‘উন্নয়নের’ মহাসড়কে দেশ!

মঞ্জুর মোর্শেদ
Published : 12 June 2017, 04:01 AM
Updated : 12 June 2017, 04:01 AM

কর্মসংস্থান নেই, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ প্রায় স্থবির, রেমিটেন্স কমছে, অর্থ পাচার ক্রমাগত বাড়ছে, রপ্তানি আয় কমছে, সরকারের ধার ক্রমাগত বাড়ছে। এ অবস্থায় এবার বাজেট পেশের সময়ে অর্থমন্ত্রী বলেছেন উন্নয়নের মহাসড়কে উঠেছে দেশ। যদি সত্যি সত্যিই আমরা উন্নয়নের মহাসড়কে পা দেই তাহলে কেন ক্রমাগত মানুষ বিদেশে পালাচ্ছে। জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ ডঃ সাদাত হোসেন বললেন লিবিয়া থেকে  ভূমধ্য সাগর  অতিক্রম করে যে পরিমাণ লোক ইউরোপে পাড়ি জমাচ্ছে তার মধ্যে বাংলাদেশ হচ্ছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। তাহলে দেশ ছেড়ে এরা কেন পালাচ্ছে? উন্নয়নের মহাসড়কে দেশ থাকলে তো এটা হওয়ার কথা ছিল না।

প্রশ্ন আসছে তাহলে উন্নয়নটা হচ্ছে কোথায়? অবকাঠামোতে? এটা করতে যেয়ে সরকার দেদারছে টাকা ধার করছে, কাছের লোকজনকে কাজ পাইয়ে দেয়া বা তাদের অর্থ প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে প্রকল্প ব্যয় বাড়ান হচ্ছে, সেজন্য সরকার ব্যাংক থেকে সমানে লোনও করছে। মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্তর উপর করের বোঝা চাপিয়ে টাকার সংস্থান করতে যেয়ে এই শ্রেণীটিকে পিষে মারার বন্দোবস্ত হচ্ছে।

তাবৎ অর্থনীতিবিদ রা একটা ব্যাপারে একমত। সেটা হলো অর্থনীতির কোন সংজ্ঞাতেই এই বাজেট পড়ে না। ঘাটতি যেখানে জিডিপির ৫% এর বেশি হওয়ার কথা না সেখানে ঘাটতি হচ্ছে এক লাখ আটত্রিশ হাজার কোটি টাকার মতো। মোট বাজেটেরই প্রায় এক তৃতীয়াংশ। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, হোসেন জিল্লুর রহমান, মির্জা আজিজুল ইসলাম, সাদাত হোসেন  সবাই একই কথা বলছেন। আমি অর্থনীতির জটিল সমিকরণ তাত্বিক ভাবে উপস্থাপন বা ব্যাখ্যা কোনটাই করতে সমর্থ নই। কিন্তু মূল ব্যাপারগুলো সাধারণের মতোই কম বেশি বোঝার চেষ্টা করি।

একটা ব্যাপারে ওনারা মানে অর্থনীতিবিদরা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আস্থাহীনতা  যদি কমতেই থাকে, বিনিয়োগের টাকা যদি বাইরে যেতে থাকে তাহলে ধারকর্জ করে প্রকল্প চালানো সরকার দেশের অর্থনীতির অবস্থা গ্রিস, স্পেনের মত বানিয়ে ছাড়বে।

আজকে বিদ্যুতের দাম, গ্যাসের দাম, মোটা চালের দাম ক্রমাগত বাড়তে থাকায় মধ্যবিত্তের ক্রয় ক্ষমতা কমছে। সেদিন প্রথম আলোতে পড়লাম নিম্ন আয়ের মানুষ ভাত খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। এই অত্যাবশ্যকীয় শর্করা টি শরীরের জ্বালানির প্রধান উৎস। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যাকে এভাবে অপুষ্টির দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। ঋণভারে জর্জরিত সরকার বাধ্যহয়েই শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় কমাচ্ছে।  আজকে পুরো স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে চিন্তা না করে এডহক ভিত্তিতে কমিউনিটি ক্লিনিক বা এদিক ওদিক কিছু হাসপাতাল বানিয়ে, প্রকৃত সেবা প্রদানে ব্যার্থ হচ্ছে সরকার। কমিউনিটি ক্লিনিক গুলোতে ডাক্তারের পরিবর্তে হেলথ এসিস্টেন্ট বা দেখা যাচ্ছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ওয়ার্ড বয় বা ক্লিনারও  স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করছে।  যেখানে সত্যিকারের কোন রেফারেল সিস্টেম নেই, মানে রোগী জানে না তার সেবাটির জন্য কোথায় যেতে হবে, তখন এসব এডহক পলিসি কোন কাজে আসে না।  শুধু স্বাস্থ্য সেবা কেন, কোন কিছু নিয়ে সার্বিক চিন্তা করতে না পারলে এমনই তো হওয়া  যুক্তিসংগত।

সব সমস্যার মূল, ব্যক্তি খাতে নতুন বিনিয়োগ প্রায়ই বন্ধ। যেখানে কোন হরতাল নেই, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা (দমবন্ধকর) বিদ্যমান, ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগে বাধা কোথায়? এ প্রশ্ন করা হয়েছিল এফবিসিআই এর সাবেক চেয়ারম্যান মাতলুব আহমেদ কে। উনার কথায় বোঝা গেল যেখানে জনজীবনে স্বতঃস্ফূর্ততা নেই, মানুষ নিজের মত করে চলতে ফিরতে পারে না, দুর্নীতিটা যেখানে সীমাহীন সেখানে ব্যবসায়ীরা কি করবে। চারদিকে  যখন এমপি, মন্ত্রী এবং তার পুত্র-পরিবারদের ক্রমাগত ফুলে ফেঁপে উঠার গল্পই চলে, তখন জনমানুষের মনে একধরণের হতাশা চেপে বসে। সে তার ভালোলাগা বা আচার আচরণকে সংকুচিত করে ফেলে।

সবচেয়ে খারাপ যেটা হয় তা হলো এক ধরনের নেতিবাচক মানসিকতা থেকে সে ব্যয় করাও বন্ধ করে দেয়। এতে সামগ্রিক ভাবে ব্যবসায় ধস নামে। আজকে নিটোল এবং হামিম গ্রুপের মত বড় ব্যাক্তি মালিকরা আমেরিকা বা দক্ষিণ আফ্রিকায় বিনিয়োগের জন্য সরকারের অনুমতি চেয়েছে। মাতলুব আহমেদ বলেন এই মুহূর্তে দশ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের মতো শিল্প তিনি এখনই করতে পারেন। কিন্তু দেশের  সার্বিক পরিস্থিতিতে এটা সম্ভব না। আমাদের দেশে এমুহূর্তে ব্যক্তিমালিকানায় বিনিয়োগ মোট বিনিয়গের মাত্র ২২%।  যেটা বিগত বছর গুলোতে আরও বেশি ছিল।

ডঃ সাদাত হোসেনের মতে দেশের অর্থনীতিতে এখন অলৌকিক বা উনার ভাষায় মাজেজার মতো ব্যাপার ঘটছে। অর্থাৎ  ইনপুট কম কিন্তু আউটপুট বেশি। মানে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। এতে করে গ্রিস বা মেক্সিকোর মতো দেউলিয়া হতে বেশি সময় লাগবে না।

মাসিক আঠারো হাজার টাকা যার আয় তাকে আয়কর দিতে হচ্ছে আর যার আট হাজার কোটি টাকা ব্যাংক লোন আছে, ঢাকার বাইরে যার বাগান বাড়ির শান সৌকত রাজা বাদশাহদের হার মানায়, যার বউ-বাচ্চা  বিদেশে বাড়ি কিনে বসবাস করছে তাকে আয়কর দিতে হয় না। কারণ তিনি ঋণগ্রস্থ।

দেশে এখন খেলাপি ঋণ দেড় লাখ কোটি টাকার মত। যারা ঋণ নিয়ে টাকা ফেরত দিচ্ছে না তাদের ৪৫০০০ কোটি টাকার মত ঋণ সরকার মাফ করলেও এ ঘাটতি পুষাচ্ছে মধ্যবিত্তের উপর করের বোঝা চাপিয়ে, গ্যাসের দাম বাড়িয়ে ঠিকই টাকা বের করে নিচ্ছে। মানুষ যখন ৪৫০ টাকা গ্যাসের বিল দিত তখনো তিতাস লাভজনক প্রতিষ্ঠান ছিল। আর এখন ৯৫০ টাকা গ্যাসের বিল ধার্য করে মধ্যবিত্তকে চুষে সরকার ধনী পোষার বন্দোবস্ত করছে। সরকার যুক্তি দিচ্ছে আগামি বছর গুলোতে যখন গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে এলএনজি (লিকুইড ন্যাচারাল গ্যাস) চালু হবে তখন মধ্যবিত্তকে গুনতে হবে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা। তাই এখন থেকেই তৈরি হতে হবে। কিন্তু সমুদ্রে টার্মিনাল করে বড় জাহাজে তরল গ্যাস আমদানি করলে খরচ তিতাসের মতই হওয়ার কথা। এ মতামত বিশেষজ্ঞদের।

পাকিস্তানে নাকি মোট বাজেটের ৪০%  সেনাবাহিনীর পেছনে, ৪০% সরকারের ব্যয় আর মাত্র ২০% উন্নয়ন বাজেটে ব্যয় হয়। পাকিস্থানের মতো না হলেও অনুৎপাদনশীল খাতে বা সীমাহীন দুর্নীতির কারনে লাগামহীন ব্যায় আমাদেরও কম নয়। কর্মসংস্থান না করে, মধ্যবিত্তের আয় না বাড়িয়ে  সরকার যখন উন্নয়নের মহোৎসব করছে তখন ক্রমাগত নিঃশেষ হতে থাকা মধ্যবিত্তের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাইরে পালানোটাই একমাত্র রাস্তা হয়ে যায়।

আমাদের এখন ফার্টিলিটি রেট বা নারী প্রতি উৎপাদন ক্ষমতা ২.৩ আর এটা যদি আগামী দু বছরে ১.৬ এ নামানো না যায় তাহলে ২০১৮ তে জনসংখ্যা ঠেকবে ১৮ কোটিতে। এই বাড়তি চাপের কথা অর্থনীতিবিদরা এখনই বলছেন। সরকারের কাছে এটা কোন সমস্যা নয়। না হলে বাল্যবিবাহ জায়েজ করে জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে সরকার অবদান রাখত না।

হাওরে যখন ধান ডুবে গেল তখন সরকার বলল হাওর থেকে মাত্র ২০ ভাগ ধান আসে। তাছাড়া  খাদ্যে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ, মজুদও অনেক। তাহলে খাদ্য আমদানির কথা আসছে কোত্থেকে বা চালের দামই বা বাড়ছে কেন।

লালসালু উপন্যাসে যখন মজিদ মহব্বত নগর গ্রামে আসে তখন সে ধর্মের বুলি আউড়িয়ে, মানুষকে পরকালের কঠিন আজাবের ভয় দেখিয়ে নিজের অবস্থানকে পোক্ত করে। কিন্তু গ্রামে যখন একসময় শিলা বৃষ্টির সাথে ঝড় আসতে থাকে তখন ফসলহানির ভয়ে হাহাকার করতে থাকা কৃষক মজিদের শরণাপন্ন  হয়। আর কোন সমাধান করতে পারবে না জেনে মজিদ সারারাত ঝড়ের ধ্বংসযজ্ঞ দেখে পরের দিন ভোরবেলা মহব্বত নগর গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। আমাদের এই সরকারটির প্রস্থান কি মজিদের মতোই হবে? নাকি মধ্যবিত্তের ওপর চলতে থাকা ধ্বংসযজ্ঞ অব্যাহত থাকবে?