বড়রা পারেনি যা, বালিকারা পারল তা

মহানীল বঙ্গোপাধ্যয়
Published : 30 Sept 2017, 03:36 AM
Updated : 30 Sept 2017, 03:36 AM


নবম শ্রেণির সোনিয়া আক্তারকে জোর করে বিয়ে দিতে যাচ্ছিল পরিবার। বাল্যবিবাহের শিকার হতে যাওয়া সোনিয়ার বিদায়ী কান্নায় বিচলিত হয়ে ওঠে অন্যান্য সহপাঠীরা এবং ওই বিয়ে ভেঙ্গে দিয়ে তাকে স্কুলে ফেরত আনার সাহসী উদ্যোগ নেয়। সোনিয়াকে নিয়ে এরা প্রধান শিক্ষককে জানায় এবং বিয়ে বন্ধ করতে সহযোগিতা প্রার্থনা করে।

চাইলেও হেডস্যারের কিচ্ছু করার নাই। তাদের একমাত্র ভরসাস্থলে আশ্রয় লাভে ব্যর্থ হলেও লক্ষ্যে পৌছতে ব্যর্থ হয়নি। বালিকারা নিজেদের বুদ্ধি ও সাহস নিয়ে সোনিয়ার বিয়ে ভেঙ্গে দেয় এবং তার বাবার অঙ্গীকার আদায় করে নিতে সক্ষম হয়।

বাংলাদেশের সামাজিকতায় এমন ঘটনাকে রুখে দাঁড়াতে বড় ও নেতৃস্থানীয়রা যেখানে ব্যর্থ, সেখানে একটি বাল্যবিবাহ রোধকল্পে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ একদল কিশোরীর দুর্দান্ত অভিযানকে সামাজিক-শিক্ষা হিসাবে গ্রহণ করা যায়। বিভিন্নমুখি প্রতিকুলতা পেরিয়ে একটি শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে সফল হওয়া একগুচ্ছ সাহসকে সংবর্ধনা জানায় স্থানীয় বেসরকারী সংগঠন, পদক্ষেপ গণপাঠাগার।

হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলা সদর তথা পৌরসভার চন্দনা এলাকার বাসিন্দা ও চুনারুঘাট পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী সোনিয়া আক্তারকে না জানিয়ে বিয়ের আয়োজন করা হয়। গত ১৩ সেপ্টেম্বরকে বিয়ের দিন হিসাবে ধার্য করা হয়েছিল। ১১ সেপ্টেম্বর শেষবারের মত স্কুলে গিয়েছিল এবং তার অমতে হতে যাওয়া বিয়ের কথা জানায় বান্ধবীদের। অন্যায় ও বেআইনী এই 'বাল্যবিবাহ' বন্ধ করতে কার্যকর ভূমিকা রাখার সিদ্ধান্ত নেয় একই বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির হ্যাপী, অর্পিতা, সৃষ্টি, অনন্তা, উপমাসহ ১৪ জন।

প্রথমে সোনিয়াকে নিয়ে দলটি প্রধান শিক্ষকের অক্ষমতায় হতাশ হয় কিন্তু দমে যায়নি, বিয়ে অনুষ্ঠানের স্থানসম্পর্কিত কঠোর গোপণীয়তা থাকায় বিয়েবাড়ির ঠিকানা জানা কঠিন হয়ে পড়লেও ওই স্থানের সন্ধানে নামে বালিকারা।

সোনিয়ার পরিবারের সকলের নিকট ফোন করেও সোনিয়ার অবস্থান জানতে ব্যর্থ হয় দলটি। অভিভাবকেরা বিয়েবাড়ীর ঠিকানা জানায় নি, তবে এমন কাজ থেকে বান্ধবীদেরকে বিরত থাকার পরামর্শ দেন।

"সমাজে সচেতন মানুষেরা সবখানেই বিচরণ করেন আবার প্রয়োজনে নিজেরাই অচেতন হয়ে থাকেন'- এমন সমাজে সোনিয়াকে রক্ষা করার আগ্রহ নেই, আক্ষেপও নেই", বলে জানায় সাহসী দলটি।

এরা আরো বলে, এই বিয়ের সাথে জড়িত পক্ষদ্বয় নিজেদেরকে শিক্ষিত-সচেতন বলে দাবী করেন, যা ঠিক না।

প্রত্যেকে একেক দিকে বেরিয়ে পড়ে এবং পৌরএলাকার প্রতিটি বাসা-বাড়িতে তল্লাশী চালায় এবং বিয়েবাড়ীর সন্ধান লাভ করে।

পরেরদিন ১২ সেপ্টেম্বর, কৌশল নির্ধারণ করে স্কুল থেকে অভিযানে বেরিয়ে পড়ে সোনিয়ার বান্ধবীরা। প্রথম ও প্রধান কাজ বিয়েবাড়ী থেকে সোনিয়াকে নিয়ে আসা। দলটি অভিভাবকদেরকে জানায়, শিক্ষা বোর্ডের রেজিস্ট্রেশন কার্ডে সোনিয়ার স্বাক্ষর প্রয়োজন। সোনিয়াকে স্কুলে নিয়ে যেতে হেডস্যারই তাদের পাঠিয়েছেন, বলে পরিবারকে রাজী করাতে সক্ষম হয়। তারপর, স্কুল-ইউনিফর্ম পরিহিত দলটি সোনিয়াকে নিয়ে চুনারুঘাটের উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে হাজির হয়।

বিয়েতে সোনিয়ার অনিচ্ছা, দলটির বক্তব্য ও অভিযোগ শুনে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেন তৎকালীণ উপজেলা নির্বাহী অফিসার, সিরাজাম মুনিরা। তিনি অভিযাত্রীদল, চুনারুঘাট থানা পুলিশের একজন প্রতিনিধি, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে সঙ্গে নিয়ে বিয়েবাড়ী বা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। দীর্ঘ আলোচনার পর সোনিয়ার অভিভাবকগণ বিয়ে বন্ধ করতে সম্মত হন।

আইন ভঙ্গ করে, ১৮ বছরের পূর্বে ও অমতে বিয়ের আয়োজন করবেন না বলেও অঙ্গীকার করেন সোনিয়ার অভিভাবকেরা।

বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের সংখ্যা বা হার প্রায় ৭০ শতাংশ। ২০০৬ সালে এর হার ছিল প্রায় ৯০ শতাংশ। বাল্যবিবাহের সংখ্যার তুলনায় প্রতিরোধের ঘটনা নগণ্য। বাল্যবিবাহের মত সম্ভাব্য একটি দুর্ঘটনার কবল থেকে সহপাঠীকে উদ্ধার করে সামাজিক-সচেতনতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করল প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুলগামী শিশু-কিশোরদের একটি দল।


অভিযাত্রী দলটির সাহসিকতার স্বীকৃতি জানায় চুনারুঘাটের পদক্ষেপ গণপাঠাগার। গত ২৮ সেপ্টেম্বর সকাল ১১টায় পাঠাগার ভবনে সংবর্ধনা সভা ও সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সম্প্রতি অন্যত্র কর্মরত, বিদায়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সিরাজাম মুনিরা, চুনারুঘাটের উপজেলা নির্বাহী অফিসারের ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বে কর্মরত সহকারী কমিশনার (ভূমি), প্রধান শিক্ষক সত্যেন্দ্র দেব, বালিকা বিদ্যালয়ের অভিভাবক প্রতিনিধি মনিরুল ইসলামসহ পাঠাগারের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।

সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি তার বক্তৃতায় বলেন, সরকারী আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও স্থানীয়-সমাজের ভূমিকা এবং অংশগ্রহণের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন এবং কয়েকজন কিশোরীর এই তৎপরতাকে 'অসম-সাহসিকতা' বলে সাধুবাদ জানান। জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ না থাকলে কোনভাবেই আইনের শাসন নিশ্চিত করা যায় না এবং দায়িত্বশীল অভিভাবক, শিক্ষক তথা সচেতন ব্যক্তিমাত্রই অবৈধ-অন্যায় কর্মকান্ডকে প্রতিরোধে এগিয়ে আসা উচিত বলে জানান উপস্থিত অতিথি ও অন্যান্য সরকারী কর্মকর্তারা।

পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, স্থানীয় সচেতন ব্যক্তিবর্গ ও পাঠাগারের উপদেষ্ঠা-কর্মী-পাঠকদের ব্যাপক উপস্থিতিতে ক্ষুদে ও সাহসী শিক্ষার্থী দলের সদস্যদের সম্মাননা-স্মারক প্রদান ও সাদর সম্ভাষণ জানানো হয়।