নিরাপত্তার রাত ও নির্ঘুম আমি

লিয়া সরকার
Published : 17 Oct 2012, 08:02 AM
Updated : 17 Oct 2012, 08:02 AM

রাত্রি জাগতে আমার ভীষণ ভাল লাগে । যখন বিকেল গড়ায়, সূর্য অস্ত যেতে শুরু করে তখন থেকেই মন অদ্ভুত ভাললাগায় আবিষ্ট হয় । কারণ এই দীর্ঘ রাত্রিতে নেই এত যান্ত্রিকতা, নেই পারিপার্শ্বিক টানাপোড়নে নিজকে মানিয়ে নেয়ার বৃথা চেষ্টা। যে রাত্রি একান্তই আমার ,নিজকে বিশ্লেষণের, অনুভবের। এসব ভেবেই সত্যিই আমার অনেক খুশি লাগে,আমি সারা দিনে রাত্রির প্রতীক্ষা করি।

রাতে আমি নিজকে ভাংচুর করি , সকালে আবার নতুন করে জন্ম নেই। আমার মা বলেন, রাত্রিতে নাকি আমি অপার বিলাসী হই। বিলাস বহুল জীবন আমার পছন্দ। হোক না সেটা সুখ বিলাস কিংবা দুঃখ বিলাস। দুখের রাতে আমি অনেক কাঁদি । আমি কাঁদতেও ভালবাসি। কান্না থেকে আমি পালিয়ে বেড়াই না । অঝর ধারায় শ্রাবণের বৃষ্টি মত কান্না, চোখের পাতা ফুলে ভারি হয়ে যাওয়া কান্না। নাকে তুঁত ফলের গোলাপি লাল রঙ । গাল ভিজে আর আমি গাল মুছি ,আবার ভিজে আবার মুছি ,যেন পুনঃপুনিক খেলছি। আমি দুঃখকে লালন করছি,কঠিন মানুষের মত ঝেড়ে ফেলছি না। শোকে ডুবে যাচ্ছি আবার সাঁতরে ভাসছি।এক সময় কান্না থেমে যায়। হয়ত তখন গভীর রাত কিংবা পাঁশের মসজিদ থেকে আযান শোনা যাচ্ছে। আমাকে এখন থামতে হবে , আমি নামাজ পরব। নিজকে তখন সুখী লাগে । মন্দ লাগা ভাল লাগার অনেকটা সময় আমি আমার রুমের বারান্দায় কাটাই । বারান্দার টবের গাছগুলো আমার সাথে জেগে থাকে । তিন তলার এই বারান্দা থেকে সামনের রাস্তাটাকে দেখতে আমার ভীষণ ভাল লাগে । রাস্তার দুপাশের বাড়ীগুলোর আলো নিভে গেছে, কোথাও টিমটিম করে জ্বলে জেগে থাকার সাক্ষী দিচ্ছে। সুখের পল গুলো কেন যেন রাতে আরও স্বর্গীয় হয়ে যায় ।

আমি এতক্ষন আমার অনুভব তুলে ধরেছি যার একটা বিশেষ কারণ আছে।

আমি তো মাঝে মাঝে আয়েশ করে রাত জাগি,কিন্তু একটা মানুষ প্রতিটা রাত জেগে থাকে । সে হল নৈশ প্রহরী। সে রাস্তার এ মাথা থেকে ও পর্যন্ত পায়চারি করে আর মাঝে মাঝে বাঁশি ফুঁ দিচ্ছে। জানান দিচ্ছে আমি জেগে আছি,তোমরা ঘুমাও। রাতের সাথে সাথে তার চোখের পাতাও ভারী হচ্ছে কিন্তু চোখ বোজা বারন, টানটান করে রাখতে হবে চোখের পাতা। ঘুম ঘুম চোখ,তবু দৃষ্টি সজাগ ।

বাড়ি ঘুমাচ্ছে পাড়া ঘুমাচ্ছে,শহর ঘুমাচ্ছে ,দেশ ঘুমাচ্ছে। তাকে তো জাগতেই হবে, ঘুমন্ত সমাজের নিরাপত্তার দায়িত্ব যে তার কাঁধে। চাহে তো নববধূর একাকিত্তের কান্নায় রাত্রি ভিজুক,চাহে তো আদরের সন্তান জ্বরে ভুগুক,বায়না ধরুক বাবা আজকে যেও না ,আমার পাশে থাক। ফেরাতে হবে তাকে হতভাগী মায়ের আবদার। হোক না কনকনে ঠাণ্ডা পৌষ মাঘের রাত, বৃষ্টি ভেজা ,পূর্ণিমার তারা ভরা রাত, কিংবা অমবস্যার আঁধারে মোড়া । রাতের এসব আবেদনে সাড়া দেয়ার সময় তার নেই, সে যে মহাব্যস্ত।

নিরাপত্তার দায়িত্ব দিয়ে তার হাতে তুলে দেয়া হয়েছে কেবল একটি লাঠি । এতবড় দায়িত্তের প্রতিকূলতা সে একটি লাঠিতে কিভাবে ঠেকাবে ? কেউ তা ভাবল না । তার ভয় পেলে চলবে না, তার ভয় পেতে নেই।

ভোরে বাড়ি ফেরে তাকে ভাবতে হয় বেশি ঘুমানো যাবে না । ছুটতে হবে অন্য কাজে ,এই টাকায় সংসার যে চলেনা। ধাঁর দেনা করে আর কতদিন? কখনো মাসের পর মাস চলে যায় বেতন মিলে না। যারা শহরে এ দায়িত্তে আছেন,তাদের প্রায় সবার পরিবার গ্রামে থাকেন । কি মানবেতর জীবন, বলে শেষ করা যাবে না ।এছাড়া বছরের পর বছর চাকুরি করলেও তাদের চাকুরি স্থায়ী করা হয় না।

শালিখা উপজেলার ৬৮ জন গ্রাম পুলিশের বেতন নেই দীর্ঘ ৩ মাস যাবত।

ইউনিয়ন পরিষদ থেকে মাসে চৌকিদার প্রতি ৮০০ টাকা দফাদার প্রতি ৯০০ টাকা করে দেয়া হয়। সরকার থেকে মাসে চৌকিদার প্রতি পায় ১১০০ ও দফাদার প্রতি ১২০০ টাকা করে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে পরিচালিত পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্পের এক নৈশ প্রহরী লোকমান হোসেন ২৮ মাস যাবত বেতন পাচ্ছেন না ।

ঝিনাইদহের হরিনাকুনডু উপজেলার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নৈশ প্রহরী মীর শফিকুজ্জামান ।দীর্ঘ ১১ বছর বেতন ভাতা বন্ধ ছিল ।এবং এবছর তিনি একত্রে ১১ বছরের বেতন পাচ্ছেন ।যা সর্বমোট ৭ লাখ ৮৪ হাজার টাকা । কিন্তু উপজেলা প্রকৌশল অফিস ও উপজেলা হিসাব রক্ষন অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারীরা তাকে মাত্র ৪০ হাজার টাকা দেন।বাকি টাকা তারা নিজেদের জন্য রেখে দেন। এখন দিনের পর দিন ঘোরাচ্ছে তাকে অবশ্য এ বিষয়ে তদন্ত চলছে । টাকার শোকে তিনি এখন শয্যাশায়ী । হয়ত তদন্তে বাকি টাকাটাও যেতে পারে।বছরের পর বছর ধরে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তিনি ।

ওরা স্ত্রী ,সন্তানের আবদার মেটানো ত দুরের কথা ,সংসার চালাতে অক্ষম । এমন নজীরও আছে অনেকে দেনার দায়ে আত্মহত্যা করেছেন । এ রকম বহু উদাহরণ দেয়া যাবে । এর মধ্যে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেকে সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হয়েছেন ।

আমরা হয়ত আপসোস করে বলব এ বিষয়ে সরকারের নজর দেয়া উচিত ।হ্যাঁ সরকারের উচিত তাদের বেতন ভাতা বাড়ানো ,সঠিক সময়ে তা প্রদান ,চাকুরির স্থায়ীকরন ,উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান ইত্যাদি ।

কিন্তু না ,আমাদের করার অনেক কিছুই আছে ।বাড়ি বা মহল্লাতে আমরা যাদের নিয়োগ দেই, আমরা তো তাদের ব্যপারে দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে পারি ।

কত টাকাই তো বিলাসিতায় ব্যয় করি , সেখান থেকে একটু যদি তাদেরকে প্রতি মাসে বেতন হিসেবে বাড়িয়ে দেই,তাহলেই তো হয়ে যায় । আমাদের একটু সাহায্যে নেমে যেতে পারে ঐ লোকটির কাঁধের বোঝা , বেঁচে যেতে পারে একটি পরিবার । সে তো আমাদের মতই মানুষ । রাতের ঘুম হারাম করে যে আমাদের নিরাপত্তা দিল আমরা কি তার জন্য কিছু করতে পারি না ? আমরা তাদের কাছ থেকে শুধু সালাম আশা করি । কেন আমরা কি জিজ্ঞাসা করতে পারি না ,তার কোন সমস্যা হচ্ছে কি না , সে ভাল আছে কিনা ?

এত মূল্যবান রাত্রি এত অল্প দামে বেচে দিল ।কত মহান তারা। আমরা আসলে নির্বোধ ,আমাদের ক্ষমা কর। আসুন আমরা বলি –

অনেক ধন্যবাদ,

সকাল হয়ে গেছে ,আমরা এখন জেগে গেছি ,এবার তুমি ঘুমাও।
তথ্যসূত্র – প্রথম আলো ও অন্যান্য ।
লিয়া সরকার ।