সংগ্রামী মেধাবীদের জন্য শিক্ষাবৃত্তি

মাহফুজুর রহমান মানিক
Published : 15 June 2012, 05:43 PM
Updated : 15 June 2012, 05:43 PM

প্রতি বছর পাবলিক পরীক্ষা ফল প্রকাশের পরই গণমাধ্যমে কিছু অদম্য মেধাবীর সন্ধান পাওয়া যায়। যারা বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যে পড়াশোনা করে সম্মানজনক ফল করে থাকে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে সর্বোচ্চ গ্রেড জিপিএ ৫ হিসেবে, সাধারণত যারা 'এ প্লাস' পেয়ে থাকে, তারাই গণমাধ্যমে আসে; তবে সব সংগ্রামী প্লাসধারীই আসে এমনটা নয়। এ প্লাসধারী কিংবা যারা এ প্লাস পায়নি, এমন সব শিক্ষার্থীর অর্থনৈতিক সংগ্রামই উঠে আসে তাতে। ৮ মে এসএসসির ফল প্রকাশ পেল। এর পরই এমন কিছু অদম্য মেধাবীর কথা পত্রিকায় এলো, যাদের শিরোনামে পত্রিকাগুলো বলছে— দিনমজুর অদম্য মেধাবী, দারিদ্র্যজয়ী অদম্য মেধাবী বা গৃহপরিচারিকার কাজ করে জিপিএ ৫ পেয়েছে অদম্য মেধাবী। এসব শিরোনামই বলে এদের সংগ্রামটা অর্থনৈতিক।
পাবলিক পরীক্ষার পর এ ধরনের অর্থনৈতিক যুদ্ধে জয়ীদের যেমন দেখা যায়, ঠিক একই সঙ্গে বছরের বিভিন্ন সময়ে হাসিমাখা কিছু মুখ দেখা যায়; যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষাবৃত্তি পেয়ে থাকে। আমরা অবশ্য জানি না এ হাসিমাখা মুখগুলো আসলে ওই সংগ্রামী মেধাবীরা কি না। এ বিষয়ে যাওয়ার আগে শিক্ষাবৃত্তিতে আসি। বাংলাদেশে অনেক প্রতিষ্ঠানই প্রতি বছর শিক্ষাবৃত্তি দিয়ে থাকে। প্রতিষ্ঠানের কথা বললে মোটা দাগে ব্যাংকগুলোর কথাই বলতে হবে। অনেক ব্যাংকই, বিশেষ করে বেসরকারি ব্যাংকগুলো তাদের সামাজিক দায়িত্বের অংশ হিসেবে প্রতি বছর দরিদ্র ও মেধাবীদের এ শিক্ষাবৃত্তি দিয়ে থাকে। এ তালিকায় শীর্ষ ব্যাংক হলো ডাচ্-বাংলা ব্যাংক। এ ছাড়া ইসলামী ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকসহ আরও অনেক ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেমন গত ২৭ মে বণিক বার্তার খবর হলো 'সুবিধাবঞ্চিত ২০ শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দিল লংকাবাংলা ফাউন্ডেশন।'

এ ধরনের ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা যত বাড়বে, বাংলাদেশের শিক্ষার জন্য ততই মঙ্গল। প্রতি বছর ঠিক কত শিক্ষার্থী এ রকম শিক্ষাবৃত্তি পেয়ে থাকে, তা বের করা কঠিন। তবে টাকার অঙ্কটা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর দেখিয়েছেন ৪০ কোটি অর্থাৎ তিনি ব্যাংকগুলোর ২০১০ সালে শিক্ষাবৃত্তি বাবদ ব্যয়কে ধরে বলেছেন, বছরে তারা ৪০ কোটি টাকা ব্যয় করছে। ৪০ কোটি সামান্য টাকা নয়। আবার আমরা দেখছি, গত বছর কেবল ডাচ্-বাংলা ব্যাংকই তিন হাজার শিক্ষার্থীকে শিক্ষাবৃত্তি দিয়েছে। অন্যান্য ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠান মিলে এ সংখ্যাটা আরও কয়েক হাজার বাড়বে। সংখ্যাটা সার্বিক সংখ্যার চেয়ে হয়তো কম, তবে নেহাত কম নয়। প্রশ্নটা অন্য জায়গায় সেটা হলো, যাদের এ বৃত্তি পাওয়া উচিত, তারা পাচ্ছে কি না?

প্রশ্নটা করা হচ্ছে, যারা সত্যিকারার্থে অর্থনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পড়াশোনা করছে কিংবা যাদের পরিবার সন্তানদের পড়াশোনার খরচ জোগান দিতে একেবারে অক্ষম বা টাকা-পয়সা ছাড়া যাদের পড়াশোনা বন্ধ হবে, এ রকম শিক্ষার্থীরা শিক্ষাবৃত্তি পাচ্ছে কি না এর একটা উত্তর এমন হবে যে, নিশ্চয়ই তেমন শিক্ষার্থীই বৃত্তি পাচ্ছে। এটা ঠিক যারাই বৃত্তিটা পাচ্ছে, ফলাফলের দিক থেকে তারা মেধাবী। যেহেতু বলা চলে ব্যাংক নির্বাচক কমিটি শিক্ষাবৃত্তি দেয়ার ক্ষেত্রে রেজাল্টই প্রথমে দেখে। তবে অর্থনৈতিক অবস্থার দিক থেকে সবার এক রকম অবস্থা নয়। অনেকের হয়তো ভালো অবস্থাও থাকতে পারে।

ধরা যাক সব ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠান মিলে প্রতি বছর ছয়-সাত হাজার শিক্ষার্থী বৃত্তি পায়। প্রয়োজন হয়তো আরও কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর। যেহেতু অনেকেরই প্রয়োজন, ফলে প্রতিযোগিতায় তারাই এগিয়ে থাকুক, যাদের প্রয়োজনটা অন্যদের চেয়ে বেশি। বলা হয়, প্রয়োজন হলেও এরাই যে পাচ্ছে তা নয়; অন্যরাও পাচ্ছে। অন্যরা পাবে কেন? অন্যরা পাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু বিষয় নিশ্চয়ই আছে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষাবৃত্তির প্রচারের কথাটা শুরুতেই আসবে। দেখা গেল কোনো প্রতিষ্ঠান শিক্ষাবৃত্তির বিজ্ঞপ্তি দিল। বেশির ভাগ সময় দেখা যায়, ব্যাংকগুলো একটা পত্রিকায়ই বিজ্ঞপ্তি দেয়; অনেকে আবার দুটায়ও দিয়ে থাকে। এ বিজ্ঞপ্তি ঠিক যে শিক্ষার্থীর দেখা উচিত, সে হয়তো দেখল না। সে না দেখলে বা না জানলে তো আবেদন করতে পারবে না। অথচ বৃত্তিটা তারই প্রয়োজন। যারা একেবারে গ্রামে থাকে, তাদের পত্রিকার মাধ্যমে জানানো অসম্ভবই বলা চলে। ফলে বৃত্তি প্রচারের কাজটা জরুরি। অন্তত শিক্ষার্থীদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে জানানো দরকার। সব প্রতিষ্ঠান বৃত্তির খবর পেলে সব শিক্ষার্থীও সহজে বিষয়টা জানতে পারবে।

শিক্ষাবৃত্তি যেহেতু ব্যাংকগুলোই বেশির ভাগ দিয়ে থাকে, ফলে সব ব্যাংক একত্রে বৃত্তিটা দিতে পারে। সাধারণত প্রতি বছর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার পর ব্যাংকগুলো এ বৃত্তির বিজ্ঞপ্তি দিয়ে থাকে। সব ব্যাংক যদি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রচার চালিয়ে একসময়ে বৃত্তি আবেদনপত্র গ্রহণ করে এবং তা দেয়ার ক্ষেত্রে পরস্পর সমন্বয় করে, তাহলে প্রকৃতপক্ষে যাদের প্রয়োজন, আশা করা যায় তারা বৃত্তিটা পাবে এবং উপকৃত হবে।

আরেকটা বিষয় হলো, ব্যাংকগুলো বৃত্তি দেয় এসএসসি-এইচএসির ফলের ভিত্তিতে— এইচএসসি এবং অনার্স লেভেলে ভর্তির পর। এটার যৌক্তিকতা আছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ভালো ফল করা সত্ত্বেও অবস্থা এতটা শোচনীয় যে, পরবর্তী পর্যায়ে ভর্তির জন্য টাকা নেই। এখন কলেজে ভর্তি হতে গেলে অনেক টাকার প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভর্তি হতে ফরম কিনতেই হয়তো কয়েক হাজার টাকা লেগে যায়। যাদের পক্ষে এসব খরচ বহন করা সম্ভব নয়, তাদের ভর্তি অনেকটা অনিশ্চিত। গ্রামের অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী আসলেই টাকার অভাবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে পারে না। হয়তো এসব শিক্ষার্থী সহযোগিতা পেলে উচ্চশিক্ষার প্রতিযোগিতায় তাদের স্থান করে নিতে সক্ষম হতো। কারণ গ্রামের যে শিক্ষার্থীটি অন্তত জিপিএ৫ এর কাছাকাছি পেয়েছে, তার মেধা শহরের জিপিএ৫-এর তুলনায় বেশি বলা যায়। এ ক্ষেত্রে তাদের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করতে বৃত্তিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো কিছু করতে পারে কি?। সাধারণত ব্যাংকগুলো যে বৃত্তি দেয়, তাতে শিক্ষার্থীরা নিশ্চিত থাকে না যে সেটি পাবে; যেহেতু তাকে আবেদন করতে হচ্ছে এবং তার মতো আরও অন্যদের ছাড়িয়ে সে পাবে কি না, সে নিশ্চয়তাও তার নেই। এখন যাদের কথা বলা হচ্ছে, তাদের একটা নিশ্চয়তা দরকার, আমি উচ্চশিক্ষায় সুযোগ পেলে ভর্তিসহ পড়াশোনা চালানোর নিশ্চয়তা পাব। তাদের বিষয়টা আপাতত প্রস্তাব আকারেই থাক।

উচ্চশিক্ষা বিস্তারে ব্যাংকসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাবৃত্তি নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এভাবে সবাই সামাজিক দায়িত্বের অংশ হিসেবে এগিয়ে এলে আমাদের উচ্চশিক্ষায় অংশগ্রহণসহ সার্বিক চেহারাটা বদলে যেত। আগামী দিনে সত্যিকার অদম্য মেধাবীদের অন্তত টাকার অভাবে উচ্চশিক্ষার পথ বন্ধ হতে দেবে না আমাদের সমাজ; এ প্রত্যাশা করা যেতেই পারে।

লেখাটি প্রকাশিত