত্রহীনা-পতিতা নয়। প্রতারণার মাধ্যমে সম্পর্ক গঠিত হলে যদি একপক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে বাংলাদেশের আইন আক্রান্তকে অভিযোগ দায়ের করার অধিকার দেয়।

অন্য একপক্ষ আছেন, যারা নারীর অধিকার নিয়ে অনেক উদার ধ্যানধারণায় বিশ্বাসী। এর বিশ্বাস করেন নারী তার যৌন সম্পর্ক গড়ার অধিকার রাখেন। এটা খুবই সত্যি কথা। তবে এই পক্ষ সমাজের রক্ষণশীল ঘরানার মানুষদের চেয়েও কখনও কখনও ক্ষতিকারক। কারণ, এদের অনেকেই 'নারী হিসেবে হ্যাপীর যৌন সম্পর্ক গড়ার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে' এইসব ধর্ষণজাতীয় অভিযোগ দায়েরের চর্চা থেকে বেরিয়ে আসতে বলেন! এইসব নারীবাদী পুরুষদের জানা দরকার, অবাধ যৌনচর্চা পশ্চিমা কিংবা ইউরোপিয়ান দেশগুলোতে কিন্তু ধর্ষণ অভিযোগ, ধর্ষণ আইন কোনওটাই বিলুপ্ত নয়।

বর্তমান আইনে অভিযুক্তকেই প্রমাণ করতে হয় যে, সে নির্দোষ। কিন্তু রুবেলের পক্ষ থেকে মামলাটিকে আদালত প্রাঙ্গনে মুখোমুখি হওয়ায় বিসিবির তত্ত্বাবধানে মামলাটিকে অকার্যকর করার নানাবিধ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। বর্তমানে হ্যাপী নিজেই আর মামলা চালনায় আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। তাই অনেক ক্রিকেট ফ্যান আবার দাবি করছেন, রুবেল বরং মানহানির মামলা করতে পারেন। আসলেই কি তাই?

ক্রিকেটার রুবেল শুরু থেকেই হ্যাপীর সাথে সম্পর্কে বিষয়টি একেবারেই অস্বীকার করেছেন। রুবেল এও বলতে চেয়েছেন হ্যাপী খারাপ মেয়ে এবং কোনও একটি চক্রের ষড়যন্ত্রে রুবেলকে ফাঁসানো হচ্ছে। এই প্রতিটি অভিযোগের প্রেক্ষিতে রুবেল কোনও প্রমাণ পেশ করেননি। সুতরাং হ্যাপীর চরিত্রহননে ভূমিকা রাখায় মানহানির মামলা বরং রুবেলের বিরুদ্ধে হওয়ারই সুযোগ রয়েছে।

বিভিন্ন মানহীন অনলাইন পত্রিকায় হ্যাপীর ডিএনএ টেস্ট নিয়ে চরিত্র হননকারী সংবাদ ছেপেছিল। হ্যাপীর ডিএনএ টেস্টে ১২ পুরুষের সাথে যৌনসম্পর্কের কথা কি ডা. নুজহাত আন্দালিব স্বাক্ষরিত ডিএনএ রিপোর্টে লেখা ছিল? প্রথম সারির কোনও পত্রিকায় এরকম কোনও তথ্য এখনও নজরে আসেনি। তাহলে ওইসব নিম্নমানের পত্রিকাগুলোর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করাটাই সমুচিত কাজ হবে।

কেসস্টাডি: হ্যাপীর হিজাব
শিক্ষিত শ্রেণির অনেককেই দেখেছি হ্যাপীর মাথার স্কার্ফকে হিজাব চিহ্নিত করে হিজাবি নারীর সিনেমায় আগমন কিংবা রুবেলের সাথে শারীরিক সম্পর্ক জড়ানো নিয়ে কদর্য পর্যায়ের মন্তব্য করছেন। হলিউড, বলিউডের নায়িকারা পাবলিক প্লেসে গেলে বিশেষত যেখানে তারা ফ্যানদের এড়াতে চান, মাথায় স্কার্ফ পরেন, বড় সানগ্লাস পরেন। বড় সানগ্লাস পরা, উঁচু কলারের শার্ট পরার কাজটি সিনেমার নায়কদেরও করতে দেখা যায়, ফ্যানদের চোখে ফাঁকি দিতে। এমনকি আমাদের বাংলা সিনেমার পুরনো দিনের নায়িকারাও বহুবার সাক্ষাৎকারে বলেছেন, শপিং মলে, সিনেমা হলে ভিড় এড়াতে তারা বোরকা পড়ে যাতায়াত করেছেন। মিডিয়া জগতের হ্যাপীও সেরকমই মাথায় স্কার্ফ জড়িয়ে আদালতে গেছেন। এর অপব্যাখ্যা যারা করেন তাদের মানসিক সুস্থতা প্রত্যাশা করি।

হ্যাপী তার আপন জগতে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকলে, সে সিদ্ধান্তকে স্বাগত। যেমন করে স্বাগত জানানো যায় তার দায়েরকৃত মামলাটিকেও। তবে মামলাটিকে নিস্ক্রিয় করা চাপ ও প্রভাবের যে সব দৃষ্টান্ত দেখা গেছে তা খুবই দুঃখজনক। তেহলেকার সম্পাদক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব তেজপাল বহুবার আবেদনের পর সাক্ষী ও আলামত নষ্ট না করার শর্ত সাপেক্ষে জামিনপ্রাপ্ত হন। কিন্তু আমাদের দেশে বিনা শর্তে রুবেল জামিন পেয়ে যান। ক্রিকেটারের জন্য আইন প্রযোজ্য নয়, এমন বার্তাই কি বিসিবি, রাষ্ট্রপক্ষ দিতে চাচ্ছেন ক্রিকেটভক্তদের?

***