জীবনের পরাজয়েও মৃতুঞ্জয়ী যোদ্ধা ও শিল্পী আবদুল জব্বার চরণে শ্রদ্ধাঞ্জলি

মহানীল বঙ্গোপাধ্যয়
Published : 4 Sept 2017, 05:23 AM
Updated : 4 Sept 2017, 05:23 AM

প্রয়াত গায়ক মোহাম্মদ আবদুল জব্বারের গাওয়া বিখ্যাত একটি গান- 'তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়'। ১৯৬৮ সালে, গীতিকার মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ও সত্য সাহা'র সুরে 'এতটুকু আশা' ছবির এ গানটির জনপ্রিয়তার পরিমান নির্ণয় করা সম্ভব না। কারণ, বাংলা গান যতকাল থাকবে এ গানটিও সবসময় সর্বাধিক জনপ্রিয় গান হিসাবে থেকে যাবে। গানের কথায় কোন জীবনের কথা বলা হয়েছে তা বুঝতে না পারলেও, ব্যক্তি আবদুল জব্বারের অস্বচ্ছ্বল জীবন ও চিকিৎসাহীন প্রয়াণে, শিল্প, শিল্পী ও গানের মত একটি জীবনের পরাজয় দেখেছি। তিন মাস মৃত্যুর সাথে লড়াই করে গত ৩০ আগস্ট তিনি পরাজিত হন।

.

পীচ ঢালা পথটাকে সাথী করে জীবন কাটানো শিল্পী আবদুল জব্বার অনেকটা চিকিৎসার অভাবে আজ কবরবাসিন্দা। অথচ, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রথম গাওয়া 'জয় বাংলা বাংলার জয়' গানটি যার কন্ঠে মুক্তিযুদ্ধের মন্ত্রসংগীত হয়ে ধ্বণিত হয়েছিল, সেই কন্ঠযোদ্ধা ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় আরেক সঙ্গীত কিংবদন্তি হেমন্ত মূখোপাধ্যয়কে নিয়ে মুম্বাই'র বিভিন্ন স্থানে গান গেয়ে প্রাপ্ত ১২ লক্ষ রুপি স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের ত্রাণ তহবিলে জমা দেন। সেই অদ্বিতীয় মুক্তিযোদ্ধা হয়তো মাত্র ১২ লক্ষ টাকার জন্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ঐশীপ্রেরণাদায়ী এক মরমী ব্যক্তিত্বকে ধরে রাখতে পারল না বাংলাদেশ।

এক্ষেত্রে, বর্তমান জাতীয় সম্পদ কিংবা ওই সময়ের মুদ্রামান ধর্তব্য নয়। কারণ, বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ ও অর্জনে তার অবদান কারো চেয়ে কম নয়। নেতৃত্ব-রাজত্ব-দায়িত্ব-ত্যাগ-প্রাপ্তির বিচারে, আমি মনে করি, মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার এর সমকক্ষ কোন মুক্তিযোদ্ধা নেই এবং ছিলেন না। তাই, ব্যক্তি জীবনের আমি, এই মহাজীবনের জন্য কিছুই করতে পারিনি বলে অনুতপ্ত ও লজ্জিত।

মফস্বলে জন্ম হলেও দেশের শ্রেষ্ঠ গায়ক মোহাম্মদ আব্দুল জব্বারের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম ছোটবেলায়, ১৯৮৮ সালে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (জাসদ) এর উপজেলা কমিটির অভিষেক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন আমার প্রিয়তম গায়ক, সাথে বড় ছেলে মিথুন জব্বার। আয়োজক পরিবারের সদস্য হওয়ায় তাদের সাথে সঙ্গ ও সেবা করার সুযোগও পেয়েছিলাম। বিভিন্ন জাতীয় দিবসে শহরজুড়ে বেজে যাওয়া মাইকে হাজারবার শুনা, রেডিওতে শুনা এক অপার্থিব কন্ঠের যাদুকরকে দেখে ভাবছিলাম, এতবড় শিল্পী, এত সাধারণ মানুষের মত সহজ হতে পারে? সন্ধ্যার পর, সরাসরি শিল্পীর কন্ঠে তার বিখ্যাত গান উপহার দেয়ার পর, 'তারা ভরা রাতে' গানটি দ্বৈতকন্ঠের হওয়ায় সহশিল্পী হিসাবে মঞ্চে ডেকে নেন তার পুত্র মিথুন জব্বারকে। এরপর, মিথুন জব্বারকে গাইতে হয় ঘন্টাখানেক।

বলাবাহুল্য, মিথুন জব্বারের কন্ঠে আমি প্রথমবার ভুপেন হাজারিকা'র জীবনের গান ও পঙ্কজ উদাস'র গজল শুনি। ফলে, সংগ্রহ এবং মুখস্থ করতে থাকি ভুপেন হাজারিকা ও পঙ্কজ উদাসের যত গান ও গজল। মোহাম্মদ আবদুল জব্বার'কে দেখার আগেই তিনি ও গান আমার স্মৃতিতে সঞ্চিত ছিলেন। পরবর্তীতে, পড়াশুনার জন্য ঢাকায় থাকাকালে রাস্তায় দেখা পেয়েছি পায়েহাটা এই জাতশিল্পীর।

সম্প্রতি, স্যাটেলাইট চ্যানেল ও রকমারী মিডিয়াগুলো 'কারেন্ট ট্রেন্ড' নিয়ে ব্যস্ত থাকায় বিস্মৃত হন গায়ক জব্বার। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পর মানুষকে জাগরিত করতে 'সালাম সালাম হাজার সালাম' গানটি গাওয়ার মাধ্যমে প্রথম কোন গায়ক স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে ঢাকার পথে পথে যুদ্ধপ্রস্ততির বাণীমূলক কোন গান গেয়ে বেড়ান। ঢাকায় যখন আইয়ূব খান এর রক্তচক্ষু দুঃশাসন চলছিল, তখনও ভাষা আন্দোলন ও পরবর্তী আন্দোলনে নিহত শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর সাথে শহীদের ত্যাগে যে আগুন জ্বলেছিল তা যেন দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ছে এমন বার্তা, স্বাধীন বাংলার জন্য হাসিমুখে প্রাণ দেওয়ার আহবান জানানোর মত গান গেয়ে, এই দুঃসাহসী গায়ক প্রমাণ করেন গান ছিল তার প্রাণে-রক্তে-চেতনায়। গত ৩০ আগস্ট, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত হিসাব করে অন্তত এটুকু ভাবতে হয় যে, কতটা নিঃস্বার্থ-নির্মোহ-নিরঅহংকারী হলে ওই পরিমাণ নির্ভীক হওয়া যায়।

অাইয়ূব খানের স্বৈরশাসনের সময়ে আইয়ূব খানের বিরুদ্ধে গান গেয়ে, স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে দিকে দিকে ছুটেছেন আবদুল জব্বার। স্বাধীনতা লাভের আধা শতাব্দী উদযাপনের নিকটবর্তী সময়ে মোহাম্মদ আবদুল জব্বারের মত কীর্তিমান ব্যক্তির অহেতুক মৃত্যু আমাদের জাতীয়-দৈন্যতার তীব্রতার দৃষ্টান্ত হয়ে জানায় যে, স্বাধীনতা আমাদের কোন উপকারে আসেনি। স্বাধীনতার পর আমরা উল্টোপথে চলছি বলেই হাল ফ্যাশনের বিনোদনে বুদ হয়ে আছি। দুই যুগ আগে, ম্যাকাইভার, নাইট রাইডার, সংশপ্তক, অয়োময়, কোথাও কেউ নেই ইত্যাদির মত বাস্তবধর্মী মুভি ও ধারাবাহিক প্রচার হত, এখন এই ডিজিটাল সময়ে দৈত্য-দাণব-পরী-যাদুকরের কুকীর্তি চলচ্চিত্র ও নাট্যরূপ এর দর্শকপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। এমন সময়ে, কালজয়ী শিল্পীর অলক্ষ্যে থেকে যাওয়া স্বাভাবিক হলেও তা সামাজিক অপ্রকৃতস্থতার সাক্ষী হয়ে থাকল।

এমনকি, উল্লেখযোগ্য কোন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন শিল্পীর চিকিৎসায় সহযোগিতার লক্ষ্যে তহবিল গঠনের উদ্যোগ নিতে শুনিনি। উন্নত চিকিৎসার অভাব হত্যা করল অমূল্য শিল্প ও শিল্পীকে। কয়েকজন মন্ত্রী মহোদয় উন্নত চিকিৎসার আশ্বাস দিয়েছিলেন, কিন্তু সেগুলো ছিল কথার কথা। অনেক চেষ্টা করেও আবদুল জব্বারের পরিবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে পারেননি।

.

জানা যায়, ২ বছর আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শিল্পীকে ২০ লক্ষ টাকার সঞ্চয়পত্র প্রদান করেছিলেন, তখনও তিনি অসুস্থ ছিলেন। এদিকে, গত তিন মাস ধরে গুরুতর অসুস্থ শিল্পীর চিকিৎসা খরচ যুগিয়ে তার পরিবারও নিঃস্বপ্রায়। এবং শেষ পর্যন্ত অন্তত অনুদানহীন নির্ভার অবস্থায় অন্তরালে গেলেন। হয়তো, তিনি তা চেয়েও ছিলেন। শিল্পীসত্তার সততায় মর্যাদাসম্পন্ন তার গান ও গায়কী জীবনকে তিনি মান ও রুচিহীন শিল্প-সংস্কৃতি বাণিজ্যের বাজার থেকে দূরে রেখেছিলেন। জীবন ও কর্মের সাথে সঙ্গতিহীন রঙিন দুনিয়া তাকে ধনী করে তুলতে পারেনি। তাই, আধুনিক মিডিয়ায়, স্বাধীন গণমাধ্যমে জমে ওঠেননি, গান ও শ্রম দিয়ে মানুষের চেতনায়-রক্তে মুক্তিযুদ্ধের রসদ যোগানো অমর গায়ক মোহাম্মদ আবদুল জব্বার।

হয়তো অপ্রাসঙ্গিক যে, বিদেশের কোন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েও মৃত্যুবরণ করাটাকে শিল্পসম্মত মৃত্যু বলে মেনে নিতে পারতেন না। এতে, তার মহত্ব কিছুটা ম্লান হয়ে যেত। দুঃখিত হলেও, শিল্পীর বিদেশী-চিকিৎসা ও অনুদানহীন মৃত্যু নিয়ে আমি গর্বিত।

আক্ষেপ থাকে যে, কোন এক হিরো আলমকে নিয়ে এদেশে যে পরিমাণ মাতামাতি হয়েছে, তার কণা পরিমাণ প্রচার ও মনোযোগ পায়নি জাতীয় আদর্শ ও অহংকারের প্রতীক শিল্পী আবদুল জব্বারের আশংকাজনক অসুস্থতার সংবাদ। এমনকি, বলিউডের শ্রেষ্ঠ তারকাদের সাথে তুলনা করা হয়েছে, হিরো আলমের বিভিন্ন ছবিতে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন বলে ফেসবুকে রঙিন স্ট্যাটাস দিয়েছেন লক্ষ লক্ষ ভক্ত। ইউটিউব ভিউয়ারের সংখ্যায় আকৃষ্ট হয়ে এদেশের টিভি ও রেডিও চ্যানেলগুলোও ব্যবহার করে হিরো আলমকে। এদেশে হিরো আলম পর্ব শেষ হতে বেশিদিন লাগেনি। অথচ, এজন্য খরচ হয়েছে কোটি কোটি জিবি ডাটা, কোটি টাকার ফ্রিকোয়েন্সী, কোটি টাকার মিডিয়া খরচ।

অন্যদিকে, আমরা জীবনের মূল্যবান সময় নষ্ট করলাম মানহীন ও স্থুল রসিকতায়। ভিত্তিহীন ও হঠাৎ গজিয়ে ওঠা শতশত হিরো ও ঘটনা আসে আর হুজুগে মাতিয়ে চলে যায়। আমাদের জীবন ও মনে কোন শুভফল রেখে যায় না। বরং, এসব ঘটনা সামাজিক প্রগতির বিপরীতে প্রতিক্রিয়ার নমুনা প্রচার করে। আবার দেখা যায়, 'ওরে নীল দরিয়া', 'জয় বাংলা বাংলার' গানগুলো শুনামাত্রই আমরা অজ্ঞান হয়ে পড়ি অথচ এরপর আর জানি না। তাই, গায়ক আবদুল জব্বার জাতির জন্য আক্ষরিক যে দান ও মুক্তির শিক্ষা রেখে গেছেন, তার মূল্য শোধ করার ক্ষমতা অর্জন দূরে থাক, শিল্পীর ঋণ স্বীকার করে নেওয়ার যোগ্যতা অর্জিত হবে কিনা জানি না। ন্যূনতম মানসিক বোধ সম্পন্ন আমি, আমার শিল্পীর অসহায়ত্বের দিনে কোন কাজেই লাগতে পারলাম না বলে নিজেকে ধিক্কার জানাই।

শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে দায়িত্বশীলদের প্রতি অনুরোধ যে, এগুলোকে দাপ্তরিক বা একাডেমিক খাত হিসাবে বিবেচনা না করে জীবনঘনিষ্ঠ ও মানবিক করে তুলুন। অনুষ্ঠান-উৎসব-প্রচার-প্রচারণা জাতীয় উন্নতিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখতে পারে না। শিল্প-সংস্কৃতি, কোন লোকদেখানো বিষয় নয়, ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় জীবনে চর্চা করার শিক্ষা। কিন্তু শিক্ষাকে নিরক্ষরকরণ ও রুগ্নতাকে বিনোদন হিসাবে গ্রহণ করার অভ্যাস গড়ে ওঠেছে। তাই, কুকর্ম যে দেশে ভাইরাল হয় এবং মানবসেবা ও ধর্মকর্ম লোকদেখানো-আত্মকেন্দ্রিক, এমন রাষ্ট্রকাঠামোতে অবস্থানকারীরা শিল্পীর পীচঢালা পথের সন্ধান পেতে ব্যর্থ হবেই, লুঙ্গিডান্স কে সাংস্কৃতিক উন্নতির লক্ষণ বলে মনে করে মূল্যবোধহীন জাতিতে পরিণত হওয়াই জাতির ণিয়তি। এমতাবস্থায়, বাংলা গান, মুক্তি আন্দোলন ও বাঙালি জীবনে পাওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার মোহাম্মদ আবদুল জব্বার এর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে জানাচ্ছি যে, নকল-চাকচিক্যে মোহমুক্তি, ত্যাগীর প্রতি কৃতজ্ঞতা, শিল্পের মর্যাদা, গুণীর অভ্যর্থনা ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি স্বীকৃতি প্রদানের শিক্ষাক্ষেত্র সংকুচিত করার প্রতিক্রিয়া থেকে আমরা কেউই রক্ষা পাব না।