বহূল আলোচিত-সমালোচিত তেঁতুল তত্ত্বের পর আল্লামা শফী'র 'বন্ধু তত্ত্ব' বাংলাদেশের নিরুত্তাপ রাজনীতির মাঠে বেশ খানিকটা উত্তাপ যে ছড়াচ্ছে দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে পোস্ট করা স্টেটাসের মাধ্যমে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। ১৮ এপ্রিল ২০১৪ কক্সবাজারের পেকুয়ায় হকার ব্যবসায়ীদের সংগঠনএকামুতুদ্দিনের উদ্যোগে আয়োজিত পেকুয়া বাজারের মাঠে এক ইসলামী মহাসম্মেলনেহেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শাহ্ আহমদ শফী বলেছেন, 'সরকার, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ আমাদের বন্ধু। মুসলিমরা ভাইভাই, তারা সেই হিসেবে আমাদেরও ভাই। আমরা আন্দোলন করেছিলাম কাউকে গদিতেবসানোর জন্য নয়। আমাদের আন্দোলন ছিল নাস্তিকদের বিরুদ্ধে। যারা কওমীদেরজঙ্গী বলে থাকে। তিনি আরও বলেন,' তারা আমাদের সব সময় কেন জঙ্গী বলে? প্রমাণ করুন আমরা কিভাবেজঙ্গী হলাম। স্কুল-কলেজের ছাত্ররাদু'দলে ভাগ হয়ে গোলাগুলি করে। জঙ্গী হলেএরাই হবে। মৌলভীরা ও মাদ্রাসার ছাত্ররা সোনার বাংলা গড়ার জন্য কোথায়গোলাগুলি করেছে?।…আমরা সরকারের কাছে ১৩ দফা দিয়েছিলাম। দফাগুলোমানলে ভাল, না মানলে কিছুই করার নেই।…আমরা তোমাদের গালি দিই না, তোমাদের প্রধানমন্ত্রীকে গালিদিই না। কেন আমাদের দিকে চোখ বড় করে তাকাও? আমরা বলে দিয়েছি হেফাজত ইসলামকি। নামাজ, রোজা, যাকাত, ইসলামকে হেফাজত করা হেফাজতে ইসলামের কাজ।'
শুধু তা ই নয় যে গার্মেন্টস নারী শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে শফি হুজুর 'তেঁতুল তত্ত্ব ' নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের সমালোচনার শিকার হয়েছিলেন; ১৮ এপ্রিলের বক্তৃতায় তিনি সেই গার্মেন্টসের নারী কর্মীদের রুটি-রোজির যাতে বন্ধ হয়ে না যায় সে জন্যে তিনি এবার দেশের বন্ধ গার্মেন্টস খুলে দেয়ার জন্য দোয়াওকরেছেন।শফী হুজুরের এসব বক্তব্য আন্দোলন থেকে পিছুটান নাকি নতুন কোন কৌশল তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন রাজনৈতিক ভাষ্যকারেরা।
আগেই বলেছি শফী হুজুরের এই 'বন্ধুতত্ত্ব' নিয়ে নানাজন নানা কথা বলছে। কেউ বলছেন সরকারের সাথে গোপন সমঝোতার কারণেই শফি হুজুরের গণেশ উল্টে গেছে। তাই তিনি রাজনীতির মাঠে ইউটার্ন নিয়ে যেন সবাইকে চমকে দিয়েছেন। তাঁর এ 'বন্ধুতত্ত্বে' আওয়ামী শিবির কিছুটা খুশি হলেও বিএনপি-জামায়াত শিবিরে এ নিয়ে চরম হতাশাই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সে কারণেই হয়তো বিএনপি জামায়াত শিবিরেই এই বন্ধু তত্ত্ব বেশি সমালোচনা হচ্ছে।
দীঘদিন থেকে অভিযোগ ছিল যে, কিছু কওমী মাদ্রাসায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সংস্কৃতিবিরোধী বইপত্র পড়ানো হয়। জঙ্গী প্রশিক্ষণেরও অভিযোগ রয়েছে কওমী মাদ্রাসার বিরুদ্ধে। এ কারণেই সরকার কওমী মাদ্রাসায় নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। এ ছাড়া সরকার 'কওমী মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ আইন–২০১৩' বাস্তবায়নে আগ্রহী কিন্তু হেফাজতে ইসলাম সরকারের এই উদ্যোগের বিরুদ্ধে এতদিন সোচ্চার ছিল। তারা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামার কথা ঘোষণা করে গৃহযুদ্ধেরও হুমকী দিয়েছিল। মাত্র কয়েকমাস আগে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর একটি কমিউনিটি সেন্টারে হেফাজতে ইসলাম আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে হেফাজতের মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী হুমকি দেন, যদি প্রস্তাবিত 'কওমী মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ আইন–২০১৩' পাস হয় তবে দেশে গৃহযুদ্ধ হবে। তিনি বলেন, 'লাখ লাখ লাশ পড়বে, তবু কওমী মাদ্রাসা সরকারী নিয়ন্ত্রণে যেতে দেয়া হবে না। প্রস্তাবিত আইনের মাধ্যমে সরকার কওমী মাদ্রাসাকে ধ্বংস করতে চায়।'
আমরা যদি একটু পিছনে তাকাই তা হলে দেখতে পাব হেফাজত ইসলামের জন্স ইতিহাস বেশি দিনের নয়। নাস্তিক ব্লাগারদের ফাঁসির দাবি নিয়ে রাজপথে আন্দোলনকরতে ২০১৩ সালেহঠাৎ করেই এটি আলোচনায় আসে । এরপর বিএনপি-জামায়াতের ছত্রছায়ায় ২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানী ঢাকার শাপলা চত্বরেঅবস্থান করে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। কিন্তু সরকারের দূরদর্শী সিদ্ধান্তে এবং হেফাজতের অবস্থান কর্মসূচিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর হস্তক্ষেপে পিছু হটেতারা।
হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবিকে সামনে নিয়েবিএনপি-জামায়াতের ছত্রছায়ায় সংগঠনটি গতবছর রাজপথ থেকে দাপটেরসঙ্গে বিভিন্ন গণমাধ্যমকে মাতিয়ে রাখলেও আহমদ শফীর এই বক্তব্যে পাল্টে গেছে সব হিসাব-নিকাশ।তাই যাদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে হেফাজত নামের এই ফ্রাঙ্কেস্টাইন সৃষ্টি হয়েছিল; তারাই শফী হুজুরের এমন পিছুটানে পিছুটানে যারপর নাই ক্ষুব্দ হয়ে নানা কথা বলছে। তাদের আশা ছিল হেফাজতকে কাজে লাগিয়ে আবার আন্দোলনের মাঠ গরম করে শেখ হাসিনার বর্তমান সরকারকে উৎখাত করা সম্ভব হবে। কিন্তু হঠাৎ করে শফী হুজুরের 'বন্ধু তত্ত্ব' গরম ভাতে পানি ঢেলে দিয়েছে। তাই তাদের বক্তব্যে নির্যাস হলো
কেই কেউ বলছেন, গতবছর থেকে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গেহেফাজত আমির আহমদ শফীর মধ্যে চলা দেনদরবারের মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় এ গোপন 'সমঝোতার' ফলই হচ্ছে লালদীঘিতে হেফাজতকে দীর্ঘদিন পর প্রকাশ্যে মাঠে নামারসুযোগ করে দেয়া এবং সেই সম্মেলনে সরকারের প্রতি আহমদ শফীহুজুরের ইতিবাচক মনোভাবপ্রকাশ করা। গোপন সমঝোতার অংশ হিসেবেই সেদিন একাধিক মামলার আসামিদের নিয়েমঞ্চে বক্তব্য দিলেও পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করেনি।এছাড়াও সারাদেশে হেফাজত নেতাদেরবিরুদ্ধে করা তিনটি হত্যা মামলাসহ ৫০ এর অধিক মামলা থেকে হেফাজত নেতাদেরমুক্তি দিতেও সরকারের কাছে দাবি করা হয়েছে। আবার তারা সচেতনতার সাথে বাজারে এ কথাটিও ছড়িয়ে দিয়েছে যে, গণজাগরণ মঞ্চকেসরকারিভাবে কোণঠাসা করে তাদের সব কার্যক্রম বন্ধ করতেও সরকারকে শর্ত দেয়াহয়েছে হেফাজতের পক্ষ থেকে'। গণজাগরণ মঞ্চের এই যে বর্তামন বিভক্তি এটি এই সমঝোতারই অংশ হতে পারে।
সেই কারণেই হয়তো হেফাজতে ইসলামের এই অবস্থানকেসাধুবাদ জানিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিরসহ-সভাপতি ও সাংস্কৃতিক সংগঠক মফিজুল ইসলাম বলেন, 'সরকারের সাথে হেফাজতেরকোনো সমঝোতা হয়নি। তারা এখন ভুল পথ ছেড়ে সঠিক পথে এসেছেন। নিজেদের ভুলবুঝতে পেরেছেন।'তিনি বলেন, 'তাদেরকে এতদিন জামায়াতসহ কয়েকটি দলমিস গাইড করেছিল। দেশের সম্মানিত আলেম সমাজ এখন নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেদেশের মানুষের পক্ষে এসেছেন।'
সবশেষে এই বলেই শেষ করবো, হেফাজত প্রধানের এ বন্ধুত্বের আহ্বানকে আমরা ইতিবাচকভাবেই দেখতে চাই। তবে দূর অতীত বা নিকট অতীতে দেশের মানুষ এমন কোনো নজির দেখেনি তাই 'ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পায়' প্রবাদটির মতো হেফাজতের এ বন্ধুত্বের আহ্বানকেও সত্য বলে মেনে নিতে ভয় পাচ্ছে। ভয়কে আমাদের জয় করতে হবে। কেউ যদি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয় সেটা হোক পরিবার, সমাজ কিংবা রাষ্ট্র; তা হলে কিছুতেই বন্ধুত্বের আহ্বানের হাত ফিরিয়ে দেয়া উচিত নয়। তবে যে বন্ধু একদা শত্রু ছিল সেসব বন্ধুদের ব্যপারে অবশ্য সতর্ক থাকতে হবে। কেননা কেউ কেউ বন্ধুবেশে হাত মিলিয়ে যে কোন সময় পিঠে ছুড়ি বসিয়ে দিতেও দ্বিধা করেনা, এমন নজির ইতিহাসে অনেক আছে।