লাখ টাকায় শুয়ে ছেঁড়া কাঁথার মায়া

মহানীল বঙ্গোপাধ্যয়
Published : 1 Nov 2017, 02:37 AM
Updated : 1 Nov 2017, 02:37 AM

গতকাল, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এর মতামত বিভাগের প্রথম নিবন্ধটির শিরোনাম- "সমাজতন্ত্র ছাড়া গণতন্ত্র একটি 'পোড়া রুটি'।" সাথে, মার্কস -এঙ্গেলস্ এর ছবি দেখে ভেবেছিলাম রুশ বিপ্লবের শত বার্ষিকীতে প্রকাশিত বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্যবহুল গবেষণা আমি এক ক্লিকেই পেয়ে গেলাম। ১৭ অক্টোবরের শতবার্ষিকীতে আজ পর্যন্ত কয়েক হাজার প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও বিশেষ রচনা ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। ৩১ অক্টোবরের নিবন্ধটির শিরোনামে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ অর্জনে সমাজতন্ত্রের আবশ্যকতার উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদানের ইঙ্গিত পেয়ে প্রথমেই অন্যত্র শেয়ার করে নিলাম। তারপর, মতামত পাতায় নিবন্ধটি পড়তে শুরু করি।

প্রথম বাক্যটি পড়েই থামতে হল। আত্ম-টেস্টের জন্য চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলাম লেখাটি কোন ধরনের, লেখক কে হতে পারে অর্থাৎ লেখকের মান ও অবস্থান কেমন হতে পারে। যদিও, আমার সামনে স্ক্রিনে নিবন্ধের লেখকের ছবিসহ নাম রয়েছে। ইচ্ছে করলেই দেখে নিতে পারি। তবুও উক্ত অনলাইন পত্রিকার অবস্থানের সাথে লেখাটির ধরন খুঁজতে থাকি। কিন্তু, লেখাটি পড়ে নিচ্ছি না। ব্যাপারটা ব্যক্তিগত হলেও লিখছি যে, শিরোনাম পড়ামাত্র লেখার বিষয়বস্তু কি হতে পারে তা ধারণা করে নিই। সমসাময়িক পরিচিত কিনা, পরিচিত হলে প্রয়োজনীয় কিনা, অপরিচিত বিষয় হলে শিরোনামটি বিশেষভাবে আবার দেখি। একেবারে নতুন, আগে কখনো শুনিনি-জানিনি বলে মনে হলে এক ক্লিক, এক ঝলক। এক ঝলকেই সিদ্ধান্ত নেয়া যে, লেখাটি তৎক্ষণাৎ, নাকি পরের বার পড়ব। ব্যক্তিগত পাঠাভ্যাসে সমাজবাদী-সাম্যবাদী-কমিউনিস্ট-মার্কস ইত্যাদি সংশ্লিষ্টতার আভাস পেয়ে গেলে সাথে সাথে পাঠ করি। সাধারণত, পাঠের পর শেয়ারযোগ্য হলে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করি। তবে আজকের নিবন্ধের শিরোনামে এতটা অভিভূত হলাম যে, ভুতগ্রস্থের মত প্রথমেই শেয়ার করে নিলাম। বিষয়ের গুরুত্ব বুঝে লেখা, ছবি ইত্যাদি একটা লিংকে শেয়ার করে রাখি। আসলে, নিবন্ধ-প্রবন্ধ কিংবা সংবাদটি সংগ্রহশালায় 'সেভ' করে রাখি। কিন্তু, আজকের ভুল আমাকে এখনো ভোগাচ্ছে।

ঘটনাটা হল, বাংলাদেশের প্রথম এবং প্রধান ইন্টারনেট পত্রিকা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর এর মতামত বিভাগ এর একটি নিবন্ধ আমাকে মারাত্মকভাবে মর্মাহত করেছে। লেখকের নাম দেখে বোকা হয়ে গেছি। জীবনের কোন এক সময়ে দীর্ঘদিন নিবন্ধের লেখককে দৃশ্যত দেখেছিলাম। নিবন্ধকা্রের প্রচারে- আহবানে-দর্শনে- কর্মে সাড়া দিয়েছিলাম। মিছিলে-শ্লোগানে যত চিৎকার করেছি তার সব বিশ্বাস করেই মুখে উচ্চারণ করেছি। সেই সময়, যারা আমাদের নেতৃত্ব দেয়ার কথা দিয়েছিলেন, বঞ্চিতদের একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সাথী হবেন, তারা কেবল সরে পড়েন নি, এই আন্দোলনের বুমেরাং হয়ে ওঠছেন। কৃষক- শ্রমজীবী মানুষের সরকার এর ধারণা মুখে-কলমে-টাইপে আনা এখন আত্মঘাতী ভুল। তবুও, ক্ষুদ্রাকারে দাবী ছিল, মৌলিক চাহিদা পূরণ এবং রাষ্ট্রীয় প্রগতিশীলতা ও জীবনমানের উন্নতি সাধন করা যেন সরকারের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হয়।

কিন্তু পঠিত নিবন্ধটির লেখক হানানুল হক ইনু। তিনি, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় তথ্যমন্ত্রী ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ (একাংশের) সভাপতি। জাসদের সাধারণ সম্পাদক হাসানুল হক ইনুর এবং এখনকার তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর বৈপরীত্য এবং এর প্রকাশভংগি আমাকে বিস্মিত ও লজ্জিত করে। ব্যক্তি স্বভাবতই গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই, পত্রিকা-সাময়িকিতে আগে লেখাটি পড়ি তারপর লেখকের পরিচয় খুঁজি। কোন কারণে লেখকের প্রতি আমার যাতে পক্ষপাতিত্ব না হয় তাই, সমাজতন্ত্র ছাড়া গণতন্ত্র একটি 'পোড়া রুটি' নিবন্ধটিও পড়ে নিলাম। বুঝলাম ভোর আর দূর। শঙ্কিত যে, ভয়ানক দুঃসময় ঘনিয়ে আসছে। শিক্ষা, রুচি, আচার-বিচার ইত্যাদি নিয়ে বলার কিছু আছে কিনা জানি না। তবে, শীর্ষ পর্যায়ের ভদ্রলোকদের সামাজিক লজ্জাটুকুও নেই দেখে ইংগিত পেলাম, এখন বুর্জুয়া আর প্রলেতারিয়েত নিয়ে বিভক্তি নয়। এখনকার বিভক্তিরেখা তানা হয় মানুষ এবং অমানুষের মধ্যে।

একসময়ে কর্ণফুলী পেপার মিলস্ লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার- পুত্র হাসানুল হক ইনু রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সুবিধাভোগী পরিবারের একজন। ঢাকার নটরডেম কলেজ ও বুয়েট, এর পর বিপ্লবী-রাজনৈতিক জীবনের বিশাল ইতিহাসের পর এমপি হয়ে তারপর আজ মন্ত্রী। উনার ব্যক্তিগত আভিজাত্য-বোধের মূল্যায়নে বর্তমান অবস্থানকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলি। আদর্শ ধারণ-লালন-পালন একান্ত ব্যক্তিক বিষয়। তাই, উক্ত লেখকের ব্যক্তি জীবন ও আচরণ আমাকে ভাবায় না। একটা রাজনৈতিক সংগঠনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার বাসনা পোষণ করে নেতৃত্ব গ্রহণ করে থাকেন তাহলে তিনি সফল, তাকে সাধুবাদ জানাই। নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শে আস্থাপোষণকারী ব্যক্তিমাত্রই জানেন যে, কোন মহৎ ঘটনায় ব্যক্তি কোন লক্ষণীয় বিষয় নন। সকল ব্যক্তির প্রতি সমান সম্মানের ক্ষেত্রে উক্ত লেখকের প্রতি সম্মান রেখেই আমি মনে করি, গুণগত মান কিংবা মানগত গুণে নিবন্ধিটি প্রকাশযোগ্য নয়। দ্বিতীয়ত, সমসাময়িক উপলক্ষে রচিত এবং তথ্যহীন- খাপছাড়া। তৃতীয় ও শেষ পর্যন্ত আমার নিয়ন্ত্রণাধীন কোন মাধ্যমের স্বাতন্ত্র্য রক্ষার্থে কোনভাবেই প্রকাশ করতাম না। কোন কারণে বাধ্য হলে মাধ্যমের সংযোগ বন্ধ করে দিতাম।

তবুও, নির্ভরষোগ্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর এর মাধ্যমে মাননীয় লেখকের প্রতি বিনম্র অনুরোধ যে, সমাজতন্ত্রের সর্বোচ্চ সফলতা আপনি পেয়েছেন, তাই এর প্রতি ন্যূনতম কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে একটি বৃহত্তর বিষয়কে উপহাস্যকর করে তুলবেন না। তার উপর তা মায়াকান্নার মত শুনায়। সারাদিন বস্তিবাসীর সাথে কাটিয়ে সন্ধ্যায় বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের নীড়ে রাত্রিযাপনকে প্রচলিত প্রবাদের বিপরীত করে বলাই যায়। আলোচিত নিবন্ধের বক্তব্যের সাথে মার্কস- এঙ্গেলস্ – সমাজতন্ত্র'রও কোন আত্মিক- আদর্শিক সম্পর্কের লক্ষণ পাওয়া যায়নি। যাই হোক, শিরোনামের সত্যতার অপব্যবহার করার অধিকার কারোরই থাকার কথা নয়। এছাড়াও, বাস্তবতাকে অস্বীকার করা নৈতিকতাবিরোধী বলা হয়ে থাকে। সর্বোপরি সকলের মঙ্গল কামনার স্বার্থে এই আবেদন বিবেচনা করার অনুরোধ জানাচ্ছি।