ইজতেমা ও তুরাগ নদ

আইরিন সুলতানাআইরিন সুলতানা
Published : 20 Jan 2016, 06:15 PM
Updated : 20 Jan 2016, 06:15 PM
সূরা আল আম্বিয়ায় প্রাণ সৃষ্টির উৎস হিসেবে উলি্লখিত হয়েছে পানি। অপচয় না করা এবং পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখাও হচ্ছে ধর্মীয় আনুগত্যপূর্ণ আচরণ। সুতরাং পানির অপচয় না করাও ধর্মীয় দায়িত্ব। পানির অন্যতম প্রাকৃতিক আধার হলো নদী। নদী পরিষ্কার রাখা নদী বাঁচাও আন্দোলনেরই অংশ। ধর্মীয় আচরণের অংশ হিসেবে নদী পরিষ্কার রাখা একজন ইমানদার ব্যক্তির কাছেও পবিত্রতুল্য। প্রায় ৫০ বছর ধরে টঙ্গীতে তুরাগপাড়ে ইজতেমা হয়ে আসছে। প্রতি বছর দেশ-বিদেশ থেকে ধর্মানুরাগী মুসলমানদের পদচারণায় তুরাগপাড় মুখরিত থাকে। ইজতেমার মূল পর্বের প্রস্তুতিতে সহযোগিতাপ্রাপ্তির একটা অংশ স্বেচ্ছাসেবা। ইজতেমাকে ঘিরে এই ধর্মীয় অনুরাগ অন্যতম নিদর্শন। তবে স্বেচ্ছাসেবা ছাড়াও অভিজ্ঞ প্রশাসনিক সহযোগিতা ও তদারক করা হয় এসব নির্মাণকাজ ও ব্যবস্থাপনায়।
সার্বিক ব্যবস্থাপনায় বয়ানের মঞ্চ, আবাসনের খিত্তা নির্মাণ ছাড়াও পানি ও শৌচাগার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হয়। পত্রিকা সূত্রমতে, স্থানীয় ১২টি নলকূপ থেকে প্রতিদিন ৬৭ লাখ ২০ হাজার লিটার পানি সরবরাহ করা সম্ভব হয়। পান করা, ওজু, গোসল ও শৌচকার্যের জন্য এই পানি ব্যবহৃত হয়। ইজতেমাকে ঘিরে তুরাগের ওপর ও আশপাশে নির্মাণ কার্যের অনেকাংশ অস্থায়ী বলে প্রতি বছর এ ধরনের প্রস্তুতি চলে বড় আকারে। যেমন, নতুন শৌচাগার নির্মাণ অথবা পুরনো দুই তলা শৌচাগারগুলোকে তিনতলা শৌচাগার করা। যাতায়াত সুবিধার জন্য প্রতি বছর বিভিন্ন প্রবেশমুখে ভাসমান সেতুর ব্যবস্থাও করা হয় তুরাগের ওপর।
এই যে তুরাগের ওপর ও চতুর্দিকে এত আয়োজন ও জনসমাগম, সেই তুরাগ কেমন আছে? গত ডিসেম্বরে তুরাগতীরে পরিবেশবাদীদের ৭১ কিলোমিটার মানববন্ধন কি তুরাগকে রক্ষা করতে পেরেছে দূষণ ও দখল থেকে? শিল্পবর্জ্যের দূষণে তুরাগ ভারাক্রান্ত। কেউ কেউ তুরাগকে মৃতপ্রায় বলেন। ইজতেমাকালে যদিও সার্বিক পরিচ্ছন্নতা ব্যবস্থাপনা গৃহীত হয়, তবু লাখো মানুষের ভিড়ে হাজারো মানুষের অসচেতনতাতেও তুরাগ কোনো না কোনোভাবে দূষিত হচ্ছে।
ইজতেমার প্রাথমিক কাজ প্রস্তুতি পর্বে অনলাইন পত্রিকা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেল, ইজতেমা প্রাঙ্গণ থেকে জড়ো করা আবর্জনা তুরাগপাড়ে ফেলছে কিছু কিশোর। যে আয়োজনে লাখো মানুষের জমায়েত, সেখানে অনিচ্ছাকৃত হলেও ঘটে যেতে পারে অসচেতনমূলক আচরণ। এটি তেমনি একটি প্রতিচ্ছবি।
ইজতেমাকে দুই পর্বে আয়োজন করা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। এতে নিরাপত্তা, যানজট ব্যবস্থাপনা যেমন আয়ত্তের মধ্যে আনা সম্ভব, তেমনি তুরাগের পরিবেশের যে ধারণক্ষমতা তার ওপর থেকে চাপ কমানো সম্ভব।
নগর পরিকল্পনাবিদরা হাতিরঝিল প্রকল্প নিয়ে গর্ব করেন। তুরাগপাড়ে বার্ষিক এই মিলন মেলাকে আরও সুসাংগঠনিক করতে তুরাগ নদ নিয়েও হোক আগামী প্রকল্প। হজ সৌদির অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। বস্তুত তুরাগপাড়ে বছরের পর বছর আয়োজিত এই ধর্মীয় জমায়েতও হয়ে উঠছে আমাদের অর্থনীতির অংশ। অর্থনীতিবিদদেরও এ বিষয়ে একটু মনোযোগী হওয়া জরুরি।
হাতিরঝিলের মতো দৃষ্টিনন্দন সেতু নির্মাণ, নদীসংলগ্ন সবুজায়ন প্রকল্প হতে পারে তুরাগ নদকে ঘিরে। আবর্জনা ফেলার জন্য নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর বড় বালতি আকারের ডাস্টবিন দেখা যায় বিদেশের ফুটপাতে। তুরাগতীরেও এমন ডাস্টবিন রাখা হোক ও তা নিয়মিত পরিষ্কার করা হোক। যেহেতু ইজতেমার মতো ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ আয়োজন তুরাগকে ঘিরেই চলে, তাই তুরাগ নদ ও সংলগ্ন স্থানে অস্থায়ী নির্মাণ কমিয়ে স্থায়ী ও পরিবেশবান্ধব নির্মাণ পরিকল্পনা নিতে হবে। তবে তুরাগের পরিবেশ কত সংখ্যক পাকা আবাসন ও তিন তলা শৌচাগারের ভার নিতে সক্ষম, এর একটি জরিপ জরুরি।
এ কথা ঠিক, অতিরিক্ত মানুষের অসচেতন পদভারে তুরাগের স্বাভাবিকত্ব হতে পারে আরও বিঘি্নত। তবে এ কথাও ভাবতে হচ্ছে, ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠীর জমায়েত ইজতেমাই হয়ে উঠতে পারে তুরাগকে বাঁচানোর নিমিত্ত। –
প্রকাশিত: দৈনিক সমকাল, ২০ জানুয়ারি ২০১৬