রিকসাচালক বলে কেউ তার খোঁজ রাখেনি

আসিফ মাহবুব
Published : 15 June 2017, 09:14 AM
Updated : 15 June 2017, 09:14 AM

ভোরের আলোকে তিনি প্রায়শই হার মানান। জীবন আর জীবিকার তাগিদেই তার এই পথচলা। অন্যসব দিনের মতোই শুরুটাও হয়েছিল আজ। বলছি আল মিরাজ নামে এক মধ্য বয়সী খেটে খাওয়া অসম্ভব পরিশ্রমী মানুষের কথা। যিনি একজন অটোরিকশা চালক। রিকশায় যেন তার সংসারের একমাত্র অবলম্বন। রোজকার মতো আজো (২৬ মে) তিনি খুব সকালেই বের হন জীবিকা অন্বেষণে।

সাতসকালেই দুজন তরুণ এসে তাকে বললো, মামা যাবেন? তিনি জানালেন আপনারা কোথায় যাবেন। ধবধবে সাদা পোশাক পরিহিত ঐ দুজন জানালেন যে, তারা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন। তারা আবারো ফিরে আসবে এখানে (কলমায়)। ক্যাম্পাস থেকে প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র নিয়ে এসে তারা দুজনই তাবলীগ জামাতের ৪০ দিনের চিল্লায় যাবে।

ছুটে চললো মিরাজের বিদ্যুৎ চালিত অটোরিকশা। মাত্রই তারা কলমা থেকে ঢাকা-আরিচার সিএন্ডবি এলাকায় (জাবির মীর মশাররফ হোসেন হল সংলগ্ন) এসেছে। এমন সময় দূরপাল্লার দুটি বাস পরস্পরকে ওভারটেকিং করতে গিয়ে একটি বাস ধাক্কা দেয় আল মিরাজের অটোরিকশাকে। আর মুহূর্তেই দুই যাত্রীসহ ছিটকে পড়েন তিনি।

বাস চাপায় নিমিষেই প্রাণ গেলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের ছাত্র নাজমুল হাসান রানা ও মাইক্রোবায়োলোজী বিভাগের মেহদী হাসান আরাফাত। আর গুরুতর আহত হন চালক মিরাজ। এক মুহূর্তেই যেন সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। তবে কেউ কি জানতো আজকের শুরুর সমাপ্তিতে বিষাদের সুর ও মিলেমিশে একাকার হবে আল মিরাজ, রানা আর আরাফাতের জীবনে।

রানা আর আরাফাতের দুর্ঘটনা জনিত এ মৃত্যুতে তাদের ক্যাম্পাসে আন্দোলন হয়, অবরোধ করা হয় মহাসড়ক। ভাঙ্গচুর হয় ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের বাসভবন। মামলা হয় ৭৫ জনের নামে, জেলে যায় তার ৪২ সহপাঠী। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা তাদের সহপাঠীর মৃত্যুর জন্য দায়ী বাসচালকের শাস্তিসহ বিভিন্ন দাবিতে সোচ্চার হন। নিউজ হয় প্রতিটি পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় কেউই খবর রাখেনি সেই রিকশাচালক আল মেরাজের। দুর্ঘটনায় যিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও বরণ করলেন জীবন্মৃত পঙ্গুত্বকে। হারালেন দু'পায়ের সক্ষমতা। অনেকেই ধারণা করেছিল চালক আল মিরাজ মৃত্যুবরণ করেছেন।


তবে সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মিরাজ জানান, 'সেদিন ভোরে আমি ফজরের নামাজ পড়ে রিকশা নিয়ে বের হয়েছিলাম। দেখি কলমার একটি মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল তারা দুজন (দুই শিক্ষার্থী)। আশেপাশে আর কোনো রিকশা ছিল না।'

তিনি বলেন, 'আমাকে তারা বলেছিল- জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে তাদের বেডিং নিয়ে আসবে। তারা তাবলিগের চিল্লায় যাবে। আমিও যেতে রাজি হই। তখন সাড়ে ৫ টার মত বাজে। তখন রিকশা সিঅ্যান্ডবি থেকে একশ গজ উত্তর দিয়ে চলছিল। হঠাৎ একটি দ্রুতগামী বড় বাস আমার রিকশাকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়। অন্য আরেকটি বাসকে ওভারটেক করতে গিয়েই বাসটি আমার রিকাশাকে ধাক্কা দেয় ।'

রিকশাচালক মিরাজ আরো বলেন, 'সাথে সাথে আমরা তিনজনই রাস্তায় ছিটকে পড়ি। সঙ্গে সঙ্গে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। সম্ভবত প্রায় ১০ মিনিট পর আমার জ্ঞান ফিরে। সাথে থাকা মোবাইল দিয়ে বাড়িতে ফোন দিলে স্বজনরা আমাকে উদ্ধার করে বাড়িতে নিয়ে যায়। পরে আমাকে এনাম মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। তখনো ওরা দুজন (জাবির দুইছাত্র) ঘটনাস্থলেই পড়েছিল।'

অনেকটা বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি বলেন, 'কিভাবে বেঁচে গেছি তা আমি এখনো বুঝতে পারছি না। আল্লাহর অশেষ রহমত ছিল বলেই বেঁচে ফিরেছি।' তবে মিরাজ ঘাতক বাসকে শনাক্ত করতে পারেননি বলে জানান।

এসময় মিরাজের সাথে আলাপকালে পা ভেঙে যাওয়ায় পরিবারের খরচ নির্বাহ, বাসাভাড়া দেওয়া এবং সন্তানদের পড়ালেখা খরচ কিভাবে চালাবেন তা নিয়ে দুঃশ্চিন্তার কথা জানান। দুর্ঘটনায় মিরাজের ব্যাটারিচালিত রিকাশাটিও নষ্ট হয়ে গেছে। এটি ঠিক করতে ২০ হাজার টাকা খরচ পড়বে। কিন্তু ওই টাকা জোগাড় করবেন নাকি চিকিৎসার খরচ বহন করবেন এ নিয়ে মিরাজ বড় চিন্তিত। ওইদিনের দুর্ঘটনায় মিরাজের বাঁ-পায়ের গোড়ালির হাড় কয়েক টুকরো হয়ে গেছে। মাথা ফেটে যাওয়ায় দিতে হয়েছে তিনটি সেলাই। এছাড়া হাত, পিঠ ও কোমরসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে জখম হয়েছে।


.

আল মিরাজ, ৫০ বছর বয়সী একজন ব্যক্তি। জীবন আর জীবিকার সন্ধানে বছর দশেক এরও বেশি সময় আগে তিনি জন্মস্থান কিশোরগঞ্জ থেকে চলে আসেন সাভারের পাশ্ববর্তী সিএন্ডবি এলাকার কলমা নামক স্থানে। এক স্ত্রীসহ তার সংসারে রয়েছে চার সন্তান। বড় মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন। তবে পড়াশুনা করছে দুই ছেলে আর এক মেয়ে। নেই নিজস্ব বসতভিটা, থাকেন ভাড়া বাড়িতে। সবকিছুই ভালোভাবে যাচ্ছিল তার সুখের সংসারে। কিন্তু হঠাৎ হানা দিল ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। পরিবারের একমাত্র উপার্জনাক্ষম ব্যক্তি আল মিরাজ বরণ করলেন পঙ্গুত্ব। অনেক কষ্টে তার প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা গেলেও চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত করা তার পরিবারের পক্ষে অসম্ভব। এতে মির্মম পরিণতির কবলে পড়েছে তার পরিবার। ভাড়া পরিশোধ না করলে থাকার জায়গা নেই। ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার জন্য খরচের নিশ্চয়তা নেই, নেই স্বাভাবিক জীবন ধারনের নুন্যতম নিশ্চয়তা।

মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য। এতটুকু মানবিক কারণে হলেও সহানুভূতি ও সাহায্য টুকুই আল মিরাজের প্রাপ্য। সমাজের বিত্তবান কেউ এগিয়ে আসলেই আবারো প্রাণ ফিরে আসবে আল মিরাজের ছোট্ট সুখের সংসারে। দূরীভূত হবে দুঃখের কালো মেঘছায়ার। বাঁচবে একটি পরিবার আর কয়েকটি স্বপ্ন। যারা নিরন্তর ছুটে যাবে তাদের অগ্রযাত্রায়। যে যাত্রা জীবনের, যে যাত্রা বাস্তবতার নিরিখে। আর এভাবেই জয়ী হবে মানবতা ও মানবিকতাবোধ।

উল্লেখ্য, গত ২৬ মে (শুক্রবার) নাজমুল হাসান রানা ও মেহেদী হাসান আরাফাত নামে জাবির দুই শিক্ষার্থী মিরাজের রিকসায় করে আসার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। প্রতিবাদে পরদিন তার সহপাঠীরা সাড়ে ৫ ঘণ্টা ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে। এসময় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশ লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ ও গুলিবর্ষণ করে। এনিয়ে ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের উপাচার্যের বাসভবন ভাঙচুর, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মামলা, ৪২ শিক্ষার্থীকে গ্রেফতারের ঘটনা ঘটে। এক শিক্ষার্থীকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পুলিশের হাতকড়া পরানোর ঘটনায় সমালোচনার ঝড় উঠে। পরে জরুরি সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা এবং শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষ।