ঈদের ছুটিতে ঘুরে যেতে পারেন রুপালি ইলিশের দেশে

আসিফ মাহবুব
Published : 11 Sept 2016, 06:14 PM
Updated : 11 Sept 2016, 06:14 PM


এই সবুজ সমারোহ আমার চাঁদপুর জেলা, তা দেখে আমি প্রাণখুলে হাসি, তারুণ্যের তরুতলে আমি ঘুরে বেড়াই, ইলিশের ঝাঁকে ঝাঁকে আমি হারিয়ে যাই, পার্থিব এই সৌন্দর্য দেখে, মন চায়না যেতে অন্য কোনো খানে..

আমি নিশ্চিত আপনারও তা মনে হবে। সময়ের অভাবে দূরে কোথাও যেতে পারছেন না এ ঈদ-উল-আযহার ছুটিতে। তারা যদি দারুণ কিছু মুহূর্ত কাটাতে চান আর মন মাতানো মনোরম দৃশ্য দেখতে চান। তাহলে চলে আসতে পারেন রূপালী ইলিশের রাজধানী খ্যাত চাঁদপুর জেলায়।

এখানে আপনি লঞ্চ, বাস দুইপথেই আসতে পারেন। তবে লঞ্চে করে আসলেই আপনার আনন্দের মাত্রাটা আরেকটু বাড়বে। ঢাকার সদরঘাট বুড়িগঙ্গা নদীর তীর থেকে শুরু হবে আপনার যাত্রা। আস্তে আস্তে ধলেশ্বরী আর শীতলক্ষ্যার পাশ কাটিয়ে লঞ্চ গিয়ে উঠবে মেঘনায়। প্রতিটি নদীর নিজ নিজ আলাদা রূপ দেখে আপনি মুগ্ধ হবেন। যেটি হয়তো আগে কখনো দেখেননি। পাশাপাশি নদীর থৈ থৈ করা পানি, চলমান নৌকা, দূরের জনপদ আর জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য দেখে চলে যাবেন অন্য এক ভুবনে।


দেখবেন মেঘনায় ছোট ছোট নৌকাগুলো নদীর ঢেউয়ে দুলুদুলু দুলছে। মনে হচ্ছে এই তো বুঝি উল্টে গেল। কেউ বা ধরেছে, কেউবা আবার জাল টানছে। শক্ত হাতে হাল টেনে ধরেছে তাঁর সঙ্গী। কেউ বা নৌকায় বসে গুনে নিচ্ছে ধরা পড়া মাছের সংখ্যা। ওদিকে নৌকায় জীবন্ত ইলিশের ছটফটানি! এককথায় এক অপরূপ জীবনছবি।
এ দৃশ্য দেখে আপনার মন হয়তো শহুরে জীবনের মায়া কাটিয়ে সেখানেই থাকতে চাইবে। আর যদি ভ্রমণটা রাতে হয়। আর সেদিন যদি জোছনা থাকে, তাহলেতো কথাই নেই। ঠান্ডা বাতাসের মাঝে চাঁদের আলো দেখতে দেখতে কীভাবে সময় কেটে যাবে, টেরই পাবেন না!

এইতো গেল পথের কথা। চাঁদপুর নামলে দেখার মত জায়গার অভাব নেই। আর চাঁদপুরে এসে ইলিশ না খেয়ে বাড়ি ফেরার মতো বোকামি কিন্তু করবেন না।

যদি আপনার পরিকল্পনা থাকে সকালে গিয়ে বিকেলে ফিরবেন। তাহলে খুব সংক্ষেপে দেখে নিতে পারেন। চাঁদপুর বড় স্টেশনে পদ্মা, মেঘনা, ডাকাতিয়ার মোহনা। সেখান থেকে নৌকা নিয়ে আপনি ঘুরে আসবেন পদ্মা-মেগনার সঙ্গম স্থলে। সেখানে দেখতে পাবেন দুই নদীর দুধরনের পানি। একটির ঢেউ অন্যটির সাথে মিশে না। খুব কাছ থেকে দেখতে পাবেন ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরার দৃশ্য। তারপর চলে আসুন রক্তকরবী চত্বর, ইলিশ চত্বর, অঙ্গীকার স্বাধীনতা স্তম্ভ ইত্যাদি দেখার জন্য।

আর একটু সময় হাতে থাকলে দেখতে পারেন লোহাগড়ের মঠ। যদি খুব ভোরে যেতে পারেন সেখানে তাহলে অসাধারণ লাগবে। উঁচু তিনটি মঠের ওপরে রয়েছে অসংখ্য পাখির বাসা। ভোরে এদের বাড়ি ছাড়ার দৃশ্য পরিবেশটিকে আরো অসাধারণ করে তোলে। পাশের জলাভূমিতেও দেখা যাবে নাম-না-জানা আরো অনেক পাখি। অসাধারণ সুন্দর জায়গাটিতে যা দেখা যাবে তা আসল মঠের ধ্বংসাবশেষ। এই মঠগুলো ঘিরে নানা ধরনের গল্পও প্রচলিত আছে। স্থানীয় কারো কাছ থেকে সে গল্প শুনে নিতে ভুলবেন না।


এছাড়াও দেখতে পারেন চাঁদপুর কচুয়ার শ্রী শ্রী জগন্নাথ মন্দির। ৭৫ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৪৫ ফুট প্রস্থ বিশিষ্ট একতলা মন্দিরটির একটি কক্ষে দেব-দেবীর মূর্তি রাখা হয়েছে। অপর কক্ষে ঠাকুরের অবস্থান। এ মন্দিরটির ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায় যে, মন্দিরটি ১২৭৭ বাংলা সনে শ্রী গংগা গোবিন্দ সেন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি রথযাত্রা উপলক্ষে জগন্নাথ দেবকে দর্শণের জন্য ভারতের শ্রীক্ষেত্রে যান। অনেক চেষ্টা করার পরও তিনি জগন্নাথ দেবকে দেখতে না পেয়ে মনের দুঃখে কান্নাকটি করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েন এবং স্বপ্নে তিনি স্বয়ং জগন্নাথদেব কর্তৃক এইরূপ আশ্বাস পান যে, দেবতা তার নিজ আবাসস্থল সাচারে আবির্ভূত হবেন। এরপর গংগা গোবিন্দ সেন নিজ বাড়িতে আসার কয়েকদিন পর তার বাড়ির পার্শ্বস্থ দীঘিতে অলৌকিকভাবে ভেসে আসা কিছু নিম কাঠ দেখতে পান। উক্ত কাঠ দিয়ে তিনি সাচার ঐতিহাসিক রথযাত্রা তৈরী করেন এবং উক্ত মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন।

সেখানে গেলে মনসা মুড়াটিও দেখে আসতে পারেন। গেলে দেখতে পাবেন মাঠের মাঝে ১৩টি বাঁশঝাড় আছে এবং উক্ত ঝাড়ের চতুর্দিকে অনেক সাপের গর্ত রয়েছে।
কচুয়া উপজেলার ৪ নং সহদেবপুর ইউনিয়নের দোয়াটি গ্রামে মনসা মুড়াটি অবস্থিত।

কথিত আছে, একদা এক ব্যক্তি মনসা বাঁশঝাঁড় থেকে বাঁশ কেটে নেয়ার পর বার বার স্বপ্নে দেখে যে, উক্ত বাঁশ ফেরৎ না দিলে তার বংশের কোন লোক বাঁচবে না। তারপর বাঁশ ফেরৎ না দেওয়ায় তার নাকে মুখে রক্ত বের হয়ে সে মারা যায়। পরে তার বংশধরগণ উক্ত বাঁশ ফেরৎ দিয়ে আসে।


আরেকটি উলেস্নখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে মনসামুড়া থেকে সাপ ধরবার জন্য স্থানীয় কিছু লোকজন এক সাপুড়ে বহরের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়। যখন সাপুড়ে তার বীণা বাজানো আরম্ভ করে তখন বাঁশের পাতায় পাতায় ছোট ছোট সাপ গর্ত থেকে উঠে আসে। সাপুড়ে একটি সাপ ধরে পাতিলে রাখার সময় উক্ত সাপের কামড়ে তার মৃত্যু ঘটে এবং অসংখ্য সাপ তার নৌকার দিকে যেতে আরম্ভ করলে সাপুড়ের দল সাপটি ছেড়ে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যায়। তারপর থেকে কোন সাপুড়েরা উক্ত স্থানে সাপ ধরতে আসেনা এবং কোনলোক বাঁশের একটি কঞ্চিও কাটেনা।

সেই থানায় আরো রয়েছে সাহারপারের দিঘী। কচুয়া উপজেলার রহিমানগর বাজার থেকে ৫০০ মিটার দূরে কচুয়া কালিয়াপাড়া সড়ক সংলগ্ন পূর্ব পাশে অবস্থিত ৬১ একর আয়তনের একটি দিঘী। ১৯৬৯ সালে দিঘীর উত্তর পাড়ে মাটি খনন করতে গিয়ে সাধু বাড়ির জনৈক জয়নাল মিয়া ১৫/১৬টি ৯/১০ ফুট দীর্ঘদেহী মানুষের মাথার খুলি দেখতে পান। উক্ত খুলিগুলো যথাস্থানে মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়। এছাড়া চতুর্পাড়ে বিভিন্ন সময় মাটি খনন করতে গিয়ে ১২/১৩ হাত লম্বা কয়েকটি খাঞ্জির চাকতি পাওয়া যায়। খাঞ্জিগুলো ছিল তোড়াযুক্ত মোটা বেতের। এ দিঘীর অংশে প্রত্নতাত্তিক অনুসন্ধান চালানো হলে অনেক অনুদঘাটিত তথ্যের সন্ধান পাওয়া যাবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।

আরো আছে উজানীতে বেহুলার পাটা। এ শিলাটির একটি খন্ডাংশ বক্তারখাঁর শাহী মসজিদে পশ্চিম পাশে সম্পূর্ণ অযত্নে ও অবহেলায় পড়ে আছে। পদ্মপুরাণে বর্ণিত রয়েছে চাঁদ সওদাগরের পুত্রবধু বেহুলার পৈত্রিক নিবাস চাঁদপুর জেলাধীন কচুয়া উপজেলার উজানী গ্রামে (তৎকালীণ উজানী নগরে)। উত্তরাংশে বেহুলার পৈত্রিক রাজবাড়ী অর্থাৎ বেহুলার পিতার নামানুসারে রাজবাড়ীটি নামকরণ করা হয়েছে। রাজবাড়ীর দক্ষিণাংশে রয়েছে বেহুলার দিঘীর নামে পরিচিত বেহুলার দিঘী। বেহুলার দিঘীর উত্তর পাড়ে রাজবাড়ী হতে প্রায় ৫০ মিঃ দক্ষিণে বেহুলার ছোটবেলার খেলনার সামগ্রী পুরানো পাথরের নির্মিত শিলা পাথরটি (আঞ্চলিক ভাষায় বেহুলার পাটা) আংশিক বিদ্যমান আছে। দৈর্ঘ্য ৩২ ইঞ্চি ও প্রস্থ ২৬ ইঞ্চি বিশিষ্ট এ শিলাটির ওজন প্রায় ২৫০ কেজি হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এ শিলাটি আদি অবস্থার আংশিক মাত্র। কয়েক বছর পূর্বে জনৈক ধোপা এই শিলায় খারাপ কাপড় ধোয়ার সময় শিলা পাটাটি বিকট শব্দে স্থানামত্মরিত হয়ে উজানী গ্রামের দুধখাঁর দিঘীতে পতিত হয়। শিলা পাটাটি পানির ওপর ভেসে উঠে বলে জনশ্রম্নতি আছে।

সাহেবগঞ্জ নীল কুঠি। ফরিদগঞ্জ উপজেলার এই ঐতিহাসিক গ্রামটিতে সাহেবগঞ্জ নীল কুঠিটির জীর্ণ ও পুরাতন ভবনের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। জানা যায় যে, সাহেবগঞ্জ ফিরিঙ্গী গোলন্দাজ বণিকেরা নীল চাষের খামার হিসেবে একটি ব্যবসা কেন্দ্র ও শহর গড়ে তুলেছিল। লোক মুখে জানা যায় যে, এটা একটি শিল্প ও বাণিজ্য এলাকা ছিল। গ্রামটির নকশা এবং রাসত্মা-ঘাট, জল নিস্কাশনের খাল, পাকা কালভার্ট, ১২টি স্থানের পুরাতন দালানকোঠার বিভিন্ন নমুনায় এটাই প্রতিয়মান হয়। এখানে নীল চাষ করতে অনিচ্ছুক চাষীদেরকে শাসিত্ম ও ভয় দেখাবার জন্য জেলহাজতও তৈরী করেছিল। তৎকালীন ফিরিঙ্গি বণিকেরা মধ্যপ্রাচ্য হতে কয়েক জন দর্জিকে এ এলাকায় নিয়ে এসে তাদেরকে দিয়ে বিশেষ ধরণের পোশাক তৈরী করত এবং তা বিভিন্ন রং এ রঞ্জিত করে বিদেশে চালান দিত। তখন হতে ঐসকল বিদেশী দর্জিরা এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরম্ন করে।

হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদ।বিরল কারম্নকার্য খচিত কর্মকুশলতার অনন্য নিদর্শণ উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ মসজিদগুলোর অন্যতম, জুমাতুল বিদার বৃহত্তম জামাতের মসজিদ হিসেবে খ্যাত হজীগঞ্জে এই ঐতিহাসিক জামে মসজিদটি অবস্থিত।

তিন গম্বুজ মসজিদ ও প্রাচীন কবর।হাইমচরের ভিঙ্গুলিয়া গ্রামের মল্লিক বাড়িতে রয়েছে একটি তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ ও মসজিদের প্রাঙ্গণে রয়েছে কিছু বাঁধানো প্রাচীন কবর। জনশ্রম্নতি রয়েছে যে, এটি মলুলকজান বিবির মসজিদ। শিলালিপি থেকে যতদুর পাঠ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে তাতে জানা যায়, মসজিদটি ঈসা খাঁর আমলে জালালপুরের মল্লিক খেতাবপ্রাপ্ত কোনো শাসক নির্মাণ করেছিলেন। বাড়ির চতুপার্শ্বে পরীখা খনন করা আছে।


এখন নিশ্চয়ই ভাবছেন চাঁদপুর কিভাবে যাওয়া যায়, হ্যাঁ চাঁদপুরে লঞ্চে যাওয়ার জন্য সেরা দুটি লঞ্চ হচ্ছে রফরফ-২ ও ময়ূর-৭। এদের বাইরের ও ভেতরের সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবে এবং আপনি ভুলেই যাবেন যে এটি দেশের কোনো লঞ্চ! যদি চেয়ারে বসে যেতে চান, তাহলে ভাড়া লাগবে ১৩০ টাকা। আর সঙ্গে এসির বাতাস যোগ করতে চাইলে গুণে নিন ২২০ টাকা। কেবিনের ভেতর আরাম করেও যেতে পারেন চাইলে। ভাড়া : সিঙ্গেল কেবিন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, সিঙ্গেল কেবিন এসি ৫০০ থেকে ৬০০, ডাবল কেবিন ৮০০, ফ্যামিলি কেবিন ১১০০ ও ভিআইপি কেবিন দুই হাজার টাকা। ময়ূর-৭ ঢাকা থেকে ছাড়ে দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে, চাঁদপুর থেকে রাত ১২টা ১৫ মিনিটে। রফরফ-২ ঢাকা থেকে রাত ১২টায় ও চাঁদপুর থেকে দুপুর ১২টায় ছাড়ে। এ ছাড়া আরো কিছু ভালো মানের লঞ্চ আছে। যেমন এমভি তাকওয়া, এমভি সোনার তরী, এমভি মেঘনা রানী, এমভি বোগদাদীয়া, এমভি ঈগল, এমভি আল বোরাক, এমভি তুতুল ইত্যাদি। এগুলোর মানও খারাপ নয়। ভাড়াও প্রায় একই রকম। তবে একটু কমবেশি হতেই পারে। আর বাসে আসলে আছে পদ্মা নামের একটি বাস। ভাড়া ২৫০ টাকা।