বিষ মেশানো ফল: বাংলার মানুষ যেন ভুলে যেতে বসেছে মধু ফলের স্বাদ

মাহবুবুল আলম
Published : 30 June 2014, 01:18 PM
Updated : 30 June 2014, 01:18 PM

বৈশাখ-জৈষ্ঠ দুইমাস গ্রীষ্মকাল। গ্রীষ্মকালেই বাংলাদেশে উৎপান্ন হয় প্রায় সব জাতে মিষ্টি ফল। আম, জাম, কাঁঠাল লিচুসহ নানা জাতের মিষ্ট ফলের মিষ্টি গন্ধে বাতাসও যেন এ সময় মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। এই সময়টাতে মিষ্টি ফল খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। আমাদের হাট বাজারগুলোও নানা রঙের, নানা স্বাদের ফলে বাজার ভরে ওঠে। ঘরে ঘরে শুরু হয় ফল উৎসব। এটা বাঙলার চিরায়ত বৈশিষ্ট্য। মধুমাসকেও বাঙালি উৎসব মাস বলে গণ্য করে। গ্রামে-গঞ্জে মধুমাস এসে উপস্থিত হলে মানুষের মধ্যে আনন্দের ধুম পড়ে যায়-তারা মধুমাস পালনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মধুমাসে মেহমান-অতিথিদের বাড়িতে ঘরের ফল পাঠিয়ে তাদেরকে সম্মানিত করা হয়। পেড়শিদের কেউ ঘরে এলে আপ্যায়ন করা হয় মধুমাসের মধু ফল দিয়ে। বাঙালি সংস্কৃতিতে কেউ কেউ বিশেষ করে মেয়ের জামাইয়ের বাড়িতে নানা রকমের ফল উপহার হিসেবে পাঠানো একটা রেওয়াজ বা নিয়মে পরিণত হয়েছে ।

মধু মাসের মধু ফল যে খাওয়ার জন্যই বিখ্যাত তা কিন্তু নয়। এ ফলের অর্থনৈতিক মূল্যও অপরিসীম। গ্রীষ্মমন্ডলীয় আবহাওয়ার কারণে আমাদের দেশে প্রচুর পরিমানে আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল, লেবু, পেঁপে, আনারস, তরমুজ, বাঙ্গি, পেয়ারা, জামরুল, বেল, কদবেল, ডেউয়া, টেরখই, ডেফলসহ নানা ধরনের ফল পাওয়া যায়। দেশে এমন বাড়ি খুব কমই পাওয়া যাবে যে বাড়িতে একটি দুই বা ততোধিক আম-কাঠালের গাছ নেই। তাই আমাদের দেশের আম ও কাঁঠাল প্রচুর উৎপন্ন হয়। এক পরিসংখ্যান জানা যায়, ২০১৩ সালে দেশে আম উৎপন্ন হয়েছে প্রায় দশ লাখ টন। দেশে উৎপাদিত আমের প্রায় ২৫ শতাংশ ব্যবহৃত হয় জুস উৎপাদন খাতে। আম দিয়ে তৈরি এ জুস এখন দেশের বাইরে রফতানিও হচ্ছে। তাছাড়া কাঁচা ও পাকা আম মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ায় রফতানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে বাংলাদেশ। পরিসংখ্যানে আরও জানা যায়, আমাদের দেশে মৌসুমী ফল মোট উৎপাদন হয় ৪৩ লাখ ৮৩ হাজার টনের কাছাকাছি । এ হিসেবে মধু মাসের মধু ফলের অবদান অনেক।
কিন্তু বেশ কয়েক বছর যাবত আমাদের দেশের কিছু অসাধূ ব্যবসায়ী বেশি লাভের আশায় এসব সুস্বাদু মিষ্টি ফলে মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ফরমালিন, কার্বাইড, টিএইচফোর, বাইরোজিট নামক প্রাণঘাতি রাসায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে জনজীবনকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। মৌসুমী ফলসহ বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যে প্রাণঘাতী এসব রাসায়নিক পদার্থ মেশানোর ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা পেশার মানুষ বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরা বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। কেননা এমনিতেই তাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধক অবস্থা কম থাকে। এই কারণে এ বছর ফলের ভরা মৌসুমেও দেশের ফলের বাজারে বেচাবিক্রি অনেকটাই কমে গেছে। ফলমুলে বিভিন্ন প্রাণঘাতী রাসায়নিক দ্রব্য মেশানোর কারণে ফল কেনার ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষ তাই বলছে, পকেটের টাকা খরচ করে ফল খাওয়ার নামে পরিবারের মানুষজনকে তো বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতে পারি না।

দেশের মানুষের স্বাস্থ্য নিরাপত্তাকে আরও নিশ্চিত করতে বর্তমান সরকার ও সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোও বিশেষ অভিযান পরিচালনা করছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা ফলমুলে ফরমালিন বা কোন ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ আছে কি-না  তা নিশ্চিত করতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে ঢাকার আটটি পয়েন্টে চেকপোস্ট তৈরি করে অভিযান চলছে। এ অভিযানে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী  ট্রাক-বাসে আনা আম-জাম-লিচু-কাঁঠালসহ অন্যান্য ফলে ফরমালিন বা ক্ষতিকারক কোন রাসায়নিক দ্রব্য মেশানো আছে কি না তা যন্ত্রের মাধ্যমে শনাক্ত করে তা ধ্বংস করে দেয়ার ব্যবস্থা করছে। ফরমালিন আতঙ্কে দেশের মানুষ মধুমাসের মধু ফল ফল খেতে বেশ সাবধানতা অবলম্বন করার কারণে ফলের বাজারে বেশ মন্দা দেখা দিয়ে । এ নিয়ে দেশের ফল ব্যবসায়ীরা পবিত্র রমজান মাসকে সামনে রেখে ফল ব্যবসা বন্ধ করে আন্দোলনের হুমকি দিলেও সরকারের কঠোর অবস্থান ও জনমতের চাপে তা পিছু হটেছে বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু এত কিছুর পরও মধুমাসের ফলমুল ও খাদ্যদ্রব্যে রাসায়নিক দ্রব্য মেশানো কি পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে? সাধারণ মানুষ বলছে না ব্যবসায়ীদের এসব অপকর্ম বন্ধ হয়নি। শুধু বিষ মেশানোর ধরন বা সময়টা বদলেছে। আগে যেখানে তারা প্রকাশ্য দিবালোকে ফর্মালিন বা কার্বাইড মেশানো অপকর্মটি করতো, এখন সাবধানতা অবলম্ভন করে রাতের অন্ধকারে দেদারছে অপকর্মটি চালিয়ে যাচ্ছে।

সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন ও টিভি চ্যানেলে ফলে বিষ মেশানোর সচিত্র প্রতিবেদন দেখে অনেকেই ফল খাওয়া ছেড়েই দিয়েছে। কেউ আবার ফলের বাজারমুখো হচ্ছেন না। এই করতে করতে চলে যাচ্ছে বাঙালিদের প্রিয় মধু মাস। আবার যারা ফল কিনছেন তারাও সরাসরি ফলটি না খেয়ে চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী বাজার থেকে কেনা ফল ফল কুসুম-গরম পানিতে আধা-ঘণ্টা ডুবিয়ে রেখে চামড়া ছিলে খেলে ততটা আশঙ্কা থাকে না। তাই কিছু কিছু ফল পাগল মানুষ সাবধানতা অবলম্বন করে মধু ফল খাচ্ছে।

চিকিৎসকদের মতে মধুমাসের ফলের মধ্যে আমের রয়েছে নানা গুণাগুণ। ক্যান্সার, লিউকেমিয়া প্রতিরোধে এ্যান্টি অক্সিনেন্টসমৃদ্ধ ঔষধি গুণে গুণান্বিত আম। চিকিৎসাশাস্ত্রে এর শরীরতত্ত্বীয় প্রভাব ও কার্যকারীতা উল্লেখ আছে। চিকিৎসকদের মতে মৌসুমী ফলের মধ্যে রয়েছে নানা রোগ প্রতিষেধক ক্ষমতা। গরমে সাধারণত সর্দি-কাশি, ঠাণ্ডা-জ্বরে মানুষ আক্রান্ত হয়। এ ক্ষেত্রে মৌসুমী ফল অনেক কার্যকরী। কেননা, ফলের মধ্যে রয়েছে ভিটামিন ই, পটাশিয়াম, প্রোটিন। এছাড়া মানব দেহের বিশেষ উপকারী উপাদান ভিটামিন বি-৬, ফাইবার কপার, পটাশিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম পেকটিস ফাইবার রোগ প্রতিরোধ করে। স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে দৃষ্টিশক্তিকেও শাণিত করে মৌসুমী ফল।  আমের মধ্যে ভিটামিন এ, বি, সি আমাদের প্রাণ-শক্তি যোগাড় করে। তাই সাবধানতা অবলম্ভন করে সবাইকে কম-বেশি ফল খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।

কাজেই স্বাস্থ্যগত দিক বা অর্থনৈতিক দিক যে কোনো বিবেচনায় মধু মাসের মধু ফল আমাদের জীবনের একটি অপরিহার্য কৃষিজাত ও অর্থকরী ফসল।  ‍সুতরাং কিছু সংখ্যক অসাধু ও অতিমুনাফালোভী ব্যবসায়ীর কাছে এ খাতকে ছেড়ে দিয়ে বসে থাকতে পারি না। এর জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতিরোধ। রাষ্ট্র অনেকটাই এগিয়ে এসেছে। চলুন এখন দেশের সব শ্রেণী পেশার মানুষ আমরাও এগিয়ে যাই।