দরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন

সিদ্দিকুর রহমান
Published : 27 June 2014, 04:12 AM
Updated : 27 June 2014, 04:12 AM

শিক্ষা ব্যবস্থায় গত তিন দশকে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তবে আশানুরুপ পরিবর্তন করতে হলে আমাদের আরও কিছু কাজ করতে হবে। কিছু কিছু বিষয় আছে যেগুলো করার জন্য বেশ কিছু অর্থের প্রয়োজন। অর্থের যেখানে প্রয়োজন, সেখানে আবার একটা প্রশ্ন আছে– অর্থটা যথাযথভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা। অন্যান্য খাতের মতো শিক্ষা খাতেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্থের অপচয় হচ্ছে। অতএব শিক্ষার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ যেখান থেকে হয়, সেখানেও সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর তা বাস্তবায়ন হওয়াটা জরুরি।

অনেক কিছু করার মধ্যে কিছু কিছু বিষয় আছে যেগুলোর জন্য খুব একটা অর্থের প্রয়োজন হয় না। আমি আজকে শিক্ষার উন্নয়নের ব্যাপারে এমন কিছু সুপারিশ করতে চাইব যেগুলো বাস্তবায়নের জন্য অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন নেই।

আমাদের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য বেশকিছু কার্যক্রম চালু আছে। এর মধ্যে একটি হল টিচিং কোয়ালিটি ইমপ্রুভমেন্ট, সংক্ষেপে টিকিউআই। এ প্রজেক্টের মূল উদ্দেশ্য হল শিক্ষকদের উন্নয়ন করা। কারণ শিক্ষকদের মান উন্নত হলে শিক্ষার মান উন্নত হবে, শিক্ষার্থীরা ভালো শিখবে।

সেকাইল আরেকটি প্রজেক্ট। সেকাইলের উদ্দেশ্য অনেক। তার মধ্যে একটি হল, গ্রামগঞ্জের স্কুলগুলো যেসব বিষয়ে পিছিয়ে আছে, যেমন গণিত বা ইংরেজি, সেসব বিষয়ে অতিরিক্ত শিক্ষক দিয়ে স্কুল ছুটির পর শিক্ষার্থীদের বিশেষভাবে ক্লাস নেওয়া। এর জন্য ওই সেকাইল প্রজেক্ট থেকে অর্থের জোগান দেওয়া হয়। এখন আরেকটি নতুন প্রজেক্ট শুরু হয়েছে, সেটিতেও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে।

এসব প্রজেক্টের জন্য আমরা যে টাকা খরচ করছি, ওই টাকাই যদি আমরা আরও ভালোভাবে খরচ করি, তাহলে শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানো সম্ভব।

কীভাবে সেটা করতে পারি? আমরা এখন যেভাবে ট্রেনিং দিই তাকে বলে টিওটি, ট্রেইনিং অব দ্য ট্রেইনারস। এখনও পর্যন্ত টিওটি দেওয়া হয় সনাতন পদ্ধতিতে। আমরা ট্রেইনারদের মুখে বলে দিই বা নোটে লিখে দিই শিক্ষকদের কীভাবে ট্রেইনিং দিতে হবে সেটি। কিন্তু তা না করে আমরা যদি শিক্ষকদের কীভাবে ট্রেইনিং দিতে হবে সেটা নিজেরা করে দেখাই এবং এ নিয়ে প্রচুর আলোচনা-সমালোচনা হয়, তাহলে এই শেখাটা অনেক ভালোভাবে হবে। একে বলে হ্যান্ডস অন ট্রেইনিং, যেটি আমাদের দেশে এখনও হচ্ছে না।

তাছাড়া ট্রেইনিংটা হওয়া উচিত স্কিল-বেইজড, একেকটা ট্রেইনিংয়ের জন্য তিন-চারটার বেশি স্কিল রাখা উচিত নয়। যেমন, শ্রেণিকক্ষে কীভাবে প্রশ্নোত্তর পদ্ধতিতে পাঠ উপস্থাপন করতে হয়, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কীভাবে উত্তর নেওয়া হয়, এটা একটা স্কিল। চকের ব্যবহারও আরেকটি স্কিল। শ্রেণিকক্ষে এসেই শিক্ষার্থীদের মোটিভেট করা, তাদের পাঠের প্রতি আকৃষ্ট করা, এসবও একেকটি স্কিল।

এ রকম বিশ-পঁচিশটি স্কিল এক ট্রেইনিংয়ে দিলে সুফল মিলবে না। যদি একেকটি ট্রেইনিংয়ে তিন-চারটি করে স্কিল শেখানো হয় এবং সেটা হাতে-কলমে, তাহলে এর সুফল শ্রেণিকক্ষে পাওয়া সম্ভব। এখন যেভাবে চলছে, সনাতন পদ্ধতিতে মুখে বলে যে, এটা করতে হবে বা ওটা, তাতে খুব একটা লাভ হচ্ছে না। স্কিল-বেইজড হ্যান্ডস অন ট্রেইনিং উন্নত বিশ্বে খুব সাধারণ ঘটনা। ভারতেরও কেরালাসহ কিছু রাজ্যে এভাবে ট্রেইনিং দেওয়া হচ্ছে।

ট্রেইনিংয়ের ব্যাপারে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল 'রিফ্লেকশন'। এটি দু রকম আছে, সেলফ ও গ্রুপ। সেলফ হল একটি ক্লাস নেওয়ার পর শিক্ষক নিজে নিজে ভাববেন যে, তার ত্রুটি বা অর্জনের জায়গা কোনগুলো, তারপর সেগুলো সংশোধন করবেন। আর গ্রুপ রিফ্লেকশনের জন্য একজন শিক্ষক ক্লাস নেবার সময় পেছনে অন্য দুজন শিক্ষক বসে থাকবেন। ক্লাস শেষে তিন শিক্ষক একসঙ্গে বসে প্রথম শিক্ষকের পারফরমেন্সের মূল্যায়ন করবেন।

যেমন, এমনটি হতে পারে যে ওই শিক্ষকের ক্লাস গ্রহণ খুবই ভালো হয়েছে। কিন্তু তিনি ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে তাকিয়ে শিক্ষার্থীদের দিকে পিছন ফিরে ক্লাসটি নিয়েছেন। শিক্ষকের সার্বিক পারফরমেন্সে মূল্যায়নের সময় এ দিকটি তাকে ধরিয়ে দেবেন উপস্থিত বাকি দুই শিক্ষক। একে বলে গ্রুপ রিফ্লেকশন। এভাবে সেলফ ও গ্রুপ রিফ্লেকশনের মাধ্যমে শিক্ষক তার দক্ষতার উন্নয়ন ঘটাতে পারবেন। এসব বিষয় চালু করতেও কিন্তু অর্থকড়ির দরকার হয় না।

আরও বেশ কিছু ব্যাপার আছে। সেদিন একটি টেলিভিশন চ্যানেলের আলোচনায় এক শিক্ষক ঢাকার সেরা স্কুলগুলোর নিজেদের মধ্যে এক ধরনের বোঝাপড়ার বিষয়ে প্রশ্ন করলেন। যেমন, 'ক' স্কুলের শিক্ষার্থীরা 'খ' স্কুলে পরীক্ষা দিতে যায়। আবার 'খ' স্কুলের শিক্ষার্থীরা আসে 'ক' স্কুলে। তাতে বোঝাপড়ার সুযোগ পায় দুটো স্কুল কর্তৃপক্ষ। তা না করে যদি 'ক' স্কুলের শিক্ষার্থীরা 'খ' স্কুলে এবং 'খ'-এর শিক্ষার্থীরা 'গ'-তে যেত, তাহলে এসব সুযোগ থাকত না। এভাবে এমন কিছু কিছু বিষয় আছে যেগুলো পরিবর্তন করতে আমাদের বাড়তি খরচের কোনো প্রয়োজনই হবে না, কেবল সিদ্ধান্ত নিলেই চলবে।

পাঠ্যপুস্তকে আমরা এখন কিছু বিষয় যোগ করেছি যাতে শিক্ষার্থীরা আরও ভালোভাবে শিখতে পারে। যেমন, ক্লাসে শিক্ষক লেকচার দেওয়ার পর বইয়ে যে কাজ দেওয়া আছে সেটি অনুযায়ী কাজ করতে শিক্ষার্থীরা ব্যস্ত হয়ে পড়লে দু' দিক থেকে উপকার। শিক্ষককে যেমন তাহলে পুরো চল্লিশ মিনিট লেকচার দিতে হচ্ছে না, তেমন শিক্ষার্থীও বিষয়টি আরও ভালোভাবে শিখছে। তাতে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি হবে।

পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে এখন অনেক কথা আছে। বিশেষত প্রশ্নফাঁস নিয়ে আলোচনা চলছে অনেক। এ জন্য তদন্ত কমিটি করা হয়েছে, সেটা ঠিক আছে, কিন্তু সে কমিটিতে কতজন আছেন যারা শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত? কতজন সৃজনশীল ব্যক্তি? প্রশ্নফাঁস নিয়ে অনেক লেখা পড়েছি। খেয়াল করে দেখেছি যে, মূল প্রশ্নের 'গ' আর 'ঘ' ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের সঙ্গে মিলে যায়, 'ক' আর 'খ' মিলে না। মজার বিষয় হল, 'ক' আর 'খ'-এর প্রশ্ন দুটো এসেছে বোর্ডের বই থেকে, কিন্তু 'গ' আর 'ঘ' হচ্ছে সৃজনশীল।

তাহলে প্রশ্ন হল, বোর্ডের বই থেকে আসা উত্তর দুটো যে কেউ তৈরি করতে পারেন, কিন্তু সৃজনশীল উত্তর দুটো কারা তৈরি করতে পারবেন? তারাই যারা শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত। তাতে মনে হয়, প্রশ্ন যারা তৈরি করেন বা মডারেশন করেন, তাদের একটি অংশ প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে যুক্ত আছেন। নতুবা এ ধরনের প্রশ্ন ফাঁস হতে পারে না। বিজি প্রেস থেকে প্রশ্ন ফাঁস হলে পুরো প্রশ্ন ফাঁস হত। কিন্তু এখন যেভাবে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে তাতে কিছুটা কারুকাজ করে তা করা হচ্ছে।

আরেকটি বিষয় আমি শুনেছি, পুরো নিশ্চিত নই, বিশেষ এক দল লোককে দিয়েই গত কয়েক বছর ধরে প্রশ্নপত্র তৈরি করা হচ্ছে। এটা কিন্তু উচিত নয় মোটেই। পাশাপাশি প্রশ্ন তৈরি করার কৌশলেও পরিবর্তন আনতে হবে। যেমন, একই প্রশ্ন চারজনকে তৈরি করার দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। প্রশ্ন মডারেশন যারা করবেন তাদের অত্যন্ত ও নির্ভরযোগ্য দক্ষ হতে হবে। ওই চারজনের প্রশ্ন থেকে মডারেটররা মূল প্রশ্ন তৈরি করবেন কিন্তু চার প্রশ্নকর্তা জানতে পারবেন না কী করা হচ্ছে। আর মডারেটররা যদি নির্ভরযোগ্য হন, তাহলে প্রশ্নফাঁসের ভয় থাকবে না। সবচেয়ে বড় কথা, বোর্ডগুলোর কন্ট্রোলার অফিসে যারা কাজ করবেন তারা যেন পরীক্ষিত সৎ হোন। এগুলো অনেকটা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপার।

আমরা নতুন কারিকুলাম করার সময় দেখেছি, আমাদের ছুটিছাটা একটু বেশি। ভারতে ঈদের সময় মাত্র একদিন ছুটি দেওয়া হয়, আর আমরা এ সময় লম্বা ছুটিতে যাই। সব ধরনের ছুটি একটু কমাতে হবে। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এমনও কিছু কিছু ছুটি আছে যেগুলো সেভাবে পালনও করা হয় না অথচ ছুটি আছে, এগুলো কমানো উচিত। তাতে সিলেবাস শেষ করা সহজ হবে।

এ রকম সিদ্ধান্ত-নির্ভর আরও কিছু বিষয় আছে। যেমন, আমরা যখন স্কুলে পড়তাম তখন পরীক্ষা শুরু হত সোমবারে (যেহেতু তখন রোববারে স্কুল ছুটি ছিল)। প্রথম দিনেই হয়তো বাংলা প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র, দ্বিতীয় ইংরেজি প্রথম ও দ্বিতীয়, তৃতীয় দিনে গণিত ও ভূগোল— এভাবে পাঁচ দিনের মধ্যেই সব পরীক্ষা নেওয়া শেষ। আর এখন এক কী দেড় মাস ধরে একেকটি পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে শিক্ষার্থীদের মনের ওপর চাপ পড়ে অহেতুক। আমরা পাঁচ দিনে পরীক্ষা দিয়েছি, এখন তা না হোক, দুই সপ্তাহে পরীক্ষা নেওয়া শেষ করা হোক। শিক্ষার্থীরা নবম শ্রেণিতে উঠলেই তাদের এটা জানিয়ে দেওয়া হোক। তাতে স্কুলগুলোও এভাবে পরীক্ষা নিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। এসব তো কেবল সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ব্যাপার, অর্থকড়ির ব্যাপার নয়।

আমাদের পাবলিক পরীক্ষার সংখ্যাবৃদ্ধি নিয়েও কিছু কথা আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার আগে আমাদের শিক্ষার্থীরা এখন চারটি পরীক্ষা দিচ্ছে, প্রাথমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা, জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা, মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। মানে পঞ্চম, অষ্টম, দশম শ্রেণির পর ও দ্বাদশ শ্রেণির পর পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। এ ধরনের পরীক্ষাকে বলে সামেটিভ পরীক্ষা।

পৃথিবীর কোনো দেশেই এত বেশি সামেটিভ পরীক্ষা নেবার রেওয়াজ নেই। কোথাও কোথাও একটি, কোথাও বড়জোর দুটি পরীক্ষা নেওয়া হয়। এমনও দেখা গেছে যে, অনেক দেশে দুটি সামেটিভ পরীক্ষা থেকে একটি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোথাও তিনটি থেকে দুটিতে নেওয়া হয়েছে। আর আমাদের যেখানে দুটি সামেটিভ পরীক্ষা ছিল আগে, সেখান থেকে আমরা সংখ্যা বাড়িয়ে চারটি করেছি।

এর পক্ষে অনেক যুক্তি থাকতে পারে। কিন্তু না নেওয়ার পক্ষে বড় যুক্তি হল, ছোট্ট শিশুদের পরীক্ষা নিতে গিয়ে তাদের ওপর যে চাপ তৈরি করা হয় বা তাদের মধ্যে যে পরীক্ষাভীতি তৈরি হয় সেটি অনুচিত। ছোট শিশুদের জন্য এসব পরীক্ষার ক্ষতিকর দিকগুলো হল, একটি শিশু পরীক্ষা দিতে গিয়ে ঘরে, স্কুলে এবং ঘরের বাইরে কোচিং বা ঘরের ভেতর প্রাইভেট পড়ার জন্য যে চাপের মধ্যে পড়ে, তার মনস্তাস্তিক প্রভাব বিরাট। এর ফলে কেউ কেউ সমস্যায় পড়বে, কারও হয়তো আরও পরে গিয়ে সমস্যা হবে।

শিশুরা যতটুকু চাপ নিতে পারবে তার চেয়ে বেশি চাপ দিলে তাদের বিকাশও বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তাছাড়া শৈশবে লেখাপড়ার জন্য বেশি চাপাচাপি করলে বড় হয়ে তাদের মধ্যে লেখাপড়ার ব্যাপারে অনীহা তৈরি হতে পারে।

তাই পৃথিবীর অন্যান্য দেশে পাবলিক পরীক্ষা উঠিয়ে দেওয়া না হলেও এর সংখ্যা কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এখন ফরমেটিভ অ্যাসেসমেন্ট করা হচ্ছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। ফরমেশন বা গঠনের পর্যায়ে, মানে শেখার সময়ই শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বেশি। যেমন, শিশু ক্লাসে একটি বিষয়ে পড়ছে, তারপর তার পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে সে কতটা শিখছে তার মূল্যায়নের জন্য। তাতে শিশুরা পরীক্ষাকে পরীক্ষা মনে করে ভয় পাবে না।

একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। আপনি একটি কাপড় বুনতে গিয়ে কাপড়ের দৈর্ঘ্য, সুতার রঙ, নকশা ইত্যাদি নির্বাচন করে কাজ শুরু করলেন। এরপর আপনি যদি সুতা তাঁতে গিয়ে কয়েক ঘণ্টা টানা বুনে যান এবং শেষে গিয়ে দেখেন আপনার কাপড়টি ঠিকভাবে বোনা হয়নি, তাতে রঙে অসামঞ্জস্য রয়েছে বা নকশাটা ঠিকভাবে ফুটে উঠেনি, তাহলে আপনাকে পুরোটা খুলে নতুন করে কাজ করতে হবে অথবা ওই ত্রুটিযুক্ত কাপড়টিই পরতে হবে। একে বলে সামেটিভ পদ্ধতি।

কিন্তু আপনি যদি বুননের ফাঁকে ফাঁকে কয়েক বার পরীক্ষা করে দেখেন সব ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা, তাহলে নকশা নিয়ে সমস্যা বা রঙের ব্যবহারে কোথাও একটু সমস্যা হলে প্রতিবারই তা ঠিক করে নেওয়া যাবে। তাই একে বলা যায় ফরমেটিভ বা গঠনকালীন মূল্যায়নের পদ্ধতি।

আমরা নতুন কারিকুলামে গঠনকালীন মূল্যায়নের ওপর জোর দিয়েছি। সাধারণত শিক্ষকরা এটা করতে চান না। তাই আমরা বলেছি যে, চূড়ান্ত পরীক্ষায় ১০০ নম্বরের মধ্যে ৮০ নম্বরের পরীক্ষা হবে। বাকি ২০ নম্বর হবে ফরমেটিভ পরীক্ষার মূল্যায়নের ফলাফল। তাহলে শিক্ষকরা এটা করতে বাধ্য হবেন। এ ব্যাপারে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন কিন্তু তা কার্যকর না করেই বছরের অর্ধেক চলে গেল।

সিদ্ধান্তগুলো যথাসময়ে নিয়ে যথাসময়ে বাস্তবায়ন করা হলে কিন্তু আমি যথাযথ ফলাফল পাব। কিন্তু সিদ্ধান্ত আজ নিয়ে দু বছর পর বাস্তবায়ন করলে কাঙ্ক্ষিত ফল পাব না। কিন্তু সিদ্ধান্ত যথাসময়ে নিতে কি টাকা বেশি খরচ হবে? তা তো অবশ্যই নয়।

আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এ রকম শত শত এরিয়া আছে যেখানে আমরা কাজ করতে পারি। বাড়তি অর্থকড়ি না ঢেলে বা যেটি খরচ হচ্ছে তারই আরও যথার্থ ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা শিক্ষায় পরিমাণগত ও গুণগত পরিবর্তন আনতে পারি।

তবে এমন কিছু বিষয় আছে যেখানে কিছু অর্থকড়ি ঢালার প্রয়োজন পড়ে। যেমন, কোনো একটি ক্লাসে ষাট-সত্তর জনের বেশি শিক্ষার্থী থাকলে শিক্ষকের পক্ষে মনোযোগ দেওয়া মুশকিল হতে পারে। সে ক্ষেত্রে দুটো সেকশন করে দিলে সুবিধা। কিন্তু এ জন্য নতুন ক্লাসরুম, শিক্ষক, কক্ষের আসবাব ইত্যাদির দরকার হবে যার জন্য কিছু খরচ করতে হবে। আবার মাল্টিমিডিয়া ব্যবহারের মাধ্যমে বা কয়েকটি শ্রেণিকক্ষ মাল্টিমিডিয়া করে দিলে শিক্ষার্থীদের উপকার হত। এসবের জন্য অবশ্যই অর্থের প্রয়োজন আছে।

কিন্তু আমাদের মূল সমস্যা অর্থের দৈন্যতা নয়, মানসিক দৈন্যতা। দেখা যায়, অনেক স্কুলে মাল্টিমিডিয়া না থাকলেও কিছু কিছু অ্যাপারেটাস আছে, কিন্তু এগুলোর ব্যবহার হয় না। আবার দেখা যায়, অনেক উপকরণের জন্য টাকা লাগলেও 'অনেক অনেক' উপকরণের জন্য টাকা লাগে না। যেমন ধরুন, চতুর্থ শ্রেণির ক্লাসে আপনি শিশুদের গাছের বিভিন্ন অংশ সম্পর্কে শেখাবেন। আপনি তাদের জন্য একটি ছোট্ট গাছ ব্যবহার করেই তাদের মূল, কাণ্ড, শাখা ইত্যাদি দেখাতে পারেন। এ রকম অসংখ্য উপকরণ আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে যাতে টাকা খরচের প্রয়োজন নেই। এসব উপকরণ ব্যবহারে শিক্ষকের কাজটিও অনেক সহজ হয়ে যায়।

শিক্ষা নিয়ে এ রকম অনেক কিছু করার আছে। সৃজনশীল প্রশ্নের আমি একশ ভাগ সমর্থক। এটা না হলে আমাদের ছেলেমেয়েরা মশা-মারা কেরানি হওয়ার বিদ্যা অর্জন করত। তারা চিন্তা করতে শিখত না, তাদের দ্বারা নতুন কিছু উদ্ভাবনও তখন সম্ভবত ছিল না। তবে সৃজনশীল পদ্ধতিরও এখন সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে, কারণ এর মধ্যে কিছু দুর্বলতা আছে। সৃজনশীল প্রশ্ন শুধু নয়, শ্রেণিকক্ষে সৃজনশীল কর্মকাণ্ডেরও দরকার রয়েছে।

আমাদের শিক্ষা প্রশাসনেও কিছু সংস্কার দরকার। আমার খুব কষ্ট লাগে যখন দেখি, প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অফিসে দূর-দূরান্ত থেকে শিক্ষকরা এসে দাঁড়িয়ে থাকেন। হয়তো একটি কাজ আদায়ের চেষ্টা করছেন, তা-ও হবে কিনা নিশ্চিত নয়। আবার একদিন ঢাকায় থাকলেই তার পাঁচশ টাকা শেষ। আমার কথা হল, এই শিক্ষা প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ করা যায় না? তাহলে প্রত্যেক শিক্ষক নিজ নিজ জেলার অফিস থেকেই কাজগুলো করিয়ে নিতে পারেন।

এ রকম অনেক কিছু করার আছে। যে পরিমাণ টাকা বরাদ্দ আছে তা দিয়েও করা সম্ভব। আরও বেশি অর্থ দিলে আরও ভালোভাবে সম্ভব। এখন প্রশ্ন হল একটাই। আমরা কি সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে ঠিক সময়ে তা বাস্তবায়ন করব কিনা।

ড. সিদ্দিকুর রহমান: শিক্ষাবিদ, গবেষক, ন্যাশনাল কারিকুলাম অ্যান্ড অ্যাসেসমেন্ট কনসালটেন্ট।