বুড়িগঙ্গার কান্না

লীনা দিলরুবা
Published : 25 Sept 2011, 04:35 AM
Updated : 25 Sept 2011, 04:35 AM

"অনেক নদী আছে বর্ষার প্লাবনে ডুবিয়া তারা নিশ্চিহ্ন হইয়া যায়। পারের কোনো হদিস থাকে না, সবদিক একাকার। কেউ তখন বলিতে পারে না এখানে একটি নদী ছিল। সুদিনে আবার তাদের উপর বাঁশের সাঁকোর বাঁধ পড়ে। ছেলেমেয়ে বুড়ো-বুড়িরা পর্যন্ত একখানা বাঁশে হাত রাখিয়া আর একখানা বাঁশে পা টিপিয়া টিপিয়া পার হইয়া যায়"… অদ্বৈত মল্লবর্মনের কালজয়ী উপন্যাস 'তিতাস একটি নদীর নাম' এর পুরোটা জুড়ে রয়েছে নদীর কথা-নদীর আর মানুষের কথা। বাংলা সাহিত্যেই শুধু নয় সমগ্র বিশ্বসাহিত্যে নদী নিয়ে এরচেয়ে উৎকৃষ্ট আর কোন উপন্যাস রয়েছে কী না তা তর্কসাপেক্ষ; নদী আর নদীর তীরের মানুষদের নিয়ে এটিই যে শ্রেষ্ঠ উপন্যাস তা বোদ্ধারা মেনে নিয়েছেন। শ্রেণীকরণ করে নদীকে টেনে না আনলেও বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের মধ্যে তিতাস একটি নদীর নাম স্বনামে খ্যাত।

ছোটবেলায় আমরা পড়েছি, বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। বাংলাদেশকে নদীগুলো জালের মত জড়িয়ে রেখেছে। নদী বাংলাদেশের প্রাণ, কথাটিকে উল্টো করে বললে বলা যায়- নদীর প্রাণ বাংলাদেশে প্রথিত! খ্রিষ্টিয় তৃতীয় শতকে সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ প্রশস্তিতে প্রথম পাওয়া যায় 'সমতট' বিষয়ক একটি নাম যার অর্থ- যে ভূ-ভাগে নদীতট সমভূমি, উঁচু-নিচু নয়। সমতটের সংলগ্ন 'বঙ্গাল' নাম থেকে পরে বাঙ্গালা, বাঙলা শব্দ এসেছে। অর্থাৎ নদী ঐতিহাসিকভাবে আমাদের চিহ্নিত করেছে- চিনিয়েছে।

বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা ঠিক কত তা নিয়ে বিতর্ক আছে। এর কোন স্থির উপাত্ত পাওয়া যায়না। খাল-নদী-উপনদী সবমিলিয়ে এর সংখ্যা ৭০০। কোনটি নদী আর কোনটি উপনদী তা নিয়েও কোন গ্রহনযোগ্য উপাত্ত নেই। কারণ মূল নদী থেকে প্রবাহিত প্রবাহিত শাখা নদী বা উপনদী বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন নাম ধারণ করেছে। এসব নদীকে পৃথকভাবে গণনা করলে আমাদের দেশে নদীর সংখ্যা প্রায় দু' হাজার। নদীগুলো মালা পরে প্রকৃতির এক অপার সৌন্দর্য হয়ে আমাদের দেশকে আলোকিত করে রেখেছে। একটি নদী কোন একটি বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, পরস্পর সম্পর্কিত নদীগুলো একটি আরেকটির সাথে চমৎকার বন্ধন গড়ে তুলেছে।

বাংলাদেশের প্রায় সব জেলা শহরের পাশে বা মধ্যিখানে বয়ে গেছে এমন অনেক নদী। ঢাকা জেলার প্রধাণ নদী বুড়িগঙ্গা। টাঙ্গাইলের দেিণ যমুনা নদী থেকে বের হয়ে মানিকগঞ্জ, সাভার, মিরকাদিম হয়ে মুন্সিগঞ্জের কাছে মেঘনা নদীতে গিয়ে মিশেছে ধলেশ্বরী। সাভার থেকে আরেকটি নতুন রূপ চলে এসেছে ঢাকামুখী- নাম নিয়েছে বুড়িগঙ্গা। আত্মজীবনী পড়া আমার প্রিয় পাঠাভ্যাস। কবির চৌধুরীর আত্মজীবনী পড়তে গিয়ে মনে হচ্ছিল এ কোন বুড়িগঙ্গা! চল্লিশের দশকে এমনি পঞ্চাশ তারপরও বিকেলে ঢাকার মানুষ বুড়িগঙ্গার তীরে বৈকালিক ভ্রমণে যেতেন। নৌকা করে ঘুরে বেড়াতেন নদীর এ মাথা থেকে ও মাথায়। আর সেই বুড়িগঙ্গা আজ একটি কাল ইতিহাস, ক্ষয়ে যাওয়া গৌরবের নাম। বুড়িগঙ্গার পানিতে এখন শুধুই দূষণ। বুড়িগঙ্গায় আজ আর কোন সুখবর নেই।

কাগজে-কলমে বুড়িগঙ্গা ৪৮ কি.মি.। বুড়িগঙ্গা গঙ্গা নদীর একটি ধারা যেটি প্রাচীনকালে ধলেশ্বরী হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়তো, পরবর্তীতে গঙ্গা আলাদা পথে চলে যায়। কিন্তু প্রাচীন গঙ্গা এ পথেই প্রবাহিত বলে এর নাম বুড়িগঙ্গা। সাভারের দেিণ পুনরায় ধলেশ্বরীতে এটি মিলিত হয়েছে এর উত্তর তীরেই আমাদের ঢাকা। ঢাকা নগরী তৈরী হয়েছিল এই নদীটিকে ঘিরেই। দক্ষিণে জিঞ্জিরা, কামরাঙ্গীর চর এলাকার মানুষের জীবিকা প্রধানত এই নদীটিকে ঘিরেই আবর্তিত কিন্তু দুষণে আক্রান্ত নদী আজ উৎকট গন্ধ ছড়িয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত করে তুলেছে। শুধু তাই নয় দখলের কালো থাবা ও পড়েছে বুড়িগঙ্গার বুকে। ঢাকা জেলা প্রশাসন পরিচালিত এক জরিপে দেখা গিয়েছে ২৪৪ জন অবৈধ দখলদার দখল করেছে বুড়িগঙ্গার ৫০ একর জমি। মসজিদ মাদ্রাসা করে একধরণের কৌশল অবলম্বন করে এই দখলের রাজত্ব দিনদিন বাড়ছে। নদীটির দুইপাড়ে কমপক্ষে ২০টি মসজিদ এবং ৮টি মাদ্রাসা রয়েছে। ছোট ছোট পদক্ষেপে এই দখল বানিজ্য চলে। হালকা নড়বড়ে ঘর দিয়ে প্রথমে নদী দখলের চেষ্টা করা হয় পরে সেখানেই গড়ে উঠছে বড় বড় দালান। একটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বুড়িগঙ্গাকে নগ্নভাবে দখল করে শুধু হাসপাতাল ভবন নয় গড়ে তুলেছে হাউজিং ব্যবসাও। প্রশাসন সব দেখে কিন্তু প্রভাবশালীদের বিপক্ষে কিছুই করতে পারে না।

***
তথ্যসূত্র : ইন্টারনেট এবং বাংলাদেশের নদ-নদীর ইতিকথা।