যুদ্ধাপরাধী বিচার ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াত-শিবিরের হরতাল এই প্রথম ছয় জনের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননা মামলা

মাহবুবুল আলম
Published : 3 Jan 2015, 07:15 PM
Updated : 3 Jan 2015, 07:15 PM

যুদ্ধাপরাধ বিচার মামলায় ট্রাইব্যুনালের রায়ে জামাতের প্রথম সারির নেতাদের একের পর এক ফাঁসির রায়ের পর পরই জামায়াত শিবির কর্তৃক এক বা একাধিক দিনের হরতাল আহ্বান করে সহিংসতার মাধ্যমে সেসব হরতাল পালনের মাধ্যমে জামায়াত শিবির শুধু আদালত অবমাননাই করছে না, তাদের এ হরতাল আহ্বান সংবিধান লঙ্ঘনেরও সামিল এ কথা বলেছেন দেশের বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা। তাই জামায়াত-শিবিরের বার বার একই পন্থায় হরতাল পালন করে দেশে আদালত অবমাননার সংষ্কৃতি চালু করতে চাচ্ছে বলে দেশের সাধারণ মানুষও মনে করছে।

বাংলা একাডেমি প্রণীত ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে হরতাল শব্দটির যে বিশ্লেষণ করা হয়েছে তাতে হরতাল অর্থ ধর্মঘট, বিক্ষোভ প্রকাশ করার জন্য যানবাহন, হাট বাজার, দোকানপাট, অফিস-আদালত ইত্যাদি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ রাখা। Oxford dictionary-তে strike ( হরতাল) এর explain করা হয়েছে এভাবে- The organined refusal by employees work until some grievance is reaedid. অার সাধারণ অর্থে হরতাল হলো সরকারের কোন সিদ্ধান্ত বা কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের নীতি হিসেবে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে দৈনন্দিন কার্যক্রম থেকে বিরত থাকা। কিন্তু বর্তমানে হরতালের বাস্তবতার চিত্র আর এ অর্থে নেই। বর্তমানে জামায়াত-শিবির যে সব হরতাল ডেকেছে তা সরকারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেই নয়, দেয়া হচ্ছে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধেও। যা আদালত ও সংবিধান অবমাননার সামিল। এছাড়া সরকারের কোন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো জ্বালাও-পোড়াও কর্মসূচীর যে সহিংস হরতাল পালন করছে তা সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এব্যপারে দেশের আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সরকারী কোন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার অধিকার দেশের প্রতিটি নাগরিকেরই রয়েছে। তবে প্রতিবাদের নামে গাড়ি ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, ককটেল বিস্ফোরণের মতো সহিংস কর্মকান্ড পরিচালনা করে দেশের অন্য নাগরিকের চলাফেরা-কাজকর্মে বাধা দেয়ার অধিকার কারও নেই। সংবিধান তা সমর্থন করে না।

ইদানিং দেশের প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিক গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছে যে, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়তই হরতাল দিয়ে যাচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দল জামায়াত-শিবির। আবার একই সাথে প্রতিটি রায়ের বিরুদ্ধেই তারা সর্বোচ্চ আদালতে আপীলও করছেন। এটাকে জামায়াত-শিবিরের ডাবল ট্যান্ডার্ড রাজনীতি হিসেবে অভিহিত করছে দেশের মানুষ। এ বিষয়ে আইনজ্ঞরা বলছেন, আদালতে যখন মামলাটি আসে, বাদী পক্ষ ও বিবাদী পক্ষ উভয়েই থাকে । রায় যে কোন এক পক্ষেই যাবে এটাই স্বাভাবিক। তবে বিচারিক আদালতে কোন রায় যদি কারও বিরুদ্ধে যায়, তিনি উচ্চ আদালতে আপীল করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে নিম্ন আদালতের রায় হলে হাইকোর্টে এবং হাইকোর্টের কোন রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করতে হবে সুপ্রীমকোর্টে। সুপ্রীমকোর্টের রায় চূড়ান্ত থাকবে। তা দুই পক্ষকেই মেনে নিতে হবে। আইনজ্ঞরা আরও বলছেন, বর্তমানে জামায়াত ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে হরতাল দিচ্ছে, যা আদালত অবমাননার শামিল। আবার তারা সুপ্রীমকোর্টে আপীলও করছেন। বিষয়টি কোনভাবেই হাল্কা করে দেখার অবকাশ নেই। এই কর্মকান্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত সকলেই আদালত অবমাননার দায়ে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। এদের শাস্তির ব্যবস্থা না করা হলে অনেকেই আদালতের সিদ্ধান্ত অমান্য করতে উৎসাহিত হবে বলেও মনে করেছেন আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা।

প্রতিবারের মতো এইবারও আইসিটি কর্তৃক জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামকে ফাঁসির দন্ডে দন্ডিত করে রায় ঘোষণার পর পরই জামায়াত-শিবির দুই দিনের হরতাল আহ্বান করে সহিংসতা চালিয়ে মানুষ মেরে যানবাহনে আগুন দিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির পাশাপাশি মানুষের স্বাভাবিত জীবন যাত্রাকে ব্যহত করার অপচেষ্টা করে। কিন্তু দেশের মানুষ জামায়াতে ডাকা এই দুই দিনের হরতালকে ঘৃণাভরে প্রত্যাক্ষাণ করে, রাস্তায় বেরিয়ে এসে সারা দেশের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক করে তোলে। তবুও জামায়াত-শিবির সারাদেশেই সহিংসতার চালানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ।

এ বিষয়ে সংবাদ মাধমের সাথে আলাপকালে আইন মন্ত্রীসহ আইবিদরা যা বলেছেন তা সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হলো। আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, জামায়াত এদেশের স্বাধীনতাকেই বিশ্বাস করে না। এ কারণেই তারা দেশের সংসদে পাস করা আইনের দ্বারা গঠিত একটি আদালতের (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল) রায়ের বিরুদ্ধে হরতাল দিচ্ছে। এর মাধ্যমে তারা ট্রাইব্যুনালের সম্মান ক্ষুন্ন করছে। …আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হরতাল অবশ্যই আদালত অবমাননার শামিল। জামায়াতের এসব কর্মকান্ডেরই আইন করে জামায়াত নিষিদ্ধ করার যৌক্তিকতা পাওয়া যায় বলেও মন্তব্য করেন আইনমন্ত্রী। হরতালে আতঙ্ক সৃষ্টি করার বিষয়ে তিনি বলেন, হরতালে সংঘটিত বিভিন্ন ধরনের অপকর্ম রাষ্ট্রদ্রোহিতা, জনগণকে ভয়ভীতি দেখানো, বাসে আগুন দেয়া, সাধারণ জনতার জানমালের ক্ষয়ক্ষতিসাধন, ভাংচুর, লুটতরাজ ইত্যাদি বাংলাদেশের সংবিধান আদৌ সমর্থন করে না এবং তা দ-বিধি, ১৮৬০ অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

এ বিষয়ে অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল মমতাজ উদ্দিন ফকির জনকণ্ঠকে বলেন, আদালতের আদেশ সকলের মানতে হবে। কেউ না মানলে তা আদালত অবমাননার অপরাধ হবে। জামায়াতও এখানে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে হরতাল দিয়ে আদালত অবমাননার অপরাধ করেছে। এজন্য অবশ্যই তাদের শাস্তি পাওয়া উচিত। সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ শ ম রেজাউল করিম বলেন, একটি আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াত যে হরতাল পালন করে তা, দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধান এবং প্রচলিত অন্যান্য আইনের চূড়ান্ত অবমাননা। এছাড়া বিষয়টি আদালতেরও অবমাননা। তিনি বলেন, এই কর্মকান্ডের যারা জড়িত, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যেভাবেই হোক সকলেই আদালত অবমাননার দায়ে শাস্তি যোগ্য অপরাধ করেছেন। তিনি আরও বলেন, এ বিষয়টিকে কোনভাবেই হাল্কা করে দেখার অবকাশ নেই। এই কর্মককান্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা করা না হলে আরও অনেকেই আদালতের আদেশ ও আইন অমান্য করতে উৎসাহিত হবে। …এর ফলে আইনের শাসন, বিচার ব্যবস্থা ও প্রচলিত রীতি-নীতি চূড়ান্ত ভাবে ভেঙে পরবে। যা সভ্যতাকে ধ্বংস করে দুর্বৃত্তায়ন ও পেশি শক্তির উদ্ভব ঘটাবে। আদালত অবমাননার রুল ইস্যুর পরেও হরতাল পালন জামায়াতের চরম ঔদ্ধত্যপনাই প্রমাণ।

এ প্রেক্ষিতে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছিল তাদের বিরুদ্ধে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে হরতাল ডাকা এবং রায় নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করায় জামায়াত ইসলামী এবং দলের ভারপ্রাপ্ত আমির ও সেক্রেটারি জেনারেল, ছাত্র শিবিরের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, আইনজীবী তাজুল ইসলামসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার বরাবর ৪৯ পৃষ্ঠার লিখিত অভিযোগটি দাখিল করেন প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম। যাঁদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হয়েছে তাঁদের মধ্যে রয়েছেন, জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমেদ, ভারপ্রাপ্ত নায়েবে আমির মহিবুর রহমান ও ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ড. শফিকুর রহমান এবং ছাত্রশিবিরের সভাপতি আব্দুল জব্বার ও সাধারণ সম্পাদক মোঃ আতিকুর রহমান। এছাড়া সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলাম। চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে ট্রাইব্যুনাল-১-এ সোমবার এ বিষয়ে শুনানি হতে পারে বলে জানিয়েছেন প্রসিকিউটর তাপস কান্তি বল। তিনি বলেন, বাংলাদেশে এই প্রথম কোন রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে রায়ের বিরুদ্ধে হরতাল ডাকায় আদালত অবমাননার মামলা দায়ের করা হলো। এর আগেও ২০১২ সালের আইসিবি মিসসিলিনিযাস বিডি কেস নং ১৪ ও ১৫ তে ট্রাইব্যুনাল এ্যাডভোকেট তাজুল ইমলামকে সাবধান করে আদালত অবমাননার অভিযোগ থেকে ক্ষমা করেন। তখন তাজুল ইসলাম ট্রাইব্যুনালে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছিলেন। তারপরও এই রায় ঘোষণার পর পর প্রতিক্রিয়ায় এ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেন, 'ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশন যে সাক্ষ্য-প্রমাণ দিয়েছে সেটা গ্রহণ না করে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলা হলেই সুবিচার হতো। যে তিন সাক্ষীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে এটিএম আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদন্ডাদেশ দেয়া হয়, তার একজন সাক্ষী ৬ কিলোমিটার, একজন ৩ কিলোমিটার এবং দেড় কিলোমিটার দূরে দাঁড়িয়ে রেলগাড়ি থেকে তাকে নামতে দেখেছেন। এই সাক্ষীর ভিত্তিতে ফৌজদারি আইনে বিচার করা যায় না। এটিএম আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে উত্থাপিত সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ফাঁসি তো দূরের কথা প্রসিকিউশনের জরিমানা করা হলে ভাল হতো।' এর পাশাপাশি জামায়াতের নেতৃবৃন্দ রায়ের প্রতিক্রিয়ায় নানা ধরনের মন্তব্য করেছেন। যা আদালত অবমাননার শামিল। বৃহস্পতিবার প্রসিকিউশনের একটি টিম জামায়াতসহ সাতজনের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ দায়ের করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ রেজিস্ট্রারের দফতরে। প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালূম পরে সাংবাদিকদের বলেন, 'আজহারের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন যে সাক্ষ্য-প্রমাণ দিয়েছেন, সেটা গ্রহণ না করে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলা হলেই সুবিচার হতো' তাজুলের এমন বক্তব্যে আদালত অবমাননা হয়েছে। তাজুলের বক্তব্যের বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল-১-এর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। প্রসিকিউটর মালূম বলেন, জামায়াত নেতা এটিএম আজহারের রায়ের পর আসামিপক্ষ থেকে তাজুল ইসলাম যে বক্তব্য, অঙ্গভঙ্গি ও শব্দচয়ন করেছেন তা মোটেই আইনজীবীসুলভ ছিল না। অভিযোগ শুনে প্রসিকিউশনকে লিখিত অভিযোগ দাখিল করার পরামর্শ দেয় ট্রাইব্যুনাল। সে মোতাবেক বুধবার তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দাখিল করা হয়।

পরিশেষে এই বলেই শেষ করবো বাংলাদেশ ও এ দেশের আইন-কানুন ও সংবিধান যারা মেনে চলেন সবাইকে দেশের আইন-কানুন আদালতের রায় মেনে চলতে হবে। তা না হলে দেশের আইনের শাসনের কাঠামো ভেঙে পড়রবে। দেশে আইন ও বিচাররের রায় অমান্যের সংষ্কৃতি চাল হবে; যা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। আশা করি এ বিষয়ে আদালতে যে আদালত অবমাননার মামলা দাখিল করা হয়েছে, তা যথাযথ শুনানীর মাধ্যমে ব্যবস্থা নিতে হবে। তা করতে পারলেই কেবল ভবিষ্যতে দেশের প্রচলিত আইন ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে বাধ্য হবে প্রতিটি নাগরিক।