শ্রেণিহীন সমাজ নির্মাণের কারিগর জসিম উদ্দিন মণ্ডল: শ্রদ্ধাঞ্জলি

মহানীল বঙ্গোপাধ্যয়
Published : 4 Oct 2017, 02:49 AM
Updated : 4 Oct 2017, 02:49 AM

সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)'র সম্মেলনের প্রধান বক্তা হিসাবে উপস্থিত হয়েছিলেন তিনি। সম্ভবত ২০০০ সালে। সম্মেলন শেষে বিদায় জানানোর সময় রেলস্টেশনে উপস্থিত স্থানীয় এক কর্মী তাকে পথখরচ দিতে চেয়ে অনেকটা বিপদে পড়েছিলেন। ত্যাগ-তিতিক্ষায় অনন্য ও বাহুল্যবর্জিত স্বচ্ছ জীবনের কঠোরতার প্রতিমূর্তি হয়ে দেখা দেন ওই কর্মীদের জীবনে। টাকাভর্তি খাম নিয়ে বিব্রত ও লজ্জিত হয়ে পড়েন ওই কর্মীরা। পথখরচা-সাধা কর্মী ভাবতে অভ্যস্ত নন যে, কেন্দ্র থেকে আমন্ত্রিত নেতৃবৃন্দ পথখরচা গ্রহণ না করে উল্টো শাসিয়ে যান।

ঘটনাটি শুনেছিলাম আমার ঘনিষ্ঠ ও সিপিবির ওই কর্মী ও উপস্থিত অন্যান্যদের মুখ থেকে, যাদের মধ্যে অনেকেই সেদিন থেকে তার পথ ধরে সমাজ বিনির্মানের স্বপ্ন দেখেন। বাংলাদেশে কমরেড জসিম উদ্দিন মণ্ডলের মত দারিদ্র, বিত্তশালী, নিঃস্বার্থ রাজনৈতিক নেতা তখনও ছিলেন বলে আনন্দিত হয়েছিলাম। সেই একাগ্রতা, সততা ও অবিচল জীবনের গল্প শুনে আমিও নিজের অক্ষমতা ও হীনতায় কুন্ঠিত হয়ে পড়েছিলাম। স্কুল-কলেজের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াও কতটা শিক্ষিত-স্বশিক্ষিত হওয়া যায়, তা শিখেছিলাম আমার নেতা কমরেড জসিম উদ্দিন মন্ডলের জীবন থেকে। নেতৃত্ব দিয়ে সেনাদলকে আকৃষ্ট করতে পারেন এমন সেনাপতি বাংলাদেশে একজনই মাত্র প্রত্যক্ষ হন, তিনি জসীম উদ্দিন মন্ডল।

তাকে কখনো চেখে দেখিনি। তবে, কুলাউড়া থেকে সংগৃহিত কমরেড জসিম মণ্ডলের বক্তৃতার অডিও ক্যাসেট বারবার, হাজারবার শুনে প্রায় মুখস্ত করে রেখেছি। যিনি শুনেছেন তিনিই কপি বা রেকর্ড করে নিয়েছেন। মর্মার্থ উদ্ধারে সক্ষম সকল শ্রোতার মুগ্ধতা ও একাত্মতা অর্জনে, সহজভাবে বলা সহজ কথার বাগ্মিতার জুড়ি নেই। এরপর থেকে বাম সঙগঠনের যেকোন অনুষ্ঠান ও সভার সংবাদে তার নাম ও বাণী খুঁজেছি। আজন্ম অধিকারবঞ্চিত মানুষের বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের আবশ্যকতা ও গুরুত্ব অনুধাবন করতে শিখিয়েছেন নিরলসভাবে।

১৯৪০ সালে ১৮ বছর বয়সে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। ১৯৪৯ সালে ঈশ্বরদীতে রেল শ্রমিকদের নিয়ে গড়া আন্দোলন 'খুদ স্ট্রাইক' এর অপরাধে তার ওপর হুলিয়া জারী, গ্রেপ্তার ও চাকরিচ্যুতি ঘটে। ৫ বছর জেলে থাকার মাধ্যমে জসিম মন্ডল শুরু করে আপোষহীনতার কঠোর সংগ্রাম। ১৭ বছরের জেল ও ১৮ বছরের ফেরারী জীবন যাপন করেও অদম্য এবং কপর্দকশূন্য অবস্থায় নিজেকে মহান উচ্চতায় রেখে তিনি অবসরে গেলেন। স্বাধীনভাবে বাংলাদেশে কেটেছে জেল-জুলুমের অধিকাংশ সময়- যার জন্য আমি লজ্জিত ও তার নিকট ক্ষমাপ্রার্থী।

রেলের কয়লা শ্রমিকের জীবন দিয়ে শুরু করা রেলশ্রমিকের জীবন সমাপ্ত হয়, রেল শ্রমিক ও গার্মেন্ট শ্রমিকদের সহযোদ্ধা হয়ে পাশে থেকে। মানবতা ও সহমর্মিতার সহজাতবোধশক্তি ও আত্মত্যাগের মন্ত্রের শিক্ষায় শিক্ষিত জসিম উদ্দিন মণ্ডলকে আদর্শ রাজনীতিবিদ-নেতা-কর্মী হিসাবে তৈরী করে। মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে উদ্ধত হওয়ার মহান শিক্ষা তাকে আলোকিত করেছিল। সাধারণ রেল শ্রমিকের অসাধারণ জীবনে ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি- সিপিবির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন।

২০১২ সাল থেকে আমৃত্যু সিপিবি এবং বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের উপদেষ্টা ছিলেন। রাজনৈতিক আদর্শগত আত্মীয়তায় ঘনিষ্ঠ কমরেডকে স্বচক্ষে দেখার আগ্রহ ছিল, হয়ত প্রবল ছিল না। তাকে সশরীরে দেখা হয়নি। তবে, তার প্রতি আমার অপার্থিব হৃদ্যতা ও আদর্শে একাত্মতাবোধের সূত্রে তিনি ছিলেন চির পরিচিত এক স্বজন। মানুষকে পুজি করে নয়, মানুষের পুজি ফিরিয়ে ও বুঝিয়ে দিতে দখলবাজদের সাথে শত্রুতা তৈরী করে অসহায়ত্বকে বরণ করে শ্রমিকের শুকনা-ম্লান জীবন যাপন করে মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার উজ্জল আলোকস্তম্ভ হয়ে পথ দেখান।

আমি সেই মহান কমরেডকে ভালবাসতাম, যিনি শোষণমুক্ত সাম্যবাদী সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। স্বপ্ন সফল হয়নি বলে সক্ষমতার শেষদিন পর্যন্ত শ্রমিক-মজুর ও শোষিত মানুষের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ফলে, সহায়-সম্বলহীন জসিম উদ্দিন মণ্ডল শেষজীবনে কন্যা-জামাতার গৃহে পালিত হলেও আদর্শচ্যুত হননি। গত ২ সেপ্টেম্বর কর্মময় জীবনের সমাপ্তি ঘটে। আমার না-দেখা মহানায়ক অমর এই কমরেড, আমার নিকট পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষদের একজন হয়ে থাকবেন।