ভর্তি প্রশ্ন: পরীক্ষার্থী ও প্রশ্নকর্তার মেধা যাচাই

এম এম হোসেন
Published : 1 Oct 2014, 09:06 AM
Updated : 1 Oct 2014, 09:06 AM

আমাদের আশেপাশে কিংবা পত্রপত্রিকায় কিছুদিন আগে যেসব হাসিমাখা জীবন্ত মুখ গুলো দেখতে পেয়েছিলাম, তাদের দিকে এখন আর তাকানো যায় না। মলিন হয়ে গেছে অধিকাংশের মিষ্ট মুখ । আমরা মেতে উঠেছি এক অসুস্থ নিষ্ঠুর প্রতিযোগিতায় এবং এর মাধ্যমে আমাদের জিদ মেটানোর চেষ্টা করছি। একটা সমস্যাকে ফুটিয়ে তুলে গিয়ে আমরা নিজেরা আরও কিছু সমস্যা তৈরি করছি।

এমবিবিএস এর কিছু ব্যাচ আছে যারা ফাঁস হওয়া প্রশ্নে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে মেডিকেলে ভর্তি হয়েছিল। বর্তমানে শোনা যায় সেসব ব্যাচের ডাক্তাররা এখন বিভিন্ন জায়গায় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন, এমনকি যদি তিনি ভাল ডাক্তার হয়ে থাকেন। আশংকা করছি, গত কয়েক বছর ধরে (যখন থেকে ঢালাও ভাবে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে) পাবলিক পরীক্ষায় পাশ করা শিক্ষার্থীদের জন্যেও এমন পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, দেখা যাবে উল্লেখিত পরীক্ষা সমূহে যারা এ প্লাস পেয়েছি তারা হয়ত আরও বেশী তুচ্ছ তাচ্ছিলের শিকার হবে। এখন এ প্লাস পাওয়া যেন দোষের বিষয়! এটা সত্য দিনে দিনে শিক্ষার মান হ্রাস পেয়েছে (যদিও প্রযুক্তির উৎকর্ষের সাথে সাথে শিক্ষার মান বৃদ্ধির সুযোগ বাড়ছে), অনেকে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন পেয়ে ভাল ফলাফল করছে, অনেকে জ্ঞান বৃদ্ধির চেষ্টা না করে ৮০% মার্ক পাওয়ার জন্য রেডি মেইড পড়াশুনা করছে। কিন্তু আমার মনে হয় এখনও বড় একটা অংশ আছে যারা অনেক পড়াশুনা করে এবং আমাদের ঐ বয়সের তুলনায় অনেক বেশী জানে।

আমাদের একটা অংশ আছে যারা ছাত্র জীবনে আরামে নকল করে কোন রকমে ৬০০ মার্ক পেয়ে প্রথম বিভাগে পাশ করেছে, আর এখন ছাত্রছাত্রীদের ভাল ফলাফল করতে দেখলে তাদের শরীরে জ্বালা শুরু হয়। খুব কম ছাত্রছাত্রীই আছে যারা ভাল ফলাফল করতে চায় কিন্তু পরীক্ষার আগের দিন প্রশ্ন ফাঁস হবে সে আশায় বসে থাকে। সারা বছরই অধিকাংশ কে পড়াশুনায় ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়, যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে রেডি মেইড পড়াশুনা থাকে।

আমাদের বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী সজ্জন ও সম্মানিত ব্যক্তি। সবাই ওনাকে সুদৃষ্টিতে দেখত। তবে কিছুদিন যাবত ওনার কিছু কর্মকাণ্ড এবং মন্তব্যের কারণে ওনার প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে শুরু করেছে। ওনার ধারণা থাকা উচিত, সব ছাত্রছাত্রীও যদি এ প্লাস পায়, তবে এতে সরকারের তেমন সুনাম হবে না। বরং গণমাধ্যম সহ আমাদের বুদ্ধিজীবী সুশীল সমাজ যে উল্টো কুটু কথা শুনাবে তা ত আমরা দেখতেই পাচ্ছি। কোন শিক্ষার্থীর পরিবার যদি আওয়ামীলীগের বিপক্ষে থাকে, তবে এমন নয় যে এ সরকারের আমলে তাদের সন্তান এ প্লাস পেলে তারা আওয়ামীলীগকে ভোট দিবে। কোন পরীক্ষার্থী ভাল ফল করলে তার পরিবার মনে করে সে অনেক কষ্ট করেছে তাই এমন ফলাফল লাভ করেছে। এমনকি যে পরীক্ষার্থী ঠিকমত পড়াশুনা করেনি তার অভিবাবককেও বলতে শোনা যায়, তাদের সন্তান অনেক মেধাবী, সে খুব একটা পড়াশুনা করেনি তারপরও ভাল ফল করেছে। অর্থাৎ সাধারণত সরকার কিংবা শিক্ষামন্ত্রীকে কেউ ক্রেডিট দিতে চায় না। তাই গোঁয়ার্তুমি করে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া বা মন্তব্য করা উচিত নয়। মানুষ যে সবসময় সকল সিদ্ধান্ত সঠিক নিবে এমনটা ভাবা ঠিক নয়, সে যে পজিশনেই থাকুক না কেন! কোন সমস্যা থাকলে সেগুলোর মুখোমুখি হতে হবে, ভুল থাকলে যত দ্রুত সম্ভব সেগুলো সমাধানের ব্যবস্থা করতে হবে। এমনকি কারো সহযোগিতার প্রয়োজন হলে নিঃসঙ্কোচে সহায়তা চাইতে হবে।

পাবলিক পরীক্ষার্থীদের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে, কিন্তু ঢাকা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সহ দেশে যে সকল শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমূহ রয়েছে সেগুলোর শিক্ষার মানের কি অবস্থা তা কি আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি? সেগুলো কি তাদের মান বৃদ্ধি করতে পেরেছে, নাকি আরও অবনতি হয়েছে সেটা কি খেয়াল করেছি? আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ হতে কত ছাত্র আসত, আর এখন কত আসছে? সমস্যা সব জায়গায় আছে, তাই নির্দিষ্ট কিছুর দিকে একতরফা আঙ্গুল না তুলে সম্মিলিত ভাবে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে বা প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে হবে। এক স্থানের শূন্যতা দেখানোর জন্য এমন কিছু করা ঠিক হবে না, যাতে সারাদেশ ও দেশের মানুষ সুবিশাল কোন শূন্যতার মাঝে পতিত হয়। নিজেদের জিদ দেখানো এবং আমরা যে সঠিক এটা প্রমাণ করার জন্য কোমল মতি শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ বানানো উচিত নয়। তাহলে এই গিনিপিগই একসময় ডাইনোসর হয়ে আবির্ভূত হবে। নিজেদের বিলুপ্তি অনিবার্য দেখে আমাদেরও ধ্বংস করে রেখে যাবে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়! যেটা এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ই মনে হয় না (শিক্ষকদের যোগ্যতা, শিক্ষা উপকরণ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রযোজ্য সুযোগ সুবিধা বিবেচনা করে), সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় মাত্র ৮% পরীক্ষার্থী পাশ মার্ক পায় এটা অত্যন্ত অগ্রহণযোগ্য। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এবং আশংকা করছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল দেখে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর মাঝে হয়ত এমন এক ধরণের অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হতে পারে, কে কত জটিল প্রশ্ন করতে পারে! কেননা যে শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এত কম সংখ্যক পাশ করেছে, তারা যদি অন্য কোথাও বেশী সংখ্যায় পাশ করে তবে তাদের জাত চলে যাবে। আমি মনে করি, পাবলিক পরীক্ষা সমূহের রুগ্ন অবস্থা প্রকাশ করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটা নোংরা খেলা খেলেছে।

একজন আদর্শ প্রশ্নকর্তা যখন কোন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য প্রশ্ন রচনা করেন তখন ওনার তিনটি বিষয় মাথায় রাখা উচিত।
১) পরীক্ষার জন্য প্রযোজ্য সময়,
২) পরীক্ষার জন্য বিবেচিত পরীক্ষার্থীদের শিক্ষার লেভেল, এবং
৩) উক্ত প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য শিক্ষার মান।

উক্ত বিষয় তিনটির মাঝে যদি সমন্বয় না থাকে কিংবা ইচ্ছা/অনিচ্ছা কৃত ভাবে কোন এক/একাধিক বিষয়কে কম/বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় তবে একটি আদর্শ প্রশ্ন রচিত হবে না। আর সেক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত ফল বিপর্যয় ঘটবে।

এমন যেন না হয়, একটি অন্যায়ের বিচার করতে গিয়ে আমরা নিজেরাই আরেকটা অন্যায় করে ফেলি।