আমি গারো আদিবাসি, তাই আমারও অনুভূতিতে লাগে

লিনা জাম্বিল
Published : 24 May 2015, 05:53 AM
Updated : 24 May 2015, 05:53 AM

শুক্রবার ২২ শে মে ২০১৫। ছুটির দিন অনেক দেরি করেই ঘুম থেকে উঠেছিলাম সেদিন । সকাল ১০;৩০ টার দিকে একটা কল আসলো যে এক দাদার বড় বোন এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে । স্বভাবতই যেতে হবে আমাকে সেখানে । ময়মনসিংহ থেকে প্রায় ৬০ কিলো দূরে । তাড়াতাড়ি গুছগাছ করে রওনা হয়ে যাচ্ছি সাথে আরো ৫ হোন্ডা যুক্ত হলো আমাদের সাথে । যখন সব হুন্ডাগুলোতে তেলের পাম্পে পেট্রল ভরছে যখন আমি বসে অপেক্ষা করছি ঠিক তখনি আমার শ্বশুর বাড়ি থেকে একটি কল আসলো আমার শ্বশুর বাড়ি ফুলবাড়িয়া ময়মনসিংহ সেখান থেকে । ওপাড় থেকে বলছে আমাদের এক মেয়ে নাম বলল ঢাকায় থাকে সে, তার তো সর্বনাশ হয়ে গেছে গতকাল রাতের ঘটনা তুমি তো বিভিন্ন সংগঠনের সহিত জড়িত কি করা যায় একটু বুদ্ধি পরামর্শ দরকার। শুনে কি বলবো কোন ভাষায় খোঁজে পেলাম না আমি আর কোন উত্তরই দিলামনা তাকে ।

ফোন রেখে সাথে সাথেই চেষ্টা করলাম ঢাকায় কুড়িলে যোগাযোগ করার জন্য আমার খুব পরিচিত এবং সে একজন একটি সংগঠনের প্রাক্তন সচিব, আমি তখন রাস্তায় যাচ্ছি ধোবাউড়াতে। পুরো ঘটনা জেনে শরীরের রক্ত সঞ্চালন যেন কিছুক্ষণের জন্য থেমে গিয়েছিল, এমন মনে হচ্ছিল । তখন ভাটারা থানায় মামলার জন্য প্রস্তুতি চলছিল ।

মাথায় কাজ করছিল না, কেন এমন হবে কিছু দিন পরপরই! যা মানা যায় না, অথচ হাত পা বাঁধা অবস্থায় যেন পরে আছি, কিছুই করতে পারিনা । বিবেককে জাগ্রত করার রাস্তা খুঁজে পাই না। ঘুমন্ত অবস্থায় কোমায় যেন চলে গেছে এমন মনে হয় । নরপশুদের অমানবিক কাজ দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে যেন ।  বিবেক একদিন জাগ্রত হবে এটাই প্রত্যাশা থাকবে । একটু অন্যভাবে বিশ্লেষণের চেষ্টা করছি আদিবাসি হিসাবে ।

আদিবাসিদের চিন্তা চেতনা মানসিকতা আচরন চলন বলন সব কিছুই বাঙালিদের মত না । যদিও পড়াশুনা করে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে এখন তারপরও আদিবাসির রক্ত তার শরীরে প্রবাহিত তা বলার অপেক্ষা রাখেনা । আমি গারো আদিবাসি নিয়েই কথা বলছি, অপরাপর আদিবাসি সম্প্রদায় নিয়ে না । পোষাককে বেশির ভাগ সময় যৌন নির্যাতনের শিকারকে দায়ি করা হয়। কিন্ত সত্যিকার ভাবে গারো আদিবাসিদের পোষাক যদি বিবেচনা করা হয় তাহলে ১% এর জন্য দায়ী নয় বলে আমি বলতে পারি । কারন গারো আদিবাসিদের পোষাক যদি বলি তাহলে দেখা যায় যে মেয়েদের পোষাক হলো হাঁটুর উপরে পর্যন্ত পেচাঁনো গামছার মত আর উপরে কালো রঙের টি-শার্ট টাইপের একটি জামা, কোন উড়না নেই কিছুই নেই। আর বয়স্ক নারীরা তো আগে কোমরের উপরে ‍কিছুই পরতোনা । নারী পুরুষ ছেলে মেয়ে একসাথে চলাফেরা কার্জকর্ম সবকিছুই করা হতো দিন রাত সবসময়ই তারপরও ইতিহাসে এমন পাষবিক র্ধষনের মত কোন ঘটনা ঘটেনি আমাদের জানা মতে । কিছু ছবি গারো মেয়ে আর মহিলাদের —


এখন বলা হচ্ছে সভ্যতার যুগ, ডিজিটাল যুগ, মানুষ আদিম যুগে আর নেই কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো আদিম যুগেও মানুষ এমন ছিলনা। এখন নরপশুদের যে কার্যকলাপ ঘটে চলেছে । আমরা যারা সভ্য হিসাবে নিজেকে দাবি করছি আমরা কি করছি এ নরপশুদের শিক্ষা দিতে বা কি সহায়তা করছি ভিকটিমকে নতুন ভাবে স্বপ্ন দেখতে । উল্টাভাবে ভিকটিমকে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেয়ার মত একটার পর একটা মন্তব্য ছুড়ে দিয়ে জীবন্তু পুড়ে মারছি এমন সমাজে কিভাবে আছি ভাবলে কেমন যেন ছমছম করে সবকিছু ।

আমি যখন একটু বড় হচ্ছি স্কুলে যাওয়া শুরু হলো তখন থেকেই গারো আদিবাসি বলে আমার আশেপাশের অ-আদিবাসিরা টিটকারি দিয়ে বলতো "এগারো বার তের", আরো বলতো –'নাক চেপ্টা গারো'। আরেকটা বিষয় না বলে পারছিনা। সেই তখনই কি-ই বা বুঝি তখন ৮/৯ বছর বয়স হবে — অ-আদিবাসি ছেলেরা তখনই কাপড় তুলে দেখাতো আমাদের জন্য, আর আমরা অপমানে লজ্জায় কেউকে কিছু বলতে পারতাম না। এখনো বলিনা কিছু। এটাই আমাদের বড় দোষ; নিরবে সব সহ্য করে যাওয়াটা । বুক ফাটে তবুও মুখ ফুটেনা এমন অবস্থা । এভাবেই চলছে জীবন । শোষনে অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে জীবন ধারন করায় যেন রক্তে মাংসে মিশে গেছে । বড় ধরনের ঘটনা হলে জানতে পারছে সবাই আর ছোট খাট বিষয়গুলো তো পর্দার আড়ালেই থেকে যাচ্ছে কেউ কিছুই জানতে পারছেনা ।

আমার মা বোন নারী সমাজ নিরাপত্তা নিয়ে সমাজে বিচরন করুক এটাই মনেপ্রানে কামনা করি বিশেষ করে আদিবাসিদের বিচরন সবার সাথেই সমভাবে হোক, আলাদাভাবে না হোক; তাই চাই যে কোন মূল্যে ।