ভারত যেভাবে পাকিস্তানকে শিক্ষা দিতে চায়

বিজন সরকার
Published : 4 Oct 2011, 05:24 AM
Updated : 1 Oct 2016, 11:14 AM

কাশ্মীরের উরিতে হামলার পরপরই ভারত পাকিস্তানের 'চোয়াল' খুলতে চেয়েছিল, বিশেষ করে রাজনীতিবিদের মধ্যে প্রতিশোধের তীব্র আগুন জ্বলতে দেখা যায়। কিন্তু ভারতের সেনাবাহিনী সামরিকভাবে জবাব দিতে আগ্রহী নয়। সেনাবাহিনীর মত হল, দুটি দেশই পারমাণবিক শক্তিধর হওয়ার ফলে নিয়ন্ত্রিত যুদ্ধ করা সম্ভব নয়। তাছাড়া ভারত সামরিক যুদ্ধে পাকিস্তানকে চারবার হারিয়েছে। ফলে পাকিস্তানের সাথে সামরিক শক্তি প্রদর্শনের কিছু নেই।

অবশ‌্য এরই মধ‌্যে ২৯ অক্টোবর মধ্যরাতে ভারতীয় সেনারা নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলওসি) পেরিয়ে পাকিস্তানের ভেতরে তিনটি স্থানে অতর্কিতভাবে 'সার্জিক্যাল স্ট্রাইক' নামের একটি অভিযান চালায়। স্থান তিনটি হল কেল, লিপা ও ভিমবার। ভারতের এই অপারেশন চলে রাত সাড়ে ১২টা থেকে ভোর সাড়ে ৪টা পর্যন্ত। ভারতের দাবি, এ অপারেশনে অন্তত ৩৮ জঙ্গি ও দুজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। সাতটি জঙ্গি আস্তানা গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিজেদের মুখ বাঁচাতে ভারতের সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের কথা অস্বীকার করছে। তবে হামলা পরিচালনা করার কয়েক ঘণ্টা আগে মার্কিন প্রশাসনের সাথে সম্ভাব্য হামলার বিষয়ে ভারতের কথা হয়েছে বলেই বিভিন্ন কূটনৈতিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। জম্মু-কাশ্মীরের উত্তেজনার পিছনে পাকিস্তানের সুস্পষ্ট মদদ থাকা সত্ত্বেও ভারত কোনো শক্ত অবস্থানে যায়নি। সমস্যাটি প্রকট হয় যখনই পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারতে জঙ্গি পাঠিয়ে উরিতে ১৮ জন ভারতীয় সেনাসদস্যকে হত্যা করে।

ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানের উত্তেজক আচরণের জবাবে রাজনীতিবিদদের সামরিক সংবেদনশীলতা না দেখানোর পরামর্শ দিয়েছেন। চিরায়ত অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ফলেই পাকিস্তান বেসামাল হয়ে পড়ছে বলে মনে করেন ভারতের সমর বিষয়ক নীতিনির্ধারকরা। ক্ষমতার টানাপোড়েন কিছুটা শান্ত হলেই পাকিস্তান নিস্তেজ হয়ে পড়বে। ফলে যুদ্ধের মতো জটিল বিষয়ে না জড়ানোই উচিত বলে মনে করেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর নীতি নির্ধারকরা। তাছাড়া বিশ্ব সম্প্রদায় সম্ভাব্য যুদ্ধ বর্তমান বাস্তবতায় মেনে নেবে না। ভারতের উপর যুদ্ধে না জড়ানোর চাপ আসছে।

বিশ্ব সম্প্রদায় না মেনে নেওয়ার পেছনে অনেকগুলি ভূ-রাজনৈতিক কারণ রয়েছে। যদি যুদ্ধ বাঁধে, বিদ্যমান তিনটি বৈশ্বিক সমস্যা আরও প্রকট হয়ে উঠবে। এ তিনটি সমস্যার দ্বারা ভারতই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমতাবস্থায় ভারতের যুদ্ধ এড়িয়ে চলার কৌশলের সাথে ভারতের সহযোগী দেশগুলির অবস্থান প্রায় অভিন্ন।

প্রথমত, ধর্মীয় জঙ্গিসংগঠন আইএস ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। সংগঠনটির বহু যোদ্ধা খতম হয়েছে; অনেকেই সংগঠন ছেড়ে পালিয়েছে। যদি পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে, সিরিয়া ও ইরাকের আইএসের বড় একটি অংশ পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের 'ডুরাল্ড লাইন' বরাবর উপজাতি অধ্যুষিত এলাকায় অবস্থান নেবে। এই সকল জঙ্গি-যোদ্ধারা পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে অবস্থিত আইএস, আল কায়েদা, তালেবান, তেহরিক-তালেবান, হাক্কানি নেটওয়ার্ক ও জইশ-ই-মুহাম্মদের মতো জঙ্গি সংগঠনের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। সন্ত্রাসীবান্ধব পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তখন জঙ্গিদের রাখঢাক না করে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিয়ে ভারতের বিপক্ষে যুদ্ধে নামাবে। গুড তালেবান ও ব্যাড তালেবানের মধ্যে যে রেখা টানতে ব্যস্ত থাকত, সেটিও সন্ত্রাসবান্ধব রাষ্ট্রটির পক্ষে সম্ভব হবে না।

অধিকন্তু, মুসলিম বিশ্বের দেশগুলি থেকে বহু স্বেচ্ছাসেবক যোদ্ধা পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ করতে যাবে, বিশেষ করে সুন্নি প্রধান মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি থেকে। এমনকি বাংলাদেশ থেকেও একটি অংশ পাকিস্তানে যেতে পারে ভারতের বিপক্ষে যুদ্ধ করতে।

সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ ছাড়াও মুসলিম বিশ্বের বহু দেশ পাকিস্তানকে সমর্থন দেবে; এমনকি যে সকল দেশের সাথে ভারতের বহুমাত্রিক ঘনিষ্ঠ ও পাকিস্তানের সাথে বৈরি সম্পর্ক রয়েছে। উদাহরণ: সৌদি আরব। এই বিশ্লেষণটির পিছনে যুক্তি হল, মুসলিম বিশ্বের নিষ্ক্রিয় সংগঠন ওআইসি পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছে। ওআইসি জম্মু-কাশ্মীরকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করে আরেকটি পাকিস্তানের মতো জঙ্গি-উৎপাদনকারী দেশ বানানোর পক্ষ নিয়েছে। জঙ্গিবান্ধব নীতির প্রতি এই সংগঠনটির নীরবতা মধ্যপ্রাচ্যে তথা বিশ্বব্যাপী জঙ্গি উত্থানে ভূমিকা রাখতে দেখা যায়।

এমতাবস্থায় বলা যায়, পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ লেগে গেলে পাকিস্তান সমাজ বিভক্তকারী ধর্মীয় প্যারামিটারটি ব্যবহার করবে। পাকিস্তান সন্ত্রাসবান্ধব রাষ্ট্র হিসেবে জঙ্গিদের নিয়ে বসবাস করার মতো একটি সামাজিক ব্যবস্থা ইতোমধ্যে বিনির্মাণ করেছে। পাকিস্তানের জঙ্গিবান্ধব সমাজে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী কী প্রভাব ফেলবে, পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এসব নিয়ে চিন্তিত নয়; ভারতকে কীভাবে কোণঠাসা করা যায়– সেটিই মুখ্য তাদের কাছে।

অন্যদিকে, পাকিস্তানে যদি জঙ্গিরা ও স্বেচ্ছাসেবক যোদ্ধারা ভারতের বিপক্ষে যুদ্ধে যায় সেটি ভারতের নিরাপত্তার জন্যও স্থায়ী হুমকি হয়ে উঠবে। ভারতের সামাজিক জীবনব্যবস্থায় বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। ভারতের চলমান অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

তৃতীয়ত, সম্ভাব্য পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ চীনের জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠতে পারে। দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের জোর দখলকারী আচরণটি চাপা পড়ে যাবে। যুদ্ধের ফলে দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের উত্থানের বিরোধিতাকারী ভারত কিছুটা হলেও নীরব হয়ে পড়বে। তবে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধটা হলে চীনের ভূ-রাজনৈতিক সুবিধা-অসুবিধা দুটোই হতে পারে।

পাকিস্তানে চীনের যে বিনিয়োগ রয়েছে কিংবা চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরে (সিপেক) চীনের সম্ভাব্য ৪৬ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের চেয়েও চীনের উত্থানবিরোধী ভারত যুদ্ধ করে সার্বিকভাবে চাপে পড়লে চীনের সুবিধাই হয়। পূর্ব এশিয়ায় বহু দেশ থাকলেও চীনের উত্থানকে রুখতে আমেরিকার পক্ষে সরাসরি ভারত ছাড়া অন্য কোনো দেশ ভিয়েতনামে নৌঘাঁটি করেনি। পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের ফলে এই অঞ্চলে জঙ্গিদের আরেকটি বড় ধরনের উত্থান ঘটলে সেটি ভূ-রাজনৈতিকভাবে ভারত ও তাদের পশ্চিমা মিত্রের জন্য বড় ধরনের হুমকি।

জঙ্গিদের উত্থান ঘটলে চীনের কিছুটা সমস্যা হবে। তবে জঙ্গিদের শায়েস্তা করার ক্ষমতা চীনের যথেষ্ট রয়েছে। কারণ, চীনের সাধারণ মানুষের কোনো 'মানবাধিকার' নেই! কারো কাছে জবাবদিহিতার দরকার নেই সরকারের। পশ্চিমা বিশ্ব ছাড়া চীনের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে অন্য কেউ কথা বলে না।

উইঘুরদের উপর যে নির্যাতন হয়, এমনকি রোজা রাখতে দেওয়া হয় না বলেও যেসব অভিযোগ পাওয়া যায়, সে বিষয়ে মুসলিম বিশ্বের কোনো কথা নেই। অথচ জম্মু ও কাশ্মীরের কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী পাকিস্তানের জঙ্গিবান্ধব সেনাবাহিনীর প্ররোচনায় জম্মু ও কাশ্মীরকে অস্থিতিশীল করল, তাতেই ওআইসির ঘুম ভাঙল। জম্মু-কাশ্মীরের মোট জনসংখ্যার ৪৭ শতাংশ নন-মুসলিম। এমনকি মুসলিম প্রধান কাশ্মীরের বড় দুটি দল ন্যাশনাল কনফারেন্স ও পিডিআই ভারতের থাকার পক্ষে, তবে আরও বেশি স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে। এর স্বপক্ষে একটি উদাহরণ নেই। জম্মু-কাশ্মীরের গত প্রাদেশিক নির্বাচনে হুরিয়ত নেতারা ও বিচ্ছিন্নতাবাদীরা নির্বাচন বর্জনের ডাক দিয়েছিল। তাদের সেই ডাক উপেক্ষা করে গত ২৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৬৫ শতাংশ ভোট পড়েছিল।

উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলি বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, ভারত পাকিস্তানের সাথে আপাতত কোনো ধরনের যুদ্ধে যাবে না। কিন্তু পাকিস্তানকে একটি উচিত শিক্ষা দিতে ভারত বদ্ধপরিকর। ভারত সেটি কূটনৈতিকভাবে দিতে চায়। ভারতের সহযোগী দেশগুলির অবস্থানও এক। উরিতে হামলার পর ভারতকে যুদ্ধে না জড়ানোর সহযোগী দেশগুলির পরামর্শ ভারত মেনে নিয়েছে। বিপরীতে ভারত পাকিস্তানকে বিশ্ব থেকে আলাদা করে দেওয়ার পরিকল্পনায় সহযোগী দেশগুলির সমর্থন চাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে সমর্থন দেওয়ার বিষয়টি প্রতিফলিত হচ্ছে।

ভারত পাকিস্তানকে দীর্ঘমেয়াদি বহুমাত্রিক প্রক্রিয়ায় বিশ্ব থেকে আলাদা করে দেওয়ার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। সামরিক ও রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, গণমাধ্যম ও সংস্কৃতির কর্তৃত্বের মাধ্যমে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার প্রক্রিয়াগুলি ভারত বাস্তবায়ন করবে।

জম্মু-কাশ্মীরের ইস্যুতে পাকিস্তান কোনো পরাশক্তিকে পাশে পাবে না। পশ্চিমা বিশ্বের কোনো দেশই জম্মু-কাশ্মীর নিয়ে কথা বলবে না। ধর্মের ভিত্তিতে জম্মু-কাশ্মীরকে ভাগ করে আরেকটি পাকিস্তান বানানোর পরিকল্পনায় পশ্চিমা বিশ্বের সায় নেই। এমনকি পাকিস্তানের একমাত্র জীবন রক্ষাকারী দেশ চীনও সরাসরি জম্মু-কাশ্মীর ইস্যুতে সরাসরি নাক গলাবে না। তাছাড়া কাশ্মীরের একটি অংশ চীনের কাছে। ফলে চীনের সেই নৈতিক সাহস নেই। অধিকন্তু, চীন জিনজিয়াং প্রদেশটি জোর করে দখল করে নিয়েছে। জিনজিয়াং প্রদেশের মুসলিম সংখ্যালঘু গোষ্ঠী উইঘুর মুসলমানরা দীর্ঘদিন ধরেই স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় চীন ধর্মভিত্তিক কাশ্মীর নামক নতুন রাষ্ট্রের পক্ষে কথা বলবে না। এখানে উপসংহারটি হল, পাকিস্তান যতই জম্মু-কাশ্মীর ইস্যুতে লম্পঝম্প করুক, কোনো পরাশক্তির সমর্থন মিলবে না।

ভারত প্রথমেই পাকিস্তানকে কূটনৈতিকভাবে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিশ্ব থেকে আলাদা করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। দেশটির পররাষ্ট্র বিভাগ পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় মদদে জঙ্গি উৎপাদনের নানান দলিল-দস্তাবেজ সহযোগী দেশগুলির সরকারের হাতে তুলে দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, উরিতে হামলাকারীদের ব্যবহৃত অস্ত্র, খাবারের প্যাকেজে পাকিস্তানের নাম-ঠিকানা ও জিপিএস ডিভাইসসহ অন্যান্য প্রমাণ আমেরিকাসহ ভারতের অন্যান্য সহযোগী দেশগুলির নিরাপত্তা এজেন্সিগুলির কাছে পাঠাচ্ছে।

পাকিস্তানের সেনাবাহিনী উরি হামলাতে জড়িত– তার অকাট্ট প্রমাণ পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে আরেক দফা জঙ্গি-উৎপাদক হিসেবে চিহ্নিত করবে। 'লাইন অব কন্ট্রোল'এর পাশে পাকিস্তানের ভূখণ্ডে প্রায় ৭৫টি জঙ্গি আস্তানা রয়েছে। ছবিসহ সেই সকল গোয়েন্দা তথ্য বিভিন্ন দেশের সাথে ভারত শেয়ার করছে। আমেরিকা ও জাতিসঙ্ঘের কালো তালিকাভুক্ত হাফিজ সাঈদ ও তার জঙ্গি সংগঠন পাকিস্তানে তারকা খ্যাতি নিয়ে কার্যক্ষম চালিয়ে যাচ্ছে। ভারত আমেরিকাসহ অন্যান্য রাষ্ট্রের কাছে বিষয়টি বারবার উত্থাপন করে আসছে।

পাকিস্তানকে আজকের সামরিক সক্ষমতায় যে দেশটি নিয়ে এসেছে সেই আমেরিকার জন্যই পাকিস্তান একটি বিষফোঁড়া। সন্ত্রাসবাদ নির্মূলের জন্য আমেরিকা পাকিস্তানকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দিয়েছে। পাকিস্তান সেই অর্থ দিয়ে জঙ্গি নির্মূল নয়, জঙ্গিদের সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করেছে।

নাইন-ইলেভেন হামলা পরবর্তী আমেরিকায় যে কয়টি জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে সেসবের অধিকাংশের সঙ্গেই রয়েছে পাকিস্তানি ব্যাকগ্রাউন্ড। ফলে আমেরিকার সমাজে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির গ্রহণযোগ্যতা এখন শূন্যে। গত সপ্তাহেই ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান দল থেকে দুজন কংগ্রেসম্যান পাকিস্তানকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ঘোষণা করার জন্য কংগ্রেসে বিল উত্থাপন করেন। এমনকি প্রবাসী ভারতীয়রা পাকিস্তানকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টায় শামিল হয়েছে। তারাও নানানভাবে বিশ্ব সম্প্রদায়কে চাপ দিচ্ছেন পাকিস্তানকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ঘোষণা করে নানান নিষেধাজ্ঞার আরোপ করার জন্য।

ভারত সরকার নীতিগতভাবে স্বাধীনতাকামী বেলুচদের পক্ষ নিয়েছে। দেশটির পররাষ্ট্র বিভাগ শক্তিশালী দেশ ও আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলিকে বেলুচিস্তানের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে সোচ্চার হওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ভারত বেলুচিস্তান ইস্যুতে ফলাফল পেতে শুরু করে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বেলুচিস্তানের মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এমনকি নিষেধাজ্ঞার প্রারম্ভিক হুমকি দেওয়া হয়েছে।

ভারত বেলুচিস্তানের স্বাধীনতাকামী মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য দেশটির পররাষ্ট্র বিভাগকে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সাথে যোগাযোগ করার নির্দেশ দিয়েছে। বেলুচিস্তানের জাতীয় নেতা নবাব আকবর বুগতির নাতি ব্রাহামদাগ বুগতি বেলুচ রিপাবলিকান পার্টির প্রতিষ্ঠাতা জুরিখে রাজনৈতিক শরণার্থী হিসেবে আছেন। ব্রাহামদাগ বুগতি সুইজারল্যান্ডে ভারতের ফরেন অফিসে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করছেন। ভারতের উচ্চ পর্যায় থেকে সবুজ সংকেত দেওয়া হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বসবাসকারী বেলুচ রাজনৈতিক ও বুদ্ধিজীবী সমাজের বড় একটি অংশ ভারতের আশ্রয় নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

ভারতের আহ্বানে সারা দিয়ে জার্মানি, ফ্রান্স ও রাশিয়াও পাকিস্তানকে জঙ্গিবাদ থেকে সরে আসার তাগিদ দিচ্ছে। দৃশ্যত এবারের জাতিসঙ্ঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ জঙ্গিবাদ থেকে বেড়িয়ে না আসলে সম্ভাব্য ফলাফল সম্পর্কে একটি ধারণা পেয়ে আসছেন। যে চীনের উপর ভিত্তি করে পাকিস্তান লাফাচ্ছে সেই চীনও পাকিস্তানকে জঙ্গিদের রাষ্ট্রের অংশ করার প্রক্রিয়ায় থেকে সরে আসার জন্য চাপ দিচ্ছে। চীনও যে পাকিস্তানিদের সামান্যতম বিশ্বাস করে না– সেটি চীন নানানভাবেই বুঝিয়ে দিচ্ছে।

চীনের হাংঝুতে অনুষ্ঠিতব্য জি-২০ সম্মেলনের সময় নিরাপত্তার কারণে পাকিস্তানের কোনো নাগরিককে সেখানকার হোটেলে থাকতে দেয়নি চীন। এমনকি যারা হোটেলে ছিল তাদেরও বের করে দেওয়া হয়। চীনের অর্থায়নে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের নিরাপত্তা নিয়েই চীন শঙ্কিত। এখনই চীনের পাঁচ হাজার শ্রমিকের নিরাপত্তার জন্য পাকিস্তানকে বিশ হাজারের অধিক সেনাসদস্য ও পুলিশ নিয়োগ করতে হচ্ছে। এমনকি গুয়াদার সমুদ্রবন্দরে চীনের বিনিয়োগ নিরাপত্তা প্রবল ঝুঁকির মুখে। এমতাবস্থায় পাকিস্তানের পক্ষে সরাসরি অবস্থান নেওয়া চীনের পক্ষে সম্ভব হয়। তবে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে সেটি চীনের জন্য ভিন্ন সমীকরণ হতে পারে।

পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমাজ ও গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে উরি হামলার পরপরই জানানো হয় যে পাকিস্তানে বহিরাগত আগ্রাসন (ভারতের) হলে চীন পাকিস্তানের পাশে থাকবে। পাকিস্তানের গণমাধ্যম এ ক্ষেত্রে লাহোরে চীনা কনসাল জেনারেল য়ু বোরেনকে সূত্র হিসাবে ব্যবহার করেছিল। পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী শাহবাজ শরিফকে এই আশ্বাস নাকি দিয়েছিল কনসাল জেনারেল য়ু বোরেন।

কিন্তু চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স্পষ্ট করেই জানিয়েছে, ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বে কোনো একটি দেশের পক্ষ নেওয়ার কথা চীন কোথাও বলেনি। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরও বলে, "কাশ্মীর প্রসঙ্গে চীন কোনো পক্ষ নিচ্ছে না। বিষয়টি দ্বিপক্ষীয় এবং নিজেদের মধ্যেই আলোচনা করে মীমাংসা করা উচিত। ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বে কোনো পক্ষ নেওয়ার ইচ্ছা চীনের নেই।" এমতাবস্থায় চীনকে যে পাকিস্তান পাশে পাচ্ছে না, সেটি পরিষ্কার।

ভারত আঞ্চলিকভাবেও পাকিস্তানকে একঘরে করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ইসলামাবাদে হওয়ার কথা থাকলেও এবারের সার্ক সম্মেলন বাতিল হয়েছে। উরি হামলার পর ভারত সার্কের চেয়ার নেপালকে জানিয়ে দেয়, ভারত সার্কের সম্মেলনে যাচ্ছে না। ভারতের যুক্তি, আঞ্চলিক সহযোগিতার শ্লোগান এবং সন্ত্রাসবাদ একসাথে চলতে পারে না। আফগানিস্তান ও ভুটানও সার্কের সম্মেলনে যোগ না দেওয়া সিদ্ধান্ত নেয়। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে সার্কের সম্মেলনে যাচ্ছেন না– সেটি কয়েক সপ্তাহ আগেই জানা গিয়েছিল। সার্কের দুটি মুসলিমপ্রধান সদস্যরাষ্ট্রও পাকিস্তানের পাশে নেই। ফলে আঞ্চলিকভাবেও পাকিস্তান একঘরে হয়ে যাচ্ছে।

ভারত পাকিস্তানকে অর্থনৈতিকভাবেই মোকাবেলা করতে চাচ্ছে। ভারত থেকে পাকিস্তান গত দুই দশক ধরে একতরফা বিশেষ বাণিজ্যিক সুবিধা পেয়ে আসছে। ভারত সেটি বাতিল করার সিদ্বান্ত নিতে যাচ্ছে। এমনকি ১৯৬০ সালে আইয়ুব খান ও জহরলাল নেহুরুর সময়ে স্বাক্ষরিত 'ইন্দুস পানি চুক্তি' থেকে ভারত বেড়িয়ে যাওয়ার চিন্তা করছে।

পাকিস্তানের জঙ্গিবাদী আচরণের প্রভাব ক্রীড়া ও সংস্কৃতি অঙ্গনেও পড়ছে। ভারত পাকিস্তানের মধ্যকার ক্রিকেট অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। অধিকন্তু ভারতে যে সকল পাকিস্তানের সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে ভারতে আয় রোজগার করছে, তাদেরও ভারত থেকে চলে যেতে বলার তাগিদ সমাজে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে।

ভারত পাকিস্তানকে চারবার যুদ্ধে পরাজিত করেছে। ফলে যুদ্ধ করে পাকিস্তানকে শিক্ষা দেওয়ার প্রক্রিয়াটি তেমন কার্যকর নয়। বিশ্ব রাজনীতিতে অর্জিত ইমেজ কাজে লাগিয়ে ভারত ক্রমশ পাকিস্তানকে আরেকটি 'উত্তর কোরিয়া' বানাতে অগ্রসর হচ্ছে।

মজার বিষয় হচ্ছে, ভারত পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সহজাত বৈশিষ্ট্যগুলি সদ্বব্যবহার করেই তাদের বিশ্ব থেকে আলাদা করছে।