তালেবান, মুক্তিযোদ্ধা ও ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 15 Feb 2012, 12:26 PM
Updated : 18 August 2021, 12:23 PM

মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাদের আত্মমর্যাদা ও সম্মান সবার ওপরে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত বিসর্জনের পরও আমরা জঙ্গি, রাজাকার ও মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে পার্থক্য বুঝি না। একে-ওকে রাজাকার বলে যেমন রাজাকারের ঘৃণ্যরূপটাকে হাল্কা করে ফেলি, আবার জঙ্গি-সন্ত্রাসীকে মুক্তিযোদ্ধা বলে দেশের প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অমর্যাদা করি। সর্বশেষ এই কাজটি করেছেন দেশের খ্যাতিমান মুক্তিযোদ্ধা ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভায় তালেবানকে মুক্তিযোদ্ধা আখ্যায়িত করে তাদের সমর্থন করার আহবান জানান।

ডা. চৌধুরীর এই বক্তব্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অত্যন্ত অবমাননাকর। একইসঙ্গে তালেবানকে মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট দেওয়াটা দেশের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপজ্জনক। কারণ তালেবান মোটেও মুক্তিযুদ্ধ করছে না। তারা একটা হিংস্র জঙ্গি সংগঠন। আফগান রাজনীতিবিদদের অযোগ্যতা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের ভূমিকার কারণে এখন শক্তিসঞ্চয় করে সমর্থন বাড়িয়েছে বটে, কিন্তু তারা মোটেও আফগান জাতির জন্য শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বা কল্যাণকর কোনো সংগঠন নয়। মানুষের মুক্তি তো দূরের কথা, তালেবানের কথা উচ্চারণ করলেই মনে পড়ে তাদের নৃশংসতার কথা। মনে পড়ে ড. নজিবুল্লাহর কথা।

১৯৮৭ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ড. নজিবুল্লাহ। সেই নজিবুল্লাহকে ১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বরে ক্ষমতা দখলের পর তালেবানরা নৃশংসভাবে হত্যা করে। প্রথমে নজিবুল্লাহ ও তার ভাইকে বেধড়ক মারধর করা হয়। জিপের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে ঘোরানো হয় শহরে। তার পর লিঙ্গচ্ছেদ করা হয় তাদের। শেষে গুলি করে মেরে প্রেসিডেন্ট ভবনের বাইরে বিদ্যুতের খুঁটিতে ক্ষতবিক্ষত দেহ ঝুলিয়ে রাখা হয়। নজিবুল্লাহর হত্যার মাধ্যমেই প্রথম তালেবান নৃশংসতার সাক্ষী হয় গোটা বিশ্ব। এমনকি সৌদি আরব, যারা কি না তালেবানের মিত্র বলে পরিচিত, তারাও নজিবুল্লাহ হত্যার তীব্র নিন্দা করে। তালেবানের আচরণ ইসলামবিরোধী বলেও মন্তব্য করে তারা।

শুধু জঙ্গি তৎপরতাই নয়, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালে তালেবানের শাসনামলে প্রকাশ্যে হত্যা, শিরোচ্ছেদ, গুলি, শিশুদের স্কুলে বোমা মারাসহ এমন কোনো নৃশংস কাজ নেই যা তারা করেনি। তারা নারীদের স্কুল ও কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল। ঘুড়ি ওড়ানো, ফুটবল, দাবাসহ অনেক খেলা নিষিদ্ধ করেছিল। টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, গান, বাদ্যযন্ত্র এবং স্যাটেলাইটের মতো সাধারণ বিনোদনও নিষিদ্ধ করেছিল। নিষিদ্ধ জিনিসের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল জীবন্ত প্রাণীর ছবি বা শোপিস। এমনি অসংখ্যা জংলি নিয়ম ও ফতোয়া জারি করে, যা অনেক ক্ষেত্রেই ছিল প্রগতি ও মানবতাবিরোধী।

তালেবানের অতীত কর্মকাণ্ড শুভবুদ্ধিসম্পন্ন যেকোনো মানুষের কাছেই ভয় এবং আতঙ্কের। মাত্র কিছু দিন আগে পুলিৎজার জয়ী চিত্রসাংবাদিক দানিশ সিদ্দিকিকে তারা নির্মমভাবে হত্যা করেছে তার 'ভারতীয়' পরিচয়ের কারণে। এবার ক্ষমতা দখলের লগ্নে তারা এক নারীকে একা রাস্তায় বের হওয়ার অভিযোগে গুলি করে হত্যা করেছে। গত তিন দশকে তারা মধ্যযুগীয় কায়দায় মসজিদে বোমা মেরে নামাজরত মুসল্লিকে হত্যা করেছে, বাসে বোমা মেরে নিরীহ যাত্রীদের হত্যা করেছে, শপিংমলে বোমা মেরে, স্কুলে ঢুকে বাচ্চাদের হত্যা করেছে, নারীদের তুলে নিয়ে গিয়ে ভোগ করেছে, জোর করে তাদের দাসী বানিয়েছে, যারাই অবাধ্য হয়েছে তাদের উপর বর্বর হামলা চালিয়েছে।

এমন একটি একটি চিহ্নিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তুলনা করাটা মোটেও শুভবুদ্ধির পরিচায়ক নয়। বরং এতে তিনি নিজেই তালেবানি আদর্শের অনুসারী কিনা, সেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। খোদ জাতিসংঘ তালেবানদের বিরুদ্ধে অন্তত ১৫টি যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এনেছে। এই যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্তদের যদি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তাহলে কী 'মুক্তিযোদ্ধা' কথাটির কোনো মর্যাদা থাকে? তালেবানকে মহিমান্বিত করতে গিয়ে ডা. চৌধুরী যে দেশের ত্রিশ লক্ষ শহীদ ও অগণন মুক্তিযোদ্ধাকে খাটো করলেন, তা কি বুঝতে পেরেছেন?

শুধু ডা. চৌধুরীর এই মন্তব্যই নয়, দেশে এক শ্রেণির 'নব্য বুদ্ধিজীবী' সম্ভাব্য তালেবানি নৃশংসতার ভয়ে আফগানিস্তান থেকে পালাতে যাওয়া ব্যক্তিদের 'রাজাকার' হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছেন। এটা খুবই অনুশোচনার বিষয় যে, আমাদের দেশে এক শ্রেণির মানুষের কাছে হিরা আর চিড়া এক দরে বিক্রি হচ্ছে। ঘাতক পাচ্ছে বীরের সম্মান। উন্মত্ত জঙ্গিদের ভয়ে ভীত ব্যক্তিদের দেশ ছাড়ার ইচ্ছেকে 'রাজাকারি সিদ্ধান্ত' হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

যে রাজাকাররা অসংখ্য নারী ধর্ষণ করেছে, মানুষকে ঘর থেকে বেঁধে এনে সারিবদ্ধভাবে হত্যা করেছে, বসতবাড়িতে আগুন লাগিয়েছে, লুটপাট করেছে, বুদ্ধিজীবীদের গুম ও হত্যা করেছে, সেই রাজাকারদের সঙ্গে প্রাণভয়ে আফগানিস্তান থেকে পালাতে চাওয়া অসংখ্য মানুষের তুলনা দেওয়া সত্যিই কাণ্ডজ্ঞাহীন ও অত্যন্ত ক্ষতিকর।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে দীর্ঘ ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধ করে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক দেশটিকে সংযোজিত করতে পেরেছি। এই যুদ্ধে শহীদ ও আহত প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তান। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি ফোটা রক্তই আমাদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। তাদের রক্তের দামেই আমাদের স্বাধীনতা। তাদের এই ঋণ শোধ করা হয়তো কখনই সম্ভব নয়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মানটুকু অটুট রাখার মধ্য দিয়েই আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সামান্য কর্তব্যটুকু পালন করতে পারি।

তালেবান-বিষয়ে ডা. জাফরুল্লাহর বক্তব্য সত্যিই খুব হতাশাজনক। নিজে একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে জঙ্গি আর মুক্তিযোদ্ধার পার্থক্য করতে না পারাটা অত্যন্ত দুঃখজনক। তার এই মন্তব্যের প্রতিবাদ জানাই। তালেবানের ব্যাপারে আমাদের প্রত্যেকেরই দায়িত্বশীল বক্তব্য প্রদান করা উচিত। কেননা এ ধরনের বক্তব্য দেশে জঙ্গিবাদ উত্থানে ভূমিকা পালন করবে। যারা আফগানিস্তানের তালেবানি উত্থানকে নানাভাবে সমর্থন যোগাচ্ছেন, তারা পরোক্ষভাবে এই দেশে জঙ্গিবাদের উত্থানে ভূমিকা পালন করছেন। এ ধরনের উস্কানিমূলক বক্তব্য অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত।

মনে রাখতে হবে যে, আমাদের দেশ এমনিতেই মৌলবাদী মানসের দেশ। এখানে প্রশাসনিক দাবড়ানির ভয়ে প্রকাশ্য জঙ্গি তৎপরতা কম থাকলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাজার হাজার তালেবান-প্রেমীর সরব উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। এই 'নাচুনে বুড়ি'দের জন্য ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মতো জ্যেষ্ঠ নাগরিকরা যদি 'ঢাকের বাড়ি'র আয়োজন করেন, তাহলে এরা বাংলাদেশে তালেবান-রাজত্ব কায়েমে এগিয়ে আসতে পারে।

সেটা ডা. চৌধুরীর জন্য সুখের হতে পারে, তবে দেশের আপামর মানুষের জন্য তা মোটেও কাঙ্ক্ষিত নয়।