এবার জনগণের টাকায় হজ

মঞ্জুর মোর্শেদ
Published : 9 August 2017, 07:50 PM
Updated : 9 August 2017, 07:50 PM

এ বছর   জনগনের বা করদাতার পয়সায়  ৩১৮ জন 'ধর্মপ্রাণ মুসলমান' হজে যাচ্ছেন। টাকার অংকটা এখানে ব্যাপার নয় । যে দেশে হাজার কোটি টাকা লোপাট না হলে মানুষ বা মিডিয়া  নড়ে চড়ে বসে  না সেখানে  সরকার সোয়া দশ কোটি টাকা ব্যয় করে এসব সূর্য সন্তানদের হজে পাঠাচ্ছেন সেটা নিয়ে আলোচনারই বা দরকার কি! কিন্তু প্রশ্নটা যেখানে নৈতিকতার সেখানে অবশ্যই  এটা নিয়ে কথা বলতে হবে।  এখন দেখতে হবে এই কৃতি সন্তানরা কোন জন? গত বুধবার ৯ই আগস্ট ডেইলি স্টার এ  এনিয়ে বিস্তারিত এসেছে । সেদিন প্রধানমন্ত্রী  সংসদে  দুটি দৈনিকের বিরুদ্ধে বিষোদগার করলেন। ডেইলি স্টার হচ্ছে এর একটি। আর অন্যটি হচ্ছে প্রথম আলো।

এই ভাগ্যবানদের  বেশির ভাগই হচ্ছেন ময়মনসিংহ, গোপালগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ এবিং ফরিদপুরের। এর আবার ৭৯ জনই হচ্ছেন ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমানের আত্মীয়, ব্যক্তিগত কর্মচারী। উনি ২০০৯ এ ময়মনসিংহ ৪ আসনের এমপি নির্বাচিত (??) হয়েছিলেন । এর আগে "হজ এসিস্টেন্ট ডেলিগেশনের"  নামে ধর্মমন্ত্রী  ১৭১ জনকে সৌদি আরব পাঠিয়েছিলেন। এর মধ্যে ৭১ জনই ছিলেন গভমেন্ট স্টাফ।  আরো ছিলেন মন্ত্রীর দুজন গানম্যান এবং একান্ত ব্যক্তিগত সহকারি।

এই ফ্রি হজ লিস্টে  ১০ জন আওয়ামী লীগ নেতা, ৩ জন এমপি, ১৫ জন বঙ্গভবনের কর্মচারী, ২৪ জন গণভবনের এবং প্রধানমন্ত্রীর অফিসের  কর্মচারীও আছেন। এখন প্রশ্ন উঠছে একজন মন্ত্রী (ধর্মমন্ত্রী) কী করে তার নির্বাচনী এলাকায়  ৮০ জনকে পাবলিকের টাকায় হজে পাঠাতে পারেন। প্রধানমন্ত্রীও কি পারেন তার তাবৎ কর্মচারীদের এভাবে বিশেষ সুবিধাভোগী করে রাখতে?  দেশ সেবার জন্য যারা সরকারে থাকেন তারা যদি নিজেদের সেবায় ব্যস্ত থাকেন তাহলে জনগণকে দেখবে কে?  যারা এই ফ্রি হজ  লিস্টে আছেন তাদের ৯৫% ই  শুধু ধনী নন , অসম্ভব ধনী। রাষ্ট্র কর্তৃক  এদের  কে  বিশেষ সুবিধাভোগী বানানো এবং সাধারণকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া যে তোমার অবস্থান অনেক নীচে।  আর তোমাকে যদি ওপরে উঠতে হয় তাহলে শাসকের কাছের লোক হতে হবে।  এখানে কি নৈতিকতার ছিটেফোঁটাও আছে?

সফুরা বেগম যিনি সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি, উনি আবার জোর গলায় বলেছেন প্রধানমন্ত্রী ওনাকে শুধু হজে পাঠাচ্ছেন না,  উনার আরো দায়িত্ব হচ্ছে  সৌদিতে হজের সার্বিক ব্যবস্থাপনা এবং হাজিদের দেখাশোনা করা। যেন সৌদি সরকার এ ব্যাপারে যথেষ্ট পারঙ্গম নন। যেখানে সৌদি সরকার ব্যর্থ হবেন সেখানে  সুপারম্যানের মত ত্রাতা হিসেবে সফুরা বেগমরা আবির্ভুত হবেন।

আমাদের জাতীয় হজ এবং ওমরা পলিসিতে প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট এবং ধর্ম মন্ত্রণালয় দ্বারা ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের  এরকম লিস্ট বানিয়ে  হজ্বে পাঠানোর বিধান রয়েছে। দিন দিন এ লিস্ট  বড় হচ্ছে। ২০১৪ -তে ছিল ২২৪ জন, পনেরোতে ২৬৫ জন, ২০১৬ -তে ২৮০ আর ২০১৭ -তে ৩১৮ জন। সরকার মনোনীত  এই ধর্মপ্রাণদের  চল্লিশ দিনের এই হজ টুরিজ্যমে শুধু খাওয়া বাবদ দেয়া হচ্ছে জনপ্রতি ৩৪৪০০ টাকা । আর দেশে সরকারি কর্মচারি হিসেবে বেতন আর অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা তো আছেই।

যে সাধারণ জনগণ  টাকা-পয়সা পরিশোধ করেও  বিভিন্ন জটিলতার কারণে এখনো হজে না যেতে পারার উৎকণ্ঠায় মুহূর্ত কাটাচ্ছেন এসব জেনে  তারা কি নিজেদের পরিহাসের পাত্র মনে করছেন না?

ফ্রান্সের ফার্স্ট লেডির সাংবিধানিক ভাবে কোন অফিসিয়াল পোস্ট নেই। মানে জনগণের টাকা তার পেছনে খরচ করা যাবে না। যদিও তিনি এলিসি প্রাসাদে একটা কক্ষ এবং  দু'জন বডিগার্ড পেতে পারেন। প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রন একে ফ্রেঞ্চ হিপক্রেসি বলেছেন। তিনি ফার্স্ট লেডির রোল টিকে সংজ্ঞায়িত করতে যেয়ে বলেছেন যে ব্যক্তিটি উদয়ান্ত খাটছে, দেশের জন্য কাজ করছে, তার সঙ্গীটি যে তার সাথে সার্বক্ষণিক থাকছে তার ভূমিকাটি নিশ্চিত করা উচিত। জনগণ যখন ম্যাক্রনের এসব ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলার মানে বুঝতে শুরু করল তখনই শুরু হয় গণস্বাক্ষরতা অভিযান।  প্রায় দু লক্ষ সাক্ষর সম্বলিত পত্রে মানুষ সাফ জানিয়ে দিয়েছে তারা ফার্স্ট লেডির কোন ভূমিকাই দেখতে চায় না। যথারীতি ম্যাক্রন ও পিছু হটলেন। গণস্বাক্ষরতা দিয়ে ট্র্যাম্পের ইউকেতে আসাও থামিয়ে রাখা হয়েছে। দুই মিলিয়ন সাক্ষর দিয়ে জনগণ জানিয়ে দিয়েছে তারা এরকম অনৈতিক রাষ্ট্রপ্রধানের তাদের দেশে আগমনের বিরুদ্ধে। যথারীতি ট্র্যাম্পের আসাও পিছিয়ে গেল ২০১৮ পর্যন্ত । এটাই তো  পিপলস পাওয়ার । আজকে একজন ফাস্ট লেডিকে পুষতে ফ্রান্সের মতো একটা দেশের কিইবা টাকা খরচ হবে। কিন্তু তারা এটা নৈতিকভাবে মেনে নেয়নি। ধরুন আপনি এখন জনগণের টাকায় এই হজ ট্যুরিজমের বিপক্ষে সাক্ষরতা অভিযানে নামলেন। ভাবুন আপনার তখন কী হবে? আপনি হয়ে যাবেন নাস্তিক। হজ বিদ্বেষী। কিন্তু এসব বিভিন্ন ইস্যুকে নৈতিক ভাবে মোকাবেলা করার মত দল বা সংগঠন আমাদের কী আছে যারা জনগণকে সংগঠিত করে সরকারের এসব অনৈতিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিবাদ জানাবে? জনগন এখানেই সবচেয়ে বড় দুর্ভাগা। তারা কখনও শাসক এ দলের খাবারে আবার কখনো বি দলের খাবারে পরিনত হচ্ছে। আর নিঃশেষ হচ্ছে!