মূর্তি এবং হেফাজতের সুবিধাবাদী রাজনীতি

মঞ্জুর মোর্শেদ
Published : 26 May 2017, 10:22 PM
Updated : 26 May 2017, 10:22 PM

ভাস্কর্য আর মূর্তির মধ্যে মোটা দাগের পার্থক্য আছে। মূর্তির সাথে ধর্মচার জড়িত এবং তার সাথে যুক্ত থাকে একটি  সম্প্রদায়ের  ইহকালের পূণ্য এবং তা  থেকে পরকালের লাভালাভ। যে ধার্মিক মানুষটি মূর্তিটিকে পূজা করেন বা তার কাছে মাথা ঝুঁকান তিনি সে রকমটিই ভাবেন। আর এর সাথে এডিটিভস বা বাড়তি উপকরণ হিসেবে ভালবাসা বা শ্রদ্ধা যোগ হলেও  মূল উদ্দেশ্য থাকে একটিই। সেটা হলো শক্তিমানকে খুশি করা। এক্ষেত্রে শক্তিমানটি সাধারণত ঈশ্বরই হয়ে থাকেন। তার কৃপা লাভের ব্যাপারটি এখানে মূল লক্ষ্য হিসেবে কাজ করে।

ভাস্কর্যের  আবেদনটি মূলত ইহজাগতিক। মাইকেল এঞ্জেলোর  ডেভিড  বাইবেলের হিরো হলেও  তার পেশীবহুল  মসৃন  সাদা মার্বেলের প্রায় ১৭ ফুট উঁচু  নগ্ন মূর্তিটিকে  সিভিল লিবার্টি বা  স্বাধীনতার প্রতিবিম্ব হিসেবে দেখা হয়।  পরবর্তীতে এর অনেক রেপ্লিকা তৈরি হয়েছে কোনটি ব্রোঞ্জের বা কোনটিতে কাপড় পরান হয়েছে। বাইবেলের চরিত্র হলেও  মাইকেল এঞ্জেলোর কর্মটি  শোর্য এবং স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে দেখা হয় বলে, শিল্পানুরাগীরা একে ভাস্কর্যই বলেন।  ভাস্কর্যগুলো সাধারণত খোলা জায়গায়,  প্রকৃতির মাঝেই রাখা হয়। এর মূল কারণটি মূলত  সাধারণের মাঝে এর অন্তর্নিহিত স্পিরিট ছড়িয়ে দেয়া।  আর এর যদি কোন ধর্মীয় বা পরলৌকিক ব্যাপার থাকত তাহলে তা উপাসনালয়ে ঠাঁই পেত।

কিছু ভাস্কর্য কাইনেটিক বা গতিকে  প্রতিবিম্বিত করে। রাজু ভাস্কর্যটি যেমন গতিশীল মিছিলের সম্মুখ ভাগকে তুলে ধরে।  দুটি ছাত্র সংগঠনের ক্যাডারদের গোলাগুলির মাঝে ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিবাদী  শান্তি মিছিলে রাজু গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান । তাই এই ভাস্কর্যটিরও একটা  মেসেজ আছে।

ইসলামে  যে কোন ধরনের প্রাণীর ছবি বা মূর্তিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।  এর পেছনে যুক্তিটি হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার সাথে শিরক বা অংশীদারিত্বের ব্যাপারটি চলে আসে। তারমানে  মূর্তি হউক বা ভাস্কর্যই হউক সেটা নিষিদ্ধ।  মানে দাঁড়াচ্ছে রাজু ভাস্কর্য যতই শান্তির কথা বলুক, ডেভিডের মূর্তি যতই নাগরিকের শোষণ থেকে মুক্তির কথা বলুক সেটা  সৃষ্টিকর্তার সাথে অংশীদারিত্বের মধ্যে পড়ে যায়।  তাই শান্তি এবং মুক্তির মতো মানবীয়  ব্যাপারগুলোও ইসলামিক ঈশ্বর অনুমোদন করেন না  যদি সেটা  দেহজ ভঙ্গিমায় প্রকাশিত হয়। প্রয়াত আহম্মদ ছফা এজন্যই কি বলেছিলেন, বাঙালি মুসলমান বিমূর্ত ব্যাপারগুলো বোঝে না!  নিজেদের মধ্যে  তুচ্ছাতিতুচ্ছ ব্যাপারগুলো নিয়ে কাজিয়ায় ব্যস্ত থাকে।  এজন্যই লিবিয়াতে বা আলজেরিয়ার মসজিদের সামনে  মূর্তি থাকলেও ওদের কোন মাথাব্যথা নেই ।

এবার আসি হেফাজতীয় সুবিধাবাদ নিয়ে। গতকাল চ্যানেল ৭১ এ  হেফাজতের ঢাকা  জেলার মুখ্য সচিব জনাব কাসেমীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তাহলে বঙ্গবন্ধু বা  জিয়াউর রহমানের  ভাস্কর্যের ব্যাপারে ওনার কি অবস্থান?  উনি স্পষ্টতই বললেন,  এনিয়ে উনারা কিছু বলছেন না। তারমানে কোরআনে বা হাদিসে ভাস্কর্য নিয়ে  যাই বলা থাকুক ধর্ম একটি পণ্য। এটাকে যেভাবে পারা যায় কাস্টমাইজ করে মানুষকে খাওয়ালেই হলো। অনলাইন এক্টিভিস্ট মুস্তাফিজ বললেন আজকে দেশে ধর্ষণ, হাওরে লাখ লাখ একর জমি মানব সৃষ্ট কারণে প্লাবিত হওয়ার মতো বড় বড় ইস্যু থাকলেও এনারা ভাস্কর্যের মতো নন ইস্যুকে ইস্যু বানাচ্ছেন। বার বার এনারা ৯২% মুসলমানের দেশ বলেন। যখন প্রশ্ন করা হলো এর মধ্যে হেফাজত কত পার্সেন্ট, উনি এড়িয়ে গেলেন।

আজকে  ভারতের উত্তর প্রদেশে দেওবন্দেও  আছেন । কিন্তু ওখানকার চরম সাম্প্রদায়িক  বিজেপি সরকার যখন  গো নিধনের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি দশ বছর কারাদণ্ড নির্ধারণ করলো তখন উনারা প্রতিবাদ তো দূরের কথা উল্টো মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন। জানেন  এ নিয়ে প্রতিবাদ করলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার ভয়। আদৌ কি  গণতান্ত্রিক ভারতে উনারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতেন? মোটেও না। সুবিধাবাদী  চরিত্রের কারণে উনারা সেটা করেনি। করেছে ফরোয়ার্ড ব্লক, সিপিএম । এদেশেও এনারা ইসলামের  সোল এজেন্সি নিয়ে সরকারের কাছ থেকে সুবিধা হিসেবে পান, রেলওয়ের জমি, আর বড় অংকের চাঁদা ।

যক্ষা রোগের জীবাণুটি শরীর থেকে পুরোপুরি বিতাড়িত হয় না, একবার যক্ষা হলে এরা থেকেই যায়। প্রতিকূল পরিবেশে এরা শরীরের মধ্যে কোষগুলোকে প্রাচীর বানিয়ে লুকিয়ে থাকে বছরের পর বছর। তারপর অনুকূল পরিবেশ পেলে যেমন  কোন কারণে রোগ প্রতিরোধ কমে গেলে  (ডায়াবেটিস, অপুষ্টি, স্টেরয়েড বা ধূমপান জনিত কারণে) এরা আবার স্ব মহিমায় ফিরে আসে।  তেমনি এ গোষ্ঠীটি  সরকারের কাছে  পুষ্টি পেয়ে  বাঙালি মুসলমানের ইসলামের মধ্যে প্যান ইসলামিজমের  ভাইরাস ঢোকাচ্ছে।