আইরিন সুলতানা : আপনার কবিতার ধরনে দেশপ্রেমবোধ প্রবল। একজন আদ্যোপান্ত দেশজ কবিরূপে পাঠক আপনাকে আবিষ্কার করে। কোনো বিশেষ বার্তাও কি দিতে চান তাদের, যারা ইতিহাস বিকৃতি ঘটায়?
নুরুন্নাহার শিরীন : হুমম্ এটা তুমি ভালো বলেছ। সেই ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের সময়টাকে দেখেছি। তখন একেবারে আমরা স্কুলের শেষ পর্যায়ে। আমি তখন এসএসসি ক্যান্ডিডেট। ওই সময়টা এমনÑসেই সময় বঙ্গবন্ধুর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, আমাদের ওই যে মফস্বল শহরের ছাত্র আন্দোলন, আমাকে এগুলো খুব টাচ করত! আমি অন্ধভাবে ভক্ত বঙ্গবন্ধুর। মানে এ রকম নেতা মনে হয় যেন আমরা ঐশ্বরিক আশীর্বাদে পেয়েছি। ওই যে ব্যাপারটা আমার ভেতরে ঢুকে গেছে, সেটা যাওয়ার প্রশ্ন আসে না। এ বয়সেও সেটা একেবারে হৃদয়ে খোদিত আছে। ঐতিহাসিক সত্য যেটা, সেটা বিকৃত করার প্রশ্ন আসে কোত্থেকে? কেন? আমাদের যে অপরাজনীতিটা, এটা কবে দূর হবে জানি না। এই দেশ থেকে আদৌ নির্মূল সম্ভব কি না সেটা নিয়েও আমি সন্দিহান। তারপরও আশাবাদী। আমি তো কোনো ছার, আমার মতো এবং আমার চেয়েও যারা বড়, প্রত্যেকের আমার মনে হয় এখানে একটা শক্ত ভূমিকা থাকা উচিত। প্রজন্ম যাতে ওই বিকৃতির দিকে কোনো দিন না যায়। কেন যাবে? এই প্রশ্নটা আমি সবার মধ্যে জাগাতে চাই। কিন্তু ওটা তো আর আমার একার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি যখনই লিখি এটা আমার অগোচরেই চলে আসে। তুমি যেটা বললে, পাই ওই যে মনের মধ্যে এটা, আমার মনে হয় গড়পড়তা হয়ে যাচ্ছে, আমি একই কথা বলে যাচ্ছি। এটা কী কাজ হচ্ছে আমি জানি না। এটা হয়ত একটা বোরিং ব্যাপার কারো কাছে লাগতে পারে। কিন্তু আমি তো এ থেকে মুক্ত হতে পারছি না।
আইরিন সুলতানা : হুমায়ুন আজাদ আপনাকে প্রভাবিত করে?
নুরুন্নাহার শিরীন : আমি তো বাংলায় পড়েছি। চট্টগ্রাম বিভাগের আন্ডারে ছিল। আমি কুমিল্লার। আমাদের কলেজে সে সময় বাংলা বিভাগ প্রথম চালু হয়েছিল। যেহেতু তিনি বাংলার স্যার, তো স্যারই ডেকেছি। বইমেলায় তিনি বসতেন কিন্তু মাঝে মাঝে প্রকাশনীর স্টলেÑ কোন স্টলটা এখন ভুলে গেছি আমি। ওইখানেই তার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। আমি চট্টগ্রামে থেকে এসে বইমেলায় যখন যেতাম, স্যারকে দেখে অনেক ভালো লাগত। স্যারকে কিন্তু অনেকেই ভয় পেত। আমার কেন জানি কখনো ভয় লাগেনি। আমি তাকে বই লিখে দিতাম এবং তিনি খুশি মনে সেটা নিতেন। খুব খারাপ লাগে, শেষবার যখন তাকে আততায়ীরা আঘাত করল, সেদিনও কিন্তু বইমেলাতে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। তারপর রাতে যে এই ঘটনা সেটা তো আমার কাছে এখনো মানে অবিশ্বাস্য মনে হয়। যে স্যারের সঙ্গে কথা বললাম আর এরকমÑভাবা যায় না। ভাবা যায় না এত বড় অন্যায় তার সঙ্গে হয়েছে। আর তার মতো দ্ব্যর্থহীনভাবে এভাবে লেখা খুব কম সাহিত্যিকের আছে। যেমন গদ্য, তেমন পদ্য, দুই ক্ষেত্রেই তিনি খুব দ্ব্যর্থহীন গলায় বলতে পারতেন। আর আমার যেটা স্মৃতিতে, আমার কাগজের ডানা বইটাকে তিনি খুব প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখেছিলেন। বইটি উলটেপালটে বাহ্ চমৎকার বলেছিলেন। এটা আমার খুব মনে পড়ে। আমাদের সঙ্গেরই অনেকে সাহস করে স্যারের সামনে যেত না। আমি এটার কোনো কারণ বুঝি না। আমার কিন্তু তাকে অমায়িকই মনে হতো। আমি কখনো তাকে ওই কড়া মেজাজে দেখিনি। আর সে রকম যে একেবারে তিনি আমার ক্লাস নিয়েছেন ওটা নয়। আমার সঙ্গে ওই বইমেলাতেই যেটুকুন পরিচয় কথাবার্তা। আমার খুব ভালো লাগত তাকে। শ্রদ্ধাভাজন।
আইরিন সুলতানা : তসলিমা নাসরিন। বিশ বছরেরও অধিক হয়ে গেল নির্বাসনে। অনেকে তার লেখাকে সাহিত্যের মর্যাদা দিতে নারাজ।
নুরুন্নাহার শিরীন : তসলিমা নাসরিন লেখক হিসেবে আমি মনে করি অত্যন্ত ঝরঝরে। একজন সাহিত্যিক হিসেবে তাকে মর্যাদা দেয়াই উচিত। আর নির্বাসিত যেটা সেখানে কিন্তু আমার যতটুকু ধারণা, এখানে অদ্ভুত একটা রাজনীতিও কাজ করেছে। যে রাজনীতির শিকার তসলিমা নাসরিন হয়েছেন এবং অনেকটা ইচ্ছা-অনিচ্ছা দুটিই জড়িত। আমার কেন জানি মনে হয়, সত্যি-মিথ্যা জানি না, তিনি বোধহয় বিতর্কিত হওয়াটা একটু ভালোবাসেন। তার লেখা কিন্তু আমি পছন্দ করি। আমি চাই যে সাহিত্যিক হিসেবে, আমাদের দেশেরই তিনি, তার দেশে ফেরৎ আসা না আসায় বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত নয়।
আইরিন সুলতানা : জাতিগতভাবে আমাদের সাংস্কৃতিক চর্চায়, সাহিত্য চর্চায় কি কোনো দুর্বল জায়গা আছে যার কারণে আমরা কোথাও গিয়ে একটা ভীষণ কুসংস্কারকে আঁকড়ে ধরছি?
নুরুন্নাহার শিরীন : সাহিত্যটা কিন্তু কুসংস্কারের জায়গা নয়। তারপরও কিছু কিছু গোষ্ঠী অনেকটা পশ্চাৎপদ ধ্যানধারণায় পুষ্ট হয়ে আলাদা সাহিত্য চর্চা করছে। মুসলিম সাহিত্য- এ রকম কোনো সাহিত্য আছে বলে আমার জানা নেই, কিন্তু হচ্ছে। এ ধরনের গোষ্ঠী আমাদের দেশে আছেÑসর্বত্রই আছে। ভারতেও আছে, কট্টর হিন্দুবাদ যে নেই তা নয়। এগুলো চলবে। এসব পরিস্থিতির মোকাবেলা করেই সাহিত্য টিকে থাকবে। এটাই আমার বিশ্বাস।