ময়মনসিংহে বদ্ধভূমি সংরক্ষণের দাবি

মনোনেশ দাসমনোনেশ দাস
Published : 1 Dec 2016, 06:48 PM
Updated : 1 Dec 2016, 06:48 PM

ময়মনসিংহে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে নির্মিত বদ্ধভূমিগুলি যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে বিনষ্ট হচ্ছে । মুক্তিযুদ্ধকালে ২৭ মার্চ রাতে স্থানীয় ইপিআর ক্যাম্পের ম্যাগাজিন কক্ষে ঢুকে ময়মনসিংহের কিছু সংখ্যাক যুবক প্রচুর পরিমাণ কার্তুজ এবং অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসে। ২৮ মার্চ সারাদিন পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে ময়মনসিংহের বাঙালি সিপাহী ও যুবকদের যুদ্ধ হয়। বিকেলে ইপিআর ক্যাম্পের পাকিস্তানী সৈন্যদের মৃত্যুতে তা বাঙালিদের দখলে আসে।

এই ক্যাম্পের অস্ত্র দিয়ে ময়মনসিংহ জিলা স্কুল মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে পাকবাহিনী ময়মনসিংহ শহরে নৃশংস হত্যাকান্ড শুরু করে যাদের সহায়তা করে রাজাকার এবং আল বদর বাহিনী।ইইই হত্যাকান্ডের প্রমাণ- যুদ্ধের পর ময়মনসিংহ শহরের ডাকবাংলো, কেওয়াটখালী, বড়বাজার, নিউমার্কেট, কালীবাড়ি এবং সাহেব আলী রোডের পুকুর থেকে পাওয়া নরকঙ্কাল। এই হত্যাকান্ড চালানোর জন্য পাকবাহিনী যখন ঢাকা থেকে ট্রেনে এবং নদীপথে কাওরাইদ এবং মধুপুর দিয়ে ময়মননসিংহে প্রবেশের চেষ্টা করে তখন মুক্তিবাহিনীর সাথে তাদের লড়াই হয়।
২৪ নভেম্বর রাতে কালো মুখোশধারী আল বদর বাহিনীর সদস্যরা ময়মনসিংহের সেরা ফুটবল খেলোয়াড় শাহেদ আলী (চুন্নু) এবং তার দুই বন্ধু রশিদ ও ফিরোজকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর তাদের আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। তারা সবাই ইপিআর ক্যাম্পে পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করেছিল। ৯ ডিসেম্বর যৌথবাহিনী তারাকান্দা দথল করে নেয় এবং ১০ ডিসেম্বর তারা ময়মনসিংহ শহরে প্রবেশ করে। এদিনই ময়মনসিংহ শহর স্বাধীন হয়। তৎকালীন যুব শিবির প্রধান অধ্যক্ষ মতিউর রহমান ববং মিত্রবাহিনীর বিগ্রেডিয়ার সনথ সিংহের নেতৃত্বে সম্মিলিত দল বিজয় পতাকা উড়িয়ে মুক্ত ময়মনসিংহ শহরে প্রবেশ করে। এরপর রাস্তায় নেমে আসে মুক্তিপাগল জনতার ঢল। মুক্তিযোদ্ধারা ময়মনসিংহে প্রবেশ করে সার্কিট হাউস প্রাঙ্গণে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে । ৯ এপ্রিল পাকবাহিনীর সাথে এখানে প্রথম যুদ্ধ শুরু হয়।

১৭ এপ্রিল কালীহাতিতে যুদ্ধ এবং ২২ এপ্রিল এখানে আকাশপথে শেল নিক্ষেপ করে পাকবাহিনী। হালুয়াঘাটে শেলের আঘাত এবং পাকবাহিনীর অগ্রসরমান যুদ্ধের এক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনী পিছু হটতে হটতে এখানে এসে জড়ো হয়। এখানেই ১১নং সেক্টরের এফজে সেক্টরকে চারটি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। এই সাব-সেক্টরগুলোর কমান্ডার ছিলেন যথাক্রমে নাজমুল হক তারা, তফাজ্জল হোসেন, এম এ আলম এবং নাজমুল আহসান। নাজমুল আহসান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। তার সম্মানে সেখানে এএটি ছাত্রাবাসের নামকরণ করা হয়েছে।
২৫ জুন ভালুকার ভাওয়ালীয়া বাজুরঘাটে আফসারউদ্দিনের নেতৃত্বে একটানা ৪২ ঘন্টা যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনীর ১২৫ জন সেনা নিহত হয়েছিল। এর পর আফসারউদ্দিন মুক্তিযোদ্ধাদের ককছ থেকে মেজর উপাধি পান। এখনও তিনি মেজর আফসারউদ্দিন নামেই পরিচিত। ১৭ জুলাই এখানকার দেইলপাড়ায় যুদ্ধ হয় এবং এখানে ১৭ জন পাক সেনা নিহত হয়। ভালুকার মল্লিকবাড়ি ইউনিয়নের স্কুলের নিকটে পাকিস্তানী সেনা সদস্যরা ৭ জন মহিলাকে ধরে এদের তাদের সম্ভ্রম নষ্ট করে এবং পরে সেখানে তাদের গণকবর দেয়। ৩ নভেম্বর হালুয়াঘাট উপজেলায় সবচেয়ে বৃহৎ যুদ্ধ সংঘটিত হয় তেলিখালীতে।

এ যুদ্ধে ২৯ জন মুক্তিযোদ্ধা, মিত্রবাহিনীর ৫৬ জন এবং পাকিস্তা সেনাবাহিনীর ১০৩ জন সদস্য নিহত হয়। এখান থেকেই প্রথম জীবিত কোন পাকেসানাকে ধরে নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের কাছে সমর্পণ করা হয়েছিল। নাকুগাঁও চেকপোস্টে যুদ্ধ হয়। ৭ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে যুদ্ধ করে হালুয়াঘাট দখল করে। ৮ ডিসেম্বর তারিখে ফুলপুর অঞ্চল মুক্ত হয় যৌথবাহিনীর আক্রমণে। ৬ আগস্ট বান্দরঘাটা যুদ্ধ । ২১ সেপ্টেম্বর তন্নর নামক স্থানে যুদ্ধ হয়। ময়মনসিংহ শহরে মোট ১২টি বধ্যভূমি ছিল। এছাড়া মানুষের লাশ ব্রহ্মপুত্র নদ, সুতিয়া নদী এং ক্ষীরু নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ডায়েরীতে একজন শিক্ষকসহ ১৮ জন শহীদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। শহীদের স্মৃতিকে ধরে রাখার লক্ষ্যে তাদের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ জামাল হোসেন হল, শহীদ শামসুল হক হল এবং শহীদ নাজমুল আহসান হল নামে তিনটি হলের নামকরণ করা হয়েছে।
রাজাকার-আলবদর বাহিনীর সহযোগিতায় পাক হানাদার বাহিনী ময়মনসিংহ শহরের আনাচে কানাচে থেকে মুক্তিকামী মানুষদের ধরে আনে বাকৃবির পাশ দিয়ে বহমান পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে। তা হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান এমন কোন লোক বাকি নেই যারা তাদের হাত থেকে বেঁচে ফিরেছে। হানাদার বাহিনী কুয়া খুড়ে ফেলে দেয় লাশ। কারো কারো লাশ শেয়াল, কুকুরের খাদ্য হিসেবে মাটির উপরে ফেলে রেখেই চলে যায়।
এ সকল বীর শহীদদের আত্মহুতিকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে বাকৃবির ফাস্টগেট এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় বধ্যভূমি।
১৯৯২ সালে বাংলাদেশ সরকারের পিডবলিওডি (চডউ) এর অর্থাায়ন ও পরিকল্পণায় বধ্যভূমির নির্মাণ কাজ শুরু এবং ১৯৯৩ সালের ১৪ নভেম্বর এ বধ্যভূমি উন্মোচন করা হয়।
একাত্তরে ময়মনসিংহ শহরের ছোটবাজার কুয়ার ভেতরে মিলেছিল অসংখ্য নারী পুরুষ ও শিশুর পচা ও অর্ধগলিত লাশ। রাজাকার, আলবদর ও অবাঙালী বিহারী কিলাররা মুক্তিকামী বাঙালীদের ধরে এনে হত্যার পর লাশ ফেলে দিত ছোটবাজারের এই কুয়ার ভেতরে। একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ মুক্ত হলে মুক্তিযোদ্ধা জনতা যখন শহরজুড়ে হারানো স্বজনদের খুঁজতে বের হয় তখনই সন্ধান মেলে কুয়ার ভেতরে অসংখ্য লাশ স্তুপাকারে পড়ে থাকা এ বধ্যভূমিটির। অথচ সংরক্ষণ না করে ভয়াল স্মৃতির সেই কুয়ার চিহ্নহ্নটি মুছে ফেলা হয়েছে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি, বধ্যভূমির সেই কুয়ার ওপর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ইসলামী ব্যাংক ভবন।


গত ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের আওয়ামী লীগ আমলে এ বধ্যভূমির ওপর সাইনবোর্ড ঝোলানো হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ জেলা ইউনিট কমান্ড-ময়মনসিংহ থেকে স্থানীয় জেলা প্রশাসনের কাছে বধ্যভূমিটি সংরক্ষণে আবেদন জানান হয়েছিল। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জায়গাটি উদ্ধারের দাবিতে শহরে মানববন্ধনও করেছেন। কিন্তু তারপরও এ নিয়ে কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের।
ময়মনসিংহে জেলা পরিষদের অর্থায়নে ডাকবাংলো সংলগ্ন ব্রক্ষপুত্র নদের বালুচরের বধ্যভূমি নির্মাণ করা হয় । এই বধ্যভূমির জায়গা দখল করে পাকা বিল্ডিং নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে। দখলের পাশাপাশি এটি এখন ময়লার ভাগাড় বানানো হয়েছে। বদ্ধভূমি সংরক্ষণের দাবী ময়মনসিংবাসীর।