আমার বাড়ি কয়রা (১ম পর্ব )

মারুফ হুসাইন
Published : 26 May 2011, 02:42 PM
Updated : 26 May 2011, 02:42 PM

আইলা নিয়ে অনেক প্রতিবেদন দেখি, তাই ভাবলাম আমার কথা আমি না জানালে সত্যটা কেউ জানবেনা। তাই এ লেখা-

২৫ মে, ২০০৯, সোমবার, প্রতিদিন এর মতো আমি অফিসে এসে সকাল ১০.৩০ টায় আম্মার কাছে মোবাইল করলাম, আম্মা (গ্রামের বাড়িতে থাকতেন) জানালো খবর ভালো তবে প্রচণ্ড গরম । ১.৩০ এ হঠাৎ আম্মা জানালো ভেড়িবাঁধ ভেঙ্গে গেছে এবং পানির আসার শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে সব কিছু ডুবে যাবে। আমি বললাম চিন্তা করোনা, নদীর পানি আর কতো বাড়বে, বড় জোর উঠান পর্যন্ত বলে, রাখলাম। তারপর ২.৩০ মিনিটে মাহদি (কাজিন) জানালো ভাইয়া বাড়ীর খোঁজ রাখেন, ঘরে পানি উঠছে নাকি! আমি জানালাম, আরে না, পানি উঠেনি। ও বলল ভাইয়া কখন খোঁজ নিয়েছেন, এখন খোঁজ নেন। আমি আবার বাড়িতে খোঁজ নেওয়ার জন্য ফোন করলাম আম্মার কানেকশন পাচ্ছি না। ছোট ভাই বাড়ি ছিল ওকে ফোন করলাম ও ফোন ধরে বলল ভাইয়া বাড়ীর দিকের খবর ভালো না। ঘরের মধ্য ৬ ফুটের বেশী পানি উঠে গেছে আরও পানি আসছে। আমরা বাড়ীর ছাদে বসে আছি। ও আম্মাকে দিলো, আম্মা ফোন হাতে পেয়ে কেঁদে দিলো, বলল ভীষণ শব্দ করে পানি আসছে, মন হয় ছাদেও পানি উঠে যাবে, পাড়ার সব কাঁচা ঘর পানিতে ভেসে গেছে । সবাই আমাদের বাড়ি অথবা হাজী (আমার দাদার ছেঁটো ভাই) দাদার বাড়িতে উঠেছে। উল্লেখ্য পাড়ায় পাকা বাড়ি এই দুটি। আম্মা আরও জানালো ভয়ই পাচ্ছি, এভাবে পানি উঠলে আমাদের বিল্ডিং পানিতে ভেসে যাবে। আমি হতবাক! বললাম, আল্লাহকে ডাকা ছাড়া আমাদের আর কিছু করার নাই। নিশ্চয় আল্লাহ্‌ আমাদের সাহায্য করবেন। আমি নানা বাড়ি খোঁজ নিলাম (সাতক্ষিরা), মামা জানালে বাঁধ ভাংছে, পানি ঘরে উঠবে উঠবে করছে। কোন পূর্বাভাস ছাড়াই হটাত এধরনের জলোচ্ছ্বাসের ঘটনা এ অঞ্চলে এবারই প্রথম ঘটল।এর আগে যতবার জলোচ্ছাস হয়েছে ততবার আগে ঝড় ছিল এবং পানি কক্ষনো আমাদের ঘরে উঠেনি।

আমার মনে পড়ে সেই ১৯৮৮, ১৯৯১,১৯৯৫,১৯৯৮,২০০১ কোন বারই পানি ঘরে উঠেনি, এমন আচমকাও ছিল না। আচমকাও ছিল না বলে মিডিয়াতে আসতে দেরি হয়। আসলে এটা ছিল সুনামি। সেজন্য শুরু হয় সেদিন সন্ধ্যা থেকে প্রচণ্ড বৃষ্টি ও মাঝারি মাত্রার ঝড়। আর সেটাই ছিল ভয়ংকর কারন অধিকাংশ মানুষের গায়ের কাপড় ছাড়া আর কিছু কাছে ছিলনা। পানি এমন আচমকা এসে এবং বেড়ে যায় যে মানুষ জান বাঁচাতেই শুধু পরেছিল। আর যারা জিনিসপত্রের জন্য ছিল তারা পানিতে ভেসে যায়। পরদিন সকালে বৃষ্টি থেমে যায় এবং দেখতে পায় জলোচ্ছ্বাসের তাণ্ডব ? খাবার নাই, আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা নেই, ঘুমানোর জায়গা নাই, এমনকি খাওয়ার পানিও নাই। পরদিন খোঁজ করে দেখা গেলো আমাদের উত্তর বেদকাশি ইউনিয়ন দুপাশের পাশ দিয়া বয়ে যাওয়া কপোতাক্ষ ও শাকবাড়িয়া নদীর বাঁধ এর উপর দিয়ে পানি ঢুকেছে এবং ঢুকার সময় চার জায়গার বাঁধ ভেংগে গেছে। রাতে আমাদের ঘরে ছয় ফুট পানি উঠেছিলো। সকালে কমলে ও ঘরে তিন ফুট পানি থেকে যায়। অধিকাংশ গৃহপালিত পশু জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায়। আগে শুধু খাওয়ার পানির জন্য টিউবয়েল পানি লাগতো এখন সকল পানির উৎস হেয়ে উঠে টিউবয়েল। তাই আমার লঞ্চ যখন ২৮ শে মে ভোরে কয়রা উপজেলা এলাকায় পৌঁছলে তখন দেখলাম, লঞ্চ এর শব্দ শুনে মানুষ দল বেঁধে লঞ্চ ঘাটে ছুটচ্ছে, আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি পরে লঞ্চ ভিড়লে বুঝলাম, যখন দেখলাম তাদের সবার কাছে কলস অথবা পানির পাত্র, তারা পানি নিতে এসেছে। এটা ছিল কয়রার মহিশুরিপুর ইউনিয়ান, এ এলাকায় নলকূপে মিষ্টি পানি পাওয়া যেতো না। মানুষ বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে সারা বছর খেত। তাই এখন লঞ্চ গুলোই খাওয়ার পানির প্রধান উৎস, লঞ্চ থেকে পাম্প করে মানুষদের পানি দিচ্ছে, যেখানে ধনী গরীব সবাই সমান। আমি নামলাম নারায়নপুর, এখানেসহ চার ঘাটে পানি ইতোমধ্যে লঞ্চ থেকে দিলো, লঞ্চ এর সুকানি জানালো ২৬ তারিখ থেকে তারা নিয়িমিত এ কাজ করে যাচ্ছে। আমি যখন নামলাম তখন ভাটা তাই রাস্তা জেগে ছিল। এখান থেকে আমার বাড়ি ২৪ কিলোমিটার, তাই ভাবছিলাম কিভাবে যাব? এমন সময় ১টা ভাড়ায় চালিত মটর সাইকেল পেয়ে গেলাম। রওনা হলাম উপজেলা সদর আর উদ্দেশ্যে। পিচের রাস্তার উপর দিয়ে পানি বেয়ে যাচ্ছে তাই অনেক যায়গায় নামতে হল, রাস্তার উপর মানুষ মাচা বেঁধে ঘর করার কারনেও কয়েক জায়গায় থামতে হল। আমার সাইকেলের চালক একবার থামিয়ে দৌড় দিলো বমি করার জন্য, আসলে জিজ্ঞাসা করলাম, কি সমস্যা ? বলল গন্ধ পাচ্ছেন না? গন্ধের কারনে তার বমি। আসলেও রাস্তার চারিদিকে মরা মাছ আর গৃহপালিত পশু পাখির বিকট গন্ধ। অবশেষে উপজেলা সদর পৌঁছলাম, তখন এখানে রাস্তার উপর ১ ফুট পানি। আমার এক চাচার দোকান এখানে তাই তার সাথে দেখা করলাম, দোকান বন্ধ চাচা-চাচির ঘরে পানি তাই দোকান ঘরের ২ তলায় এখন আশ্রয় নিয়েছে। এখান থেকে আমার বাড়ি আরও ৬ কিলোমিটার, আসলে আমার বাড়ি থেকে সুন্দরবন মাত্র ১ কিলোমিটার দূরে। উপজেলা সদরে আমার আর এক চাচাকে পেয়ে গেলাম, চাচা আর আমি বাড়ির উদ্যেশ্যে রওনা হলাম। পুরা রাস্তাটাই ছিন্নভিন্ন কোথাও আছে, কোথাও নাই, রাস্তার উপর দিয়ে প্রচণ্ড বেগে পানি এপাশ থেকে ওপাশ যাচ্ছে। দু'জন হাতধরাধরি করে হাঁট হাঁটতে ৫ কিলোমিটার পথ বুক পানিতে ভিজে সাড়ে ৩ ঘণ্টায় পর বাড়ীতে পৌছে গেলাম। অথচ এই পথ ৪৫ মিনিটে কতো বার পার হয়েছি, যখন রিক্সা, ভ্যান কিছু ছিলনা।

(চলবে…………।)