কবন্ধের ’মম শির’ বচন!

আইরিন সুলতানাআইরিন সুলতানা
Published : 6 Nov 2011, 03:06 PM
Updated : 6 Nov 2011, 03:06 PM

আলখাল্লা পরিহিত ব্যক্তি পোষাকের ঘের সামলিয়ে ধারাল তলোয়ার দিয়ে পলকে অবনত মস্তক কেটে ফেললেন অভূতপূর্ব নিপুণতায়! একটা মুন্ডু ঝপাং করে মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খেলো তৎক্ষণাৎ! ফিনকি দিয়ে ছলাৎ করে উঠলো তাজা রক্ত! আর মুণ্ডুহীন দেহটা বেঁকে গেল নিস্তেজতায়! তারপর কেউ সেই নিথর দেহটা স্ট্রেচারে তুলে দিল। কেউ কম্পনহীন হাতে কাটা শিরটা রেখে দিল দেহের পাশে! যেন আহত খেলোয়াড়ের সাথে সাজঘরে ফিরে যাচ্ছে দলিত ফুটবলটা! চারপাশে অসংখ্য দর্শনার্থীদের ভিড়ে পুরো আয়োজন নিয়ম মেনেই ঘটছিল বরাবরের মতই। এই দুর্ষর্ধ তলোয়ারবাজি অলিম্পিক গেমসে নতুন সংযোজিত কোন 'সোর্ড ইভেন্ট' ছিল না, এ ছিল সাম্প্রতিককালে সৌদিতে রাষ্ট্রিয়ভাবে 'জানের বদলে জান' বিচারের সফল মঞ্চায়ন!

ইউটিউবে আট বাংলাদেশির শিরশ্ছেদের ভিডিও খুঁজতে গিয়ে এতো এতো শিরশ্ছেদনামা পাওয়া যাবে তা অনেকেই বোঝেনি! স্নায়ুতে চাপ ফেলা কোন ইংরেজি সাইকো সিনেমার ক্লিপস কিনা ভেবে বিভ্রম ঘটছিল অনেকের! সে বিভ্রান্তি দূর হয়ে সম্বিৎ ফেরার পর কেউ ভাবছিলেন নরবলি প্রথা চালু হলো কিনা!

একদল যখন এমন করে ভাবছিলেন, তখন কতক ভাবছিলেন পুরো বিপরীত! 'মানুষেতে সুরাসুর' – কবি বড় নির্মম সত্য বলেছেন। যে মানুষে উদ্ভাসিত হয় মানবতা, সে মানুষেতেই প্রকট হয় পশুত্ব! ৮ জনের শিরশ্ছেদকে সমর্থন করে পৈশাচিক উন্মাদনায় কারো উল্লাস স্তম্ভিত করে দিল! ৮ জন লোকের শিরশ্ছেদে কারো কারো স্বস্তির নি:শ্বাস ঘাড়ের উপর এসে পড়ল। এ কাদের মাঝে বসবাস! এ সমাজে এমনও আছে, যারা ভীন দেশের বর্বর শাস্তি ব্যবস্থাকে পূজনীয় আইন মেনে বাংলাদেশেও সে আইন অনুসরণ করার মন্ত্রনা দেয়। সাধু সাবধান! সামলে চলুন, নচেৎ নির্ঘাৎ যাবে গর্দান!

অনেকে বলবেন, সাধু হলে গর্দান যাবে কেন? ওই আট জন চোরছ্যাচ্চোর। ওরা হত্যাকারী এক মিশরিয় দাড়োয়ানের। ওদের জন্য 'নো মার্সি'! 'নো মার্সি'! বিদেশে বাংলাদেশিদের চুরি-আইন ভঙ্গসহ নানাবিধ অপরাধ কানে আসে আমাদের। তাতে দেশের সুনাম ক্ষুন্ন হয়। প্রবাসীরা লজ্জিত হন। দেশ ও জাতিকে এভাবে লাজলজ্জায় ফেলার শাস্তি স্বরূপ আট জন বাংলাদেশি ঘৃণিত হয়ে যায়। তাতে শিরশ্ছেদ প্রথার ঔচিত্য নিয়ে প্রশ্ন তোলার প্রয়োজনীয়তা অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায়। তাই একদল যখন এমন প্রকাশ্য শিরচ্ছেদ কনসার্টকে একটি মানবতা বিরোধী প্রথা জানিয়ে ঘৃণা প্রকাশ করেন, তখন অন্যদল আসেন শিরশ্ছেদের যথার্থতা প্রমাণে অমানবিক যুক্তির পসরা নিয়ে।

বলা হলো, ফাঁসির তুলনায় শিরচ্ছেদ 'ব্যাথ্যামুক্ত পদ্ধতিতে সবচেয়ে কম সময়ে' মৃত্যুর নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে! বলা হলো, প্রকাশ্যে শিরচ্ছেদের শাস্তি দর্শনে সমাজে অপরাধ প্রবণতা কমবে। প্রশ্ন তোলা হলো, যদি আইনগত পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ড হিসেবে ফাঁসি থাকতে পারে, তবে শিরশ্ছেদ নয় কেন? জেনে রাখা ভাল, বিশ্বের প্রায় ৪৯% দেশে ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট প্রথা বিলুপ্ত। ১৭% দেশে কাগজে-কলমে রয়ে গেলেও এরকম দণ্ডবিধি চর্চিত নয় ১০ বছরেরও অধিক সময় ধরে। কিছু দেশ কেবল মাত্র বিশেষ পরিস্থিতিতে (যেমন, যুদ্ধাপরাধ) ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট দিয়ে থাকে।

বিতর্ক বস্তুত ঘাড়ের উপর মাথা বহাল রাখা না রাখা নিয়ে। মৃত্যু কি মস্তকসহ হবে না মস্তকবিহীন? বেঁচে থাকার কথা এ আলোচনার বাইরে রয়ে যায়। জন্মিলে মরিলে হইবে! মৃত্যু অমোঘ। মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। তথাপি আমরা তো অকালে-অপঘাতে মৃত্যু চাইনা। আমরা সড়ক দুর্ঘটনায় মরতে চাইনা। ভুল চিকিৎসায় মরতে চাই না। আমাদের বেঁচে থাকার লড়াইয়ে তাই সামিল হয় একটি সুন্দর, স্বাভাবিক মৃত্যুর প্রত্যাশা। মৃত্যু নিশ্চয়ই ভীতিকর, তবু আমরা চাই মৃত্যু দর্শন যেন বিভৎস না হয়। শিরশ্ছেদ ও এই প্রথার খুল্লামখুল্লা কার্যসম্পাদন মৃত্যুর এক বিভৎস উপস্থাপন। একটা জনগোষ্ঠির শিশু-যুবা-বয়োজেষ্ঠরা এমন একটি বর্বর দৃশ্যকে 'স্বাভাবিকভাবে' দেখে ঘরে ফিরলে, তাদের মনোজাগতিক সুস্থতা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া জরুরী। শাস্তি হিসেবে বিভিন্ন দেশে ফাঁসি পদ্ধতি বহাল থাকার অজুহাত তুলে শিরশ্ছেদকে গ্রহণযোগ্য করার কারো কারো প্রচেষ্টাকেও অসুস্থতা বলা জরুরী।

যদি প্রকাশ্য শিরশ্ছেদে অপরাধ প্রবণতা কমে যেত, তবে একবার-দু'বার শিরশ্ছেদের পর অপরাধ লুপ্ত হওয়ার কথা ছিল সৌদিতে। অথচ বিবিসির প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে ২০০৭ সালে ১৮৫ জনের শিরশ্ছেদ হয়েছে রাষ্ট্রিয় আইনি ব্যবস্থায়। ২০০৮ সালে জানুয়ারি থেকে আগস্টের মধ্যে ৭১ জনের শিরশ্ছেদ কার্যকর হয়েছে! সৌদি রাষ্ট্র সঠিক পরিসংখ্যান না দিলেও কমপক্ষে ১,৬৯৫ জনের ধড় থেকে অবলীলায় শির আলাদা করা হয়েছে ১৯৮৫ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে, এর ৮৩০ জন ছিল বিদেশি নাগরিক। ২০১০ সালে ২৭ জনের বা তারো বেশি শিরশ্ছেদ সম্পন্ন হয়েছে।

বিলুপ্ত বলি প্রথাতে এক কোপে মাথা আলাদা করার রেওয়াজ ছিল। আমরা জানি, এক কোপে গরু-ছাগল কোরবানী হালাল পদ্ধতি নয়। তাহলে তলোয়ারের এক কোপে মানুষ হত্যা কিভাবে হালাল বিচার হয়? ব্যক্তির জিঘাংসা চরিত্র আর রাষ্ট্র কর্তৃক কিসাস (সোজা বাংলায় এর অর্থ বদলা) অনুসরিত বিচার চরিত্র- দু'টো দৃশ্যত-কার্যত এক হলে তা শাসন ব্যবস্থার নামে খোদ রাষ্ট্রের ঘাতক মনোবৃত্তিকে নির্দেশ করে। আশেপাশে হাত কাটা, চোখ উপড়ানো মানুষের আনাগোনা দেখলে ভাবার আর সুযোগ নেই কোন শক্রুর অতর্কিত হামলায় এমন হয়েছে। কারণ হামলাকারী তো রাষ্ট্র নিজেই!

'সৌদির আইন কি আপনি পরিবর্তন করতে পারবেন? ওই দেশে গেলে তাদের আইন মেনেই চলতে হবে' – এমনটাও বলেন কেউ। আমরা সৌদির আইন সরাসরি পরিবর্তনের ক্ষমতা না রাখলেও, এমন ন্যাক্কারজনক রাষ্ট্রিয় জিঘাংসার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারি। আন্তর্জাতিকভাবে জনমত গড়ে তুলতে পারি। এই প্রতিবাদে সৌদিতে অবস্থানরত ২০ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিকের অবস্থান অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে বলে অনেকে দোহাই দেন। সৌদি আমাদের জন্য বিশাল শ্রমবাজার – এই তথ্যের প্রকৃত চিত্র হলো সৌদিতে আমরা একটি বিশাল 'চাকর-বাজার' গড়ে তুলেছি। যৌন নির্যাতনসহ অন্যান্য শারীরিক নির্যাতনের কথা জেনেও আমরা আমাদের নারীদের ওভেন-ফ্রিজ-আয়রন-ওয়াশিং মেশিন চালানো শিখিয়ে সৌদি শেখদের বাড়িতে গৃহপরিচারিকা যোগান দিতে উদ্যোগী হই। মানবেতন জীবনযাপনের বহু অভিযোগ-অনুযোগ-ক্ষোভের কথা জানার পরও আমরা শ্রমিকগোষ্ঠি পাঠানো জারি রেখেছি সৌদিতে। এদের শিক্ষা-জীবনযাপন নিজ দেশে উন্নত পরযায়ের নয়, তাই এদের কাছে একটি ভিন্ন দেশে-ভাষায়-পরিবেশে-সমাজ ও আইন ব্যবস্থায়, বিশেষত সেখানেও যদি নানাবিধ চাপের মুখে তাদের দিনযাপন করতে হয়, সার্বিকভাবে সুশৃংখল আচরণ প্রত্যাশা করাটা মুর্খতা। আর একটা তিক্ত সত্য হলো, ভাগ্যান্বেষনে পাড়ি দেয়া আমাদের শ্রমিকদের ভাল আচরণের বিপরীতে অন্তত সৌদি থেকে এমন বেশি কিছু মর্যাদা অর্জন সম্ভব হবে না- ঘাম ঝরানো শ্রমিকদের বড়জোর ভাল ভৃত্য হিসেবে পরিচিতি ঘটবে! তারপর আরো আরো শ্রমিক রপ্তানি! শ্রমবাজারের নামে আরো বড় চাকর-বাজার!

আট বাংলাদেশির শিরশ্ছেদ বিষয়ে আরো যে সকল প্রসঙ্গ উঠে এসেছে- (১)আট বাংলাদেশি আত্মপক্ষ সমর্থনে কতটুকু সুযোগ-সুবিধা পেয়েছিল (২) সৌদি সরকার বাংলাদেশ সরকারকে যথাযথ সময়ে আট বাংলাদেশির কিসাস কার্যকরণ সম্পর্কে অবহিত করেছিল কিনা (৩) আট বাংলাদেশিদের, তারা অপরাধী হোক বা না হোক, তাদের শিরশ্ছেদ বাতিলে বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা যথাযথ ছিল কিনা (৪) লাশ ফিরিয়ে আনতে সরকার ব্যর্থ হলো কেন।

সরকারের উদ্যোগ নিয়ে অনেকের আস্থাহীনতা থাকলেও আগ বাড়িয়ে অনেকেই সৌদি বিচার ব্যবস্থার গুনগান গাইতে যথেস্ট তৎপরতা দেখাচ্ছেন। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, ৫৪ বছর বয়সী ইন্দোনেশিয়ান গৃহপরিচারিকার শিরশ্ছেদের কথা তার পরিবারকে জানানোর তোয়াক্কা করেনি সৌদি। মুনিবকে হত্যার কিসাস হিসেবে গৃহপরিচারিকার মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল বটে, তবে উক্ত মুনিবের বিরুদ্ধে গৃহপরিচারিকাকে ধর্ষণ প্রচেষ্টার যে অভিযোগ ছিল, তার কোন কিসাস হয়নি। প্রতিবাদ হিসেবে সৌদিতে শ্রমিক পাঠানো বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেনি ইন্দোনেশিয়া। শ্রমিকদের সাথে সদাচরণ বজায় রাখার চাপ প্রয়োগে ইন্দোনেশিয়ার সরকার সৌদি সরকারকে শর্তারোপও করেছিল। উল্লেখ্য, সৌদিতে ১৫ লাখ ইন্দোনেশিয়ান শ্রমিক ছিল।

আমাদের এও মনে করতে হবে, মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রাপ্ত ব্রিটিশ নাগরিক স্যাম্পসন সৌদি থেকে শিরসহ জীবিত ফেরৎ গিয়েছিল নিজ দেশে। অথচ আমরা আট মৃত ব্যক্তির লাশ পর্যন্ত ফেরৎ পাইনি। বলতেই হবে, প্রবাসে বাংলাদেশি শ্রমিকদের অনিয়ম-বিশংখল আচরণের চেয়ে আমাদের নতশির কূটনৈতিক তৎপরতা, বুকের উপর শির এলিয়ে ঘুমানো দূতাবাস বহুগুণ বেশি লজ্জাজনক। আমাদের রাষ্ট্রনীতি আর পররাষ্ট্রনীতি মাথা নীচু করে থাকে বলে আমাদের শির কাটা পড়ে সৌদির কিসাসে।

অ্যামনেস্টির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, যেখানে বাংলাদেশি শ্রমিকেরা কাজ করতো, সেখানে একটি চক্র প্রায়ই বৈদুতিক তার চুরি করতো । উক্ত চক্রের লোকদের সাথে বাংলাদেশি শ্রমিকদের সংঘর্ষকালীন মিশরিয় গার্ড নিহত হয়। শুরুতে আট শ্রমিকের মৃত্যুদণ্ডাদেশ নিয়ে আমরা যেভাবে জেনেছিলাম, তাতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের ডাকাত হিসেবে প্রচার করা হয়। অথচ অ্যামনিস্টির প্রতিবেদন পড়লে এমন ধারনার সুযোগ নেই। এ তথ্যের পর বাংলাদেশ সরকারের দ্বাযিত্ব প্রকৃত ঘটনা তদন্ত করে দেখা, প্রয়োজনে সৌদি সরকারকে 'শো-কজ' করা। সরকারের উচিৎ ইন্দোনেশিয়ার মত আমাদের শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষায় 'মেমোরেন্ডাম অফ আন্ডারস্ট্যাংডিং' শর্তাবলী প্রস্তাব ও শর্ত মানতে সৌদিকে হুশিয়ার করা।

যাদের শিরশ্ছেদ হয়েছে তারা অপরাধী হোক বা না হোক, তারা বাংলাদেশি হোক বা না হোক, একটি রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থা এমন মর্মন্তুদ একটি পদ্ধতিকে প্রশ্রয় দিলে তার প্রতিক্রিয়ায় প্রতিবাদলিপি পেশ নিজ দেশ ও মানবতার স্বার্থরক্ষাই করবে আগামিতে। পাশাপাশি এমন অনভিপ্রেত ঘটনা এড়াতে, আমাদের নিজ দেশে শিক্ষা ও জীবনযাত্রার মান বাড়ানোর দিকে মনোযোগী হতে হবে। সৌদি শেখদের ভৃত্য হিসেবে শ্রমব্যয় করার চেয়ে দেশে শিক্ষিত-দক্ষ-স্বাবলম্বী শ্রমশক্তি গড়ে তোলা জাতির জন্য মর্যাদাকর। এমন জনশক্তির জন্য বিকল্প শ্রমবাজার খুঁজে পাওয়াও দুস্কর হবে না। আমাদের শ্রমিকেরা সৌদির খাপ খোলা তলোয়ারের ছায়ায় মাথা নুইয়ে পড়ে আছে – এ দৃশ্যের পুরনাবৃত্তি হবে না, এমন নিশ্চয়তা দিতে হবে আমাদের সরকারকেই।