ব্লগস্ফিয়ার ও বাংলা ব্লগ বিপ্লব

আইরিন সুলতানাআইরিন সুলতানা
Published : 27 August 2011, 08:41 AM
Updated : 27 August 2011, 08:41 AM

এলাকার কফি হাউজের জমজমাট আড্ডায় আপনার বন্ধুটি যদি কণ্ঠে নাটকীয় উত্তেজনা নিয়ে বলে ওঠে, 'আরে! জানিস সারা বিশ্বে নাকি ১০০ মিলিয়নেরও বেশী ব্লগ আছে!' আর সেই মূহূর্তে আপনার নিরামিষ প্রশ্ন, 'ব্লগ আবার কী?' ব্যাস! অট্টহাসির দমকে টেবিল কেঁপে, কফি ছলকে একাকার দশা। প্রমাণ হয়ে গেল সবাই যখন সোস্যাল নেটওয়ার্কিংয়ের ছোঁয়াচে জ্বরে আক্রান্ত, তখন আন্তর্জালিক সমাজে আপনি কতখানি অসামাজিক!

আন্তর্জালের ব্যাকরণগত সংজ্ঞানুযায়ী ব্লগ শব্দটি 'ওয়েব লগ' এর সংক্ষিপ্ত রূপ। ব্লগের আচরণগত প্রকাশ অনুযায়ী একে ব্যক্তিগত ডায়রীও বলা যেতে পারে, যা আপনি আন্তর্জালে লিপিবদ্ধ করছেন, সংরক্ষণ করছেন। ব্লগ বস্তুত ওয়েব সাইট যেখানে যে কোন ব্যক্তি বিভিন্ন ঘটনার বিবরণ, অনুভূতি, সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পারে। সাধারণত ব্লগে কোন তথ্য বর্ণিত থাকে, ছবি বা ভিডিও থাকে, অন্যকোন ওয়েবসাইট বা ব্লগসাইটের লিংক থাকে। বেশীর ভাগ ব্লগের একটি আকর্ষণীয় দিক হলো পাঠকের মন্তব্য করার সুযোগ। ব্যক্তিবিশেষের আগ্রহ ও রুচী ভেদের উপর নির্ভর করে ব্লগের প্রকারভেদ গড়ে ওঠে। যেমন অডিও-ভিডিও বা পডকাস্ট ব্লগ, ফটোগ্রাফি ব্লগ, আর্ট ব্লগ, মিউজিক ব্লগ (এমপিথ্রি ব্লগ) ইত্যাদি।

ব্লগের ব্যকরণগত প্রকারভেদ আপাতদৃষ্টিতে এভাবে করা যায়- ব্যক্তিগত ব্লগ, ব্যবসায়িক ও প্রতিষ্ঠানিক ব্লগ, অন্যান্য বিষয় ভিত্তিক ব্লগ, মিডিয়া ব্লগ, প্রযুক্তি সংক্রান্ত ব্লগ। একেবারে মনের মাধুরী মিশিয়ে নিজের ডায়েরী লেখার মত হলো ব্যক্তিগত ব্লগিং। ওয়ার্ডপ্রেস ও ব্লগস্পটে এমন হাজার হাজার ব্যক্তিগত ব্লগ আছে। এখানকার অনেক ব্লগ যেমন পাঠক প্রিয়তা পেয়েছে তেমনি অজস্র ব্লগও আছে যা হয়ত আদৌ পঠিত হয়নি। পণ্যের প্রচার-প্রচারণার জন্য সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক আলোচনা বা পণ্যসংক্রান্ত অভিযোগ, অভিমত জানানোর সুযোগ করে দিয়ে ভোক্তা-গ্রাহকদের কাছাকাছি পৌঁছে যেতে অনেক বৃহৎ ও ব্রান্ড প্রতিষ্ঠানও তাদের নিজস্ব ব্লগ উন্মুক্ত করেছে। এধরনের কর্পোরেট ব্লগগুলোর শীর্ষ তালিকায় টেকনোরাটি'র (Technorati) এক জরিপে এডোবি, ডেল, কোডাক'কে সেরা পনেরতে দেখা যায়। মে'২০০৮ এর এই জরিপে শীর্ষে ছিল অবধারিত ভাবেই ব্লগস্পটে গুগলের ব্লগটি। শখের যেমন শেষ নেই, তেমনি শখ অনুযায়ী ব্লগেরও কমতি নেই। তাই বিষয় ভিত্তিক ব্লগে আমরা ফ্যাশন ব্লগ, শিক্ষা সংক্রান্ত ব্লগ, ভ্রমণ ব্লগ ইত্যাদি নানা স্বাদের ব্লগ পাই। মুখে মুখে তেমনভাবে প্রচলিত না হলেও মাম ব্লগ, ড্যাড ব্লগ, পিতামাতা ব্লগ ও পরিবার ব্লগ জাতীয় ব্লগগুলোতে মূলত পরিবারিক বিষয়াদি নিয়েই আলাপচারিতা হয় এবং অবশ্যই এধরনের ব্লগে মহিলা ব্লগাররাই সংখ্যায় অধিক। প্রযুক্তি সংক্রান্ত ব্লগগুলোর মধ্যে বিশেষত বিভিন্ন ডিভাইস নিয়ে ব্লগুলোতে সবার আগ্রহ বেশী থাকে। মোবাইল ডিভাইস নিয়ে এরকম ব্লগগুলো মব-লগ নামেও পরিচিত। মিডিয়া ব্লগগুলো মূলত অডিও, ভিডিও, ফটো ও লিংক ভিত্তিক ব্লগ। ফটো-ব্লগিংয়ে ফ্লিকার, ভিডিও ব্লগিং -এ ইউ-টিউব, অডিও নিয়ে ই-স্নিপস আন্তর্জালকে মাতিয়ে রেখেছে। এরকম ব্লগ সাইটগুলোকে যেমন মাইক্রোব্লগ বলা যায় তেমনি ফেসবুকের বহুমুখী ব্যবহারের পরও একে মাইক্রোব্লগের কাতারে সামিল করা যায়।

হয়ত ছোটখাট একটি বাক্য বা একটি ছবি অথবা দশ সেকেন্ডের একটি ভিডিও যা কেবল মাত্র নির্দিষ্ট বন্ধুরাই দেখতে পারবে অথবা সবার জন্যই উন্মুক্ত থাকবে ব্লগ সাইটে তারপর সাথে জুড়ে দেয়া যাবে কিছু চটপট ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া- মাইক্রোব্লগিং এর ধরনটাই এমন। বিস্তৃত কলেবরের ব্লগের পাশাপাশি মাইক্রোব্লগও এক ধরনের ব্লগিং, তবে বেশ সংক্ষিপ্ত আকারে এবং অনেকাংশেই মালটিমিডিয়া নির্ভরশীল। ২০০৬ ও ২০০৭ সালের দিকে মাইক্রোব্লগিংয়ের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে টুইটার ও টাম্বললগ এর নানাবিধ ব্যবহারের কারণে। মে'২০০৭ নাগাদ সারা বিশ্বে ১১১টি মাইক্রোব্লগ সাইট ছড়িয়ে পড়ে আন্তর্জালে। কেবল বিনোদন বা কখনো কখনো নিরর্থক কথামালা ছাড়াও মাইক্রোব্লগিংয়ে সমসাময়িক ঘটন-অঘটনগুলোও উঠে এসেছে চটজলদি। ২০০৯ সালে ইরানের নির্বাচন নিয়ে তুমুল আন্দোলনের উত্তাপ টুইটারেও দেখা গিয়েছিল কারণ আন্দোলনকারিরা জনমত গঠন, মতামত আদানপ্রদান, যোগাযোগ বা প্রচার-প্রচারণার জন্য টুইটার ও অন্যান্য সোস্যাল নেটওয়াকিং সাইটগুলোর উপর নির্ভরশীল ছিল। টুইটারে ছড়িয়ে পড়া এই আন্দোলন পরবর্তীতে 'টুইটার বিপ্লব' নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী হাতোইয়ামা টুইটারের জাপানি সংস্করণ ব্যবহার করে ২০১০ এর পয়লা দিনেই চমকে দিলেন জাপানিদের । জাপানি ভাষায় নিজের একটি ব্লগ সাইটও উদ্বোধন করেন তিনি। নিজের হারানো জনপ্রিয়তাকে চাঙ্গা করতেই আসলে হাতোইয়ামা'র এই নবকৌশল । প্রতিদিন অন্তত একটি করে বার্তা লেখার প্রতিশ্রুতিদানকারী হাতোইয়ামা টুইটারে এখন পর্যন্ত বেশ সরব।

ঠিক কোন মাহেন্দ্রক্ষণে ব্লগের আবির্ভাব ঘটেছিল বা প্রথম কে ব্লগ লিখেছিলেন, ব্যবহার করেছিলেন তা নিয়ে কিছু টুকরো টুকরো গল্প রয়েছে। ইউকিপিডিয়ার তথ্যানুসারে ডঃ গ্লেন ব্যারি (Dr. Glen Barry) ওয়েব ভিত্তিক মতামত আদানপ্রদানের সুবিধাকে ব্লগ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে আন্তর্জালে ব্লগ আবিস্কার হিসেবে নাম লেখান। প্রথম আন্তর্জালিক জার্নালটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯০ সালে। কেমব্রীজের ভ্রমণকারী জেমস মনরো (james monro); তার ব্লগটিও রয়েছে প্রথম ব্লগের তালিকায়। তিনি সড়ক দূর্ঘটনায় মারা গেলেও সৌভাগ্যবশত তার ব্লগটি আগেই প্রকাশিত হয়েছিল । ১৯৯৪ সালে সোয়ার্থমোর কলেজে (Swarthmore college) অধ্যয়ন কালে ব্লগ লেখা শুরু করেন জাস্টিন হল(Justine Hall)। প্রথম ব্যক্তিগত ব্লগের জন্য দ্য নিউ ইয়র্ক টাইম ম্যাগাজিন জাস্টিনকেই ব্লগ-পিতা হিসেবে আখ্যায়িত করলেও সর্ব প্রথম ব্লগার হিসেব আরো যে দু'জন ব্লগারের নাম শোনা যায় তাদের একজন ডেভ উইনার (Dave Winer) ও অন্যজন জর্ন বার্গার (Jorn Barger)।

২০০৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার এক বৃদ্ধা ১০৮ বছর বয়সে মারা গেলে আন্তর্জাতিক ব্লগ-অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে এসেছিল । কারণ এই বৃদ্ধা একজন ব্লগার ছিলেন। জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত, দুটো বিশ্বযুদ্ধের সাক্ষি অলিভ রাইলে (Olive Riley) ফেব্রুয়ারি'০৭ থেকে ব্লগিং শুরু করেন এবং সত্তরটিরও বেশী ব্লগ-পোস্ট ছিল তার। তাকে এখন পর্যন্ত বয়োজ্যেষ্ঠ ব্লগাররূপে গন্য করা হয়।

২০০৫ সালে ব্লগ হেরাল্ড বিশ্বব্যাপী ব্লগ সাইটগুলোর পরিসংখ্যান দিতে চেষ্টা করে । দেশভিত্তিক ব্লগ সাইট গননায় প্রায় ৭৫ মিলিয়ন ব্লগ পাওয়া যায়। তবে এই পরিসংখ্যান খুব গ্রহণযোগ্য নয় কারণ মূল দেশ যেখানেই হোক না কেন ওয়েব হোস্টিংয়ের জন্য সাধারণত আমেরিকার কোন প্রতিষ্ঠানই কাজ করতো। তবে সাধারণ হিসেবে, যা কিনা বেশী গ্রহণযোগ্য ছিল, ব্লগ সংখ্যা দেখা যায় ১৩৪-১৪৪ মিলিয়ন বা পূর্ণ সংখ্যায় ১০০ মিলিয়নেরও বেশী।

এতো গেলো মূলত আন্তর্জাতিক পরিসরে ব্লগ নিয়ে মাতামাতি। কিন্তু আমাদের দেশেও যে এর ছোঁয়া লাগতে পারে তা কি কেউ ভেবে ছিল? প্রযুক্তির অগ্রযাত্রায় ইংরেজীর পাশাপাশি কম্পিউটার বাংলা-বান্ধব হয়ে উঠলেও বাংলায় স্ট্যাটিক ওয়েব সাইটগুলো বাংলা ভাষাভাষীদের মনে স্বভাবতই ততটা বাড়তি উন্মাদনা তৈরী করতে পারেনি। ওদিকে ব্লগ নিয়ে তখনও ওয়াকেবহাল হয়ে ওঠেনি ঘাড় গুঁজে কম্পিউটারের সাথে বসে থাকা যান্ত্রিক-বাংলাভাষীরা, ওরকম এক সময়ে বাংলাতে আলোচনার একটা ক্ষেত্র তৈরী করার নিরিখে উন্মুক্ত হলো প্রথম বাংলা ব্লগ- সামহোয়্যার ইন ব্লগ। বাংলা ব্লগের চলন কী হবে বা হওয়া উচিৎ তা তখনও হয়ত সয়ং ব্লগ কর্তৃপক্ষও বুঝে উঠতে পারেননি। তাই বলা চলে ২০০৫ এর ১৫ই ডিসেম্বর সামহোয়্যার ইন ব্লগের সূচনাটি ছিল বাংলা ব্লগ নিয়ে একটি উন্মুক্ত ও সম্মিলিত নিরীক্ষা

বিশ্বের কোনায় কোনায় ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা বাংলাদেশীদের কাছে সামহোয়্যার ইন খুব দ্রুতই গ্রহণযোগ্যতা পায় এর ব্যবহার-বান্ধবতার জন্য। স্বনামে-ছদ্মনামে জন্ম নেয় হাজার হাজার ব্লগার আর তাদের হাজার রকম লেখা। তবে ব্লগের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে বাংলা ব্লগার ও ব্লগ-কর্তৃপক্ষকে অনেক চড়াইউৎরাই পার হতে হয়েছে বরাবরই। সামহোয়্যার ইন ব্লগের একচেটিয়া জনপ্রিয়তার পাশাপাশি এসেছে আমার ব্লগ, সচলায়তন, নির্মাণ ব্লগ, ক্যাডেট কলেজ ব্লগ। প্রারম্ভে সচলায়তনের 'আন্তর্জালিক লেখক সমাবেশ' পরিচিতির কারণে একে ব্লগ হিসেবে গণ্য করা হবে কিনা তা এখনও ব্লগ-বোদ্ধাগণের ভেতর হালকা বিতর্ক জিইয়ে রেখেছে । বাংলা শব্দের প্রতি যত্নশীলতার পরিচয় দিতে 'ব্লগার' শব্দের বিপরীতে সচলায়তনের ব্লগারদের 'সচল' নামকরণ করা হয়। মাঝে প্যাঁচালি ব্লগ শুরু হলেও তা ব্লগারদের টানতে খুব একটা সমর্থ হয়নি এবং পরবর্তীতে নানা জটিলতায় ব্লগটি অবশেষে মুখ থুবড়ে পড়ে। বহুল কাটতিসম্মৃদ্ধ পত্রিকা প্রথম আলোও বাংলা ব্লগিং জগতে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নেয় এবং ২০০৮ সালের অক্টোবর থেকে বেশ প্রচার-প্রচারনা চালিয়ে তাদের ব্লগ যাত্রা শুরু হয়। বাংলা ব্লগিং জগতে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজারের ব্লগার সমাগম যে কেবল উপরোক্ত ব্লগগুলোতেই তা নয়; না বলা কথা (দৃষ্টিপাত), এভারগ্রীণ বাংলা ব্লগ প্রচারনার আড়ালে থাকলেও তাদের নিজম্বতা অব্যাহত রয়েছে। অবশ্য আন্তর্জালিক পত্রিকা বিডিনিউজ২৪ এর যথেষ্ট পরিচিতি থাকা স্বত্তেও এই ঘরানার ব্লগটির পরীক্ষামূলক সংস্করণ স্থবির হয়ে আছে গত বছরের মাঝামাঝি থেকে [২০১০ এর মতামত; সেসময় বিডিনিউজ২৪ ব্লগ এর সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি সংস্করণ ছিল]। বিপরীতে গুটিকয়েক কিশোরের নগর-বালক ব্লগ এখন পর্যন্ত তাদের ব্লগ সাইটটিকে বিভিন্ন চেহারা দেয়ার প্রয়াস জারি রেখেছে। তবে যতদূর মনে হয় নগর-বালক হয়তবা গতানুগতিক বাংলা ব্লগিংধারা থেকে বেরিয়ে জনপ্রিয় সোশ্যাল নেটওয়্যাকিং সাইট ফেসবুকের আদলে নিজেদের দাঁড় করাতে চাইছে। মিশ্রধারার বাংলা ব্লগের পাশাপাশি কম্পিউটার জগৎ ও টেকটিউনস তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ে বাংলায় আলোচনার সুযোগ করে দিয়েছে। প্রযুক্তির সুরের মেতে উঠা ব্লগারদের টেকটিউনস ব্লগে 'টেকটিউনার' হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। অধিকাংশই পুরনো ব্লগার-বন্ধুদের নিয়ে খোশগল্পে মেতে ওঠা আমরা বন্ধু ব্লগ ব্লগাকাশে একদম হালের সংযোজন ।এর বাইরে বিষয় ভিত্তিক ব্লগিংয়ে ব্লগস্পটে চালিত হওয়া বাংলাদেশ কর্পোরেট ব্লগে ব্যবসা-বানিজ্য সংক্রান্ত আলোচনা নিয়মিত হলেও এ ব্লগে বুলি হিসেবে ইংরেজীকেই ব্যবহার করা হয়। মূল স্রোতের এই বাংলা ব্লগিংয়ের পাশাপাশি সামহোয়্যার ইন এর 'আওয়াজ' আমাদের পরিচয় করিয়েছে মাইক্রোব্লগিংয়ের সাথেও। অন্যদিকে ব্লগের স্বভাবসূলত প্রকৃতি থেকে সামান্য ভিন্নতার কারণে বিশ্বের প্রথম ইউনিকোড ভিত্তিক বাংলা ফোরামের দাবিদার প্রজন্ম ফোরাম মূল আলোচনার বাইরে থাকলেও এখানে কিন্তু নিত্যই রকমারি আলোচনার আসর জমে।

এক নজরে বাংলা ব্লগের হালহকিকত যখন এই তখন বাংলা ব্লগারদের অবস্থান কী বা তাদের আশা-আকাঙ্খাই বা কী? যারা মুখচেনা নন তাদের বেলায় পত্রপত্রিকায় একটি লেখা পাঠিয়ে অপেক্ষা করতে হয় ভীষণ অনিশ্চয়তায়। যদি সে লেখা ছাপাও হয় তো তার আগে সম্পাদনার কবলে পরে কাটছাঁট চলে হরদম। আবার পত্রিকায় প্রকাশিত লেখায় পাঠকের প্রতিক্রিয়া হাতেনাতে পাওয়া হয়ে ওঠেনা। যেহেতু উন্মুক্ত মাধ্যম, তাই ব্লগ এখানে ব্যতিক্রম; একটি লেখা সাথে সাথেই প্রকাশ করা যায় এবং মন্তব্য, পাল্টা মন্তব্যের সুযোগের কারণে খুব স্বতঃস্ফূর্ততার সাথেই নানা বয়সের, মতাদর্শের, অভিজ্ঞতার বিনিময় কিংবা সমন্বয় ঘটে চলে প্রতিনিয়ত। তাই কেবল সাহিত্য চর্চাই মুখ্য হয়ে থাকেনি বরং সাম্প্রতিক ঘটনাবলী, রাজনীতি, সংস্কৃতি-ইতিহাস-ঐতিহ্য, বহির্বিশ্ব, তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ে লেখার পাশাপাশি বাঙালির আড্ডাবাজিও বিষয় হয়ে ওঠে ব্লগের পাতায়। আজকাল তো সামান্য থেকে গুরুতর কোন তথ্য জানার বা জানানোর প্রয়োজন পড়লেই ব্লগাররা ব্লগমুখী হয় সবার আগে।

ব্লগিং অতঃপর যখন ব্যক্তিগত যোগাযোগের পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায় তখন এই যুথবদ্ধতা সামাজিক দ্বায়িত্ব পালনেও তৎপর হয়ে ওঠে। তাই কখনো 'প্রাপ্তি' নামের শিশুটির পাশে, কখনো 'শ্বাশ্বত সত্য' নামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের পাশে, কখনোবা 'উপমা' নামের কিশোরীর পাশে, 'বহ্নি' নামে তরুণীর পাশে, নয়তো 'নাহিদা' নামে ব্লাড-ক্যান্সারে আক্রান্ত ছাত্রীর পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে ব্লগাররা। সামাজিক অবক্ষয় ও অসহায়ত্ব নিয়েও ব্লগাররা সোচ্চার । রাহেলা হত্যার বিচারের দাবিতে কিছু ব্লগার বারবার আমাদের বিবেকের দরজায় আঘাত করে গেছেন। জনি নামে মা হারা শিশুটির চিকিৎসা ও ভরনপোষনের জন্য কিছু ব্লগার তড়িৎ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। মিরপুরে 'আমাদের পাঠশালা'তে আর্থিকভাবে সহায়তা করার প্রদানের জন্য পাঠশালা বান্ধব সংগ্রহে সামহোয়্যার ইন ব্লগের কিছু ব্লগারদের কাজ করতে দেখা গিয়েছিল। অন্যদিকে 'মেঘনাপাড় ধীবর বিদ্যানিকেতন' নিয়ে মূলত প্রথম আলো ব্লগের কিছু ব্লগারদের নিয়মিত উদ্যোগগুলো প্রসংশার দাবি রাখে। ২০০৭ -এ চট্টগ্রামে ভূমিধ্বসে ক্ষতিগ্রস্থদের বা 'সিডর' পরবর্তীকালে ত্রানসংগ্রহে অথবা শীতার্তদের জন্য বস্ত্র সংগ্রহে ব্লগারদের আন্তরিক উদ্যোগে কমতি ছিলনা। নিজ নিজ পেশাগত গণ্ডি ছাপিয়ে জাতীয় ও জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে ব্লগাররা এক কাতারে দাঁড়িয়েছে নির্দ্বিধায়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গণসাক্ষর সংগ্রহ ছিল এক বলিষ্ঠ উদ্যোগ। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধী ও তাদের প্রশয়দাতাদের বর্জন করার সচেতনতায় ব্লগ ছিল মুখর। ব্লগাররা তেমনিভাবে সচেতন ছিল টিপাইমুখ বাঁধ নির্মানের বিরোধীতায়। আন্তর্জালে কখনো কখনো যখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তথ্য-উপাত্তগুলোর স্বল্পতা অনুভব হয় তখনই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ব্লগে এতো বেশী তথ্য উঠে আসে যে হলফ করে বলা যায় অদূর ভবিষ্যতে বাংলা ব্লগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষায় আন্তর্জালে একটি সম্পূর্ণ তথ্যাগার হয়ে উঠবে। বিজয়ের মাসে ব্লগের পাতায় যেমন জাতীয় পতাকা উড়তে দেখা যায় তেমনি হাইতিতে হয়ে যাওয়া ভূমিকম্পে হতাহতদের আর্তনাদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে শোকাবহ চিহ্ন উঠে এসেছে ব্লগ-প্রচ্ছদে। খুব সাম্প্রতিককালে জলবায়ু বিপর্যয় নিয়ে একটি নাড়াচাড়া চোখে পড়ছে ব্লগারদের মধ্যে যা তরুণ ব্লগার এবং সর্বোপরি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক ইতিবাচক স্বাক্ষর রাখবে বলে আশা করা যায়।

ব্লগে যেমন কিছু সংখ্যক পরিচিত কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিকদের বিচরন রয়েছে তেমনি সাধারণ ব্লগাররা ভেতরের লুকায়িত প্রতিভা, দক্ষতার সাথে আত্ম-সাক্ষাৎ লাভ করে এক সময় কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিকরূপে আত্মপ্রকাশ করছে। ব্লগারদের সাহিত্যচর্চা ব্লগের পাতা ছাড়িয়ে এখন একক উপন্যাস বা কবিতার বইরূপে প্রকাশ পাচ্ছে। গত বইমেলায় নতুন লেখকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ছিল বাংলা ব্লগের ব্লগাররা। এছাড়াও সামহোয়্যার..ইন ব্লগে প্রকাশিত বিভিন্ন ব্লগারদের গল্প-কবিতা নিয়ে এখন পর্যন্ত মুদ্রিত হয়েছে 'অপর-বাস্তর' এর তিনটি পর্ব। প্রথম আলো ব্লগের ব্লগারদের যৌথ প্রয়াসে লিখিত উপন্যাস ২০১০ সালের একুশে বই মেলায় প্রকাশের প্রহর গুনছে।

ব্লগে ব্লগারদের এই সাবলীলতা সবসময় যে বিরাজমান থাকে তা নয়। বাড়োযারী মানুষের ভিড় যেখানে হয় সেখানে কিছুটা বিশৃংখলতার অবকাশ থেকেই যায়। তদুপরি ছদ্মনামে আত্মপ্রকাশের সুযোগ থাকায় কেউ কেউ আলোচনায় যুক্তির বদলে আক্রমনাত্মক হয়ে ওঠেন। ফলে প্রয়োজন হয় কর্তৃপক্ষীয় হস্তক্ষেপের। প্রয়োজন হয় ব্লগিয় নীতিমালার। কর্তৃপক্ষ ও সাধারণের মাঝে অদ্ভূত রেশারেশি হলো চিরন্তন বাস্তবতা। ব্লগেও তাই কর্তৃপক্ষ কখনো যেমন নন্দিত হন, কখনো চরম নিন্দিতও হন। ব্লগের নীতিমালা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তাতে সংযোজন, সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ব্লগে মডারেশনের প্রয়োজনীয়তা যেমন বোধ করেন ব্লগাররা তেমনি সঞ্চালক বা মডারেটরদের হস্তক্ষেপ নিয়ে ক্ষোভেরও কমতি নেই। ব্লগ হয়ে ওঠে মান-অভিমানের কেন্দ্রস্থল। ফলে একটি অবধারিত, অমীমাংসিত বিতর্কের সূত্রপাত হয় – মডারেশন নাকি নো-মডারেশন!

আনুপাতিকহারে ব্লগে মেয়ে ব্লগারদের সংখ্যা কম হলেও চিন্তা-ভাবনার গভীরতা ও বলিষ্ঠতার কারণেই তাদের কারো উপস্থিতি এড়িয়ে যাওয়ার মত নয় । মেয়েরা যেমন রান্নার রেসিপি তুলে দেন ব্লগে তেমনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায়, ভ্রান্ত ধারণায় তাদের মতামত বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হন। ব্লগে কখনো কখনো ছোটখাট অপ্রীতিকর ঘটনাগুলোতে মেয়ে হিসেবে বিব্রত না হয়ে বরং চৌকষহাতেই সামলে নিচ্ছেন তারা। এক্ষেত্রে অনেক সহ-ব্লগাররাও বেশীর ভাগ সময়েই যথেষ্ট উৎসাহব্যঞ্জক ভূমিকা পালন করেন, যা আমাদের সুশিক্ষা ও সুরূচির পরিচয় দেয়। যুগের পরিবর্তনে, সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে মেয়েরা এগিয়ে এসেছে- এর এক ইতিবাচক প্রতিফলন হলো বাংলা ব্লগে মেয়েদের সমাবেশ।

বাংলা ব্লগ ও ব্লগিং যে যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে তা এক বাক্যে স্বীকার করবেন সবাই। তবে এও সত্য যে, বাংলা ব্লগগুলোর মধ্যে একটা সূক্ষ প্রতিযোগিতাও রয়েছে। এই উন্মাদনাকে উস্কে দিতেই, এই প্রতিযোগিতাকে স্বীকৃতি দিতেই যেন জার্মানীর আন্তর্জাতিক সম্প্রচার কেন্দ্র ডয়চে ভেলে ষষ্ঠবারের মত সেরা ব্লগ প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে যেখানে এই প্রথমবারের মত বাংলাভাষাকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। অর্জন কেবল এটুকুই নয় আদতে। সামহোয়্যার ইন ব্লগ ও বাংলা ব্লগের অগ্রযাত্রা একই সাথে চার বছর পার করে পাঁচ বছরে পা দিয়েছে। বাংলা ব্লগকে এখন শক্তিশালী বিকল্প গণমাধ্যম বললে ভুল হবেনা মোটেও। দেশের সীমা ছাড়িয়ে প্রবাসী বাঙালিরাও মাতৃভাষায় প্রতি তাদের আকুলতা মেটান বাংলা ব্লগে। এই আবেগকে বেগবান করতে প্রায় বছরখানেকেরও বেশী পক্ষ-বিপক্ষের মতামত-আলোচনা-পর্যালোচনা শেষে গত ১৯শে ডিসেম্বর ২০০৯ –এ প্রথমবারের মত 'বাংলা ব্লগ দিবস' পালিত হলো । বিভিন্ন ব্লগের একগুচ্ছ ব্লগারদের আগমনে মুখরিত, আন্তর্জালে সরাসরি সম্প্রচারিত সেদিনের জমায়েতে ডঃ আনিসুজ্জামান দিবসটি ঘোষনা করেন। ইতিপূর্বে ব্লগাররা অবশ্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনের ব্লগ ডে তথা ব্লগ দিবস হিসেবে ৩১শে অগাস্টের সাথেই কেবল পরিচিত ছিলেন।

বাংলা ব্লগ নিঃসন্দেহে বাংলা ভাষাকেই জনপ্রিয় করছে। বিগত বছরগুলোতে সফলতা-ব্যর্থতার পাল্লা মেপে বাংলা ব্লগিং নিয়ে সব রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষাকে সফল বললে তা ভুল বলা হবে না কোনভাবেই। বাংলা ব্লগিংয়ের বোররাকযাত্রা অব্যাহতই থাকবে নিঃসন্দেহে। সুতরাং ব্লগাকাশে নিজের নামটি জ্বল জ্বল করতে দেখতে চাইলে আর দেরী না করে নীতিমালা পড়ে-বুঝে একমত পোষনপূর্বক আপনার নিক্ (নাম) রেজিস্ট্রেশন করুন … … … এক্ষুনিই!

***
একটু পুরনো একটি লেখা যা পুরনো ব্লগারদের জন্য চর্বিতচর্বন হলেও ব্লগাতিহাস জানতে নতুন ব্লগারদের জন্য কিছুটা হলেও সহায়ক হবে আশা রাখি।

লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল: সাময়িকী, ২০১০-০২-০৪