ময়মনসিংহে রিকসাওয়ালা জয়নাল

মনোনেশ দাসমনোনেশ দাস
Published : 2 Oct 2014, 09:28 AM
Updated : 2 Oct 2014, 09:28 AM

ময়মনসিংহে রিকসাওয়ালা জয়নাল। রিকসা চালিয়ে হাসপাতাল গড়ে বাংলাদেশ তথা সারা বিশ্বে এক অনুকরণীয় অনুসরনীয় মহানুভব ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন ময়মনসিংহের জয়নাল আবেদীন । এখন তিনি ময়মনসিংহে গরীবের বন্ধু খেতাবে ভূষিত হয়েছেন । রিকসার প্যাডেলের আয়ে সংসারের ঘানি টেনে হাসপাতাল তৈরি খুবই দুরহ একটি কাজ । এই দুরহ দু:সাধ্য কাজটি তিনি করে দেখিয়ে দিয়েছেন । জনকল্যাণার্থে নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন হাসপাতাল । ইচ্ছা থাকলে উপায় হয় তিনি একজন উজ্বল দৃষ্টান্ত । পয়ষট্রী বছর বয়সী রিকসা চালক জয়নাল আবেদীন নিজের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে রক্ত ঘাম পানি করে গড়ে তুলেছেন হাসপাতালটি । নিজ মেয়ের নামে হাসপাতালটির নামকরণ করেছেন 'মমতাজ হাসপাতাল'। হাসপাতালটি স্থাপন করা হয়েছে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার পরানগঞ্জ ইউনিয়নের টান হাসাদিয়া গ্রামে ।
দুই হাজার এক সনে ছোট্র একটি আধা-পাঁকা টিনশেড ঘর তৈরী করে হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু করেন জয়নাল। তৎপরবর্তীতে তার প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালে দিন দিন বাড়তে থাকে চিকিৎসা সেবা প্রার্থী । তার হাসপাতালে বিনামূল্যে সেবা দেয়া হয়ে থাকে । এতে ক্রমশ: লোকমুখে মমতাজ হাসপাতালের সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে ।
ময়মনসিংহের পৌর শহর থেকে ব্রক্ষ্মপুত্র নদের ওপারে সতের কিলোমিটার মেঠোপথ পেরিয়ে চর এলাকা টান হাসাদিয়া গ্রাম। ওই এলাকায় কয়েক বছর আগে গ্রাম থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে একটি সরকারি উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরী হয়েছে। চিকিৎসার জন্য ময়মনসিংহে আসতে পাঁকা রাস্তায় গ্রামবাসীকে ত্রিশ কিলোমিটার ঘুরে যাতায়াত করতে হয়। আর বর্ষায় ট্রলারে করে ব্রক্ষ্মপুত্র নদ পেরিয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রায় বিশ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়।

জয়নাল জানান, তার বাবা ছিলেন গ্রামের ভূমিহীন কৃষক আব্দুল গনি। তার চার ছেলে ও পাঁচ মেয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়। অভাবের সংসারে কারোরই লেখাপড়ার সুযোগ হয়ে উঠেনি। দেশ স্বাধীনের কিছুদিন পর হঠাৎ এক রাতে বাবা আব্দুল গনি বুকে ব্যাথায় মারা যান। প্রতন্ত এলাকায় সে সময় কোনো হাসপাতাল বা চিকিৎসক ছিল না। ভোর হওয়ার আগেই তার বুকে মাথা রেখে বাবার মৃত্যু হয়। বিনা চিকিৎসায় বাবার মৃত্যু জয়নালকে ভীষণ যন্ত্রণা দেয়।জয়নালের স্ত্রী লাল বানু জানান, "পৈতৃক সূত্রে এক শতাংশ জমি নাই যার সেই তিনি বাড়ি ফিরে এক সাথে চব্বিশ শতাংশ জমি চল্লিশ হাজার টাকায় কিনে হাসপাতাল করার কথা বলায় অন্যদের সঙ্গে আমি নিজেও তখন উনাকে পাগল ভেবেছি। গ্রামবাসী হাসাহাসি করেছে। কিন্তু তিনি ঠিকই এক শুক্রবার গ্রামবাসীদের ডেকে তার মেয়ে মমতাজের নামে বিনামূল্যের হাসপাতাল করার কথা জানান। সে সময় সন্তানদের নিয়ে একবেলা খেয়েছি তো আরেক বেলা খেতে পাইনি। ভীষণ খারাপ লাগত স্বামীর এসব কাজ দেখে। এখন গ্রামবাসীদের মুখে কৃতজ্ঞতার হাসি দেখে বেশ ভাল লাগে।"

শুরু থেকেই পল্লী চিকিৎসক আলী হোসেন সপ্তাহে ছয়দিন সকাল নয়টা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত হাসপাতালে রোগী দেখছেন। এজন্য তিনি মাস প্রতি দেড় হাজার টাকা নেন। প্রথম দিকে একজন এম.বি.বি.এস. চিকিৎসক সপ্তাহে একদিন সাতশত টাকার বিনিময়ে রোগী দেখতে আসতেন। এখন সে ব্যবস্থাটি নেই। পল্লী চিকিৎসক আলী হোসেন জানান, 'জয়নাল কাকা আমার কাছে আসেন সহযোগীতার জন্য। তার মহৎ উদ্দেশ্য আমার ভাল লাগে। আমি পাশে দাঁড়াই। গ্রামের লোকজন আমাকে নিয়ে উপহাস করত। প্রতিদিন গড়ে শতাধিক রোগী আসে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য। সাধ্য মত ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করছি। প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার টাকার ওষুধ লাগে। এভাবেই জয়নাল আবেদীনের 'মমতাজ হাসাপাতাল' চলছে।'জয়নালের কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করে দুই হাজার পাঁচ সনে মার্কিন প্রবাসী শাহনাজ পারভিন এগিয়ে আসেন মমতাজ হাসপাতালের উন্নয়নে । তিনি এক হাজার মার্কিন ডলার দিয়ে হাসপাতাল উন্নয়নের জন্য জয়নালকে সহযোগীতা করেন। ঐ টাকায় হাসপাতালের জন্য একটি ঘর, কিছু প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র ও একটি ছোট পুকুর প্রতিষ্ঠা করেন জয়নাল। মার্কিন প্রবাসীর সহযোগীতা দেখে তার মত অনেকেই এগিয়ে আসেন মমতাজ হাসপাতালে মুক্ত হস্তে দানে এগিয়ে আসেন । হাসপাতালের জন্য নগদ টাকা ,জাম জমা , ভবন নির্মাণের সবই পান জয়নাল । এখনও পাচ্ছেন ।ক্ষয়িষ্ণু এই সমাজে একজন রিকসাচালকের নিষ্ঠা ও একাগ্রতা এবং মানুষের জন্য নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার এই উদাহরণ একটি অনুকরনীয় অনুসরনীয় মহানুভবতার নিদর্শন।

জয়নাল আবেদিন জানান, একসময় রিকসার প্যাডেল চাপতে চাপতে এই হাসপাতাল তৈরির স্বপ্ন দেখেছি । তখন পকেটে বড়(৫০/১০০) টাকার একটি নোট এলে সংসারের চাপ সামাল দেব , নাকি জমি জমা কেনার লোভ সামাল দেব তা নিয়ে দু:চিন্তায় পড়তাম। আর এখন আমার হাতে অনেক টাকা । এটাকায় আমার লোভ নেই । শুধু ভাবি হাসপাতালের উন্নয়ন আর মানুষের সেবা।