স্মৃতিচারণঃ কাইয়ুম চৌধুরী- আঙুলে তাঁর বাংলাদেশের রঙ

মাজহার
Published : 30 Nov 2015, 06:37 PM
Updated : 30 Nov 2015, 06:37 PM

কাইয়ুম স্যারকে খুব মনে পড়ছে। গত বছর এই ৩০ নভেম্বর তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। ছোটবেলা থেকে আমি শুধু নিজের চোখ দিয়ে বাংলাদেশ দেখেনি, কাইয়ুম স্যারের ছবি দেখেও বাংলাদেশকে দেখেছি- চিনেছি। আমাদের বাসায় প্রচুর বই ছিলো, এখনো আছে। সেই শৈশবে বইয়ের মলাটে কিংবা বিকেলের ক্লান্ত পত্রিকার পাতাটা যখন সিলিং ফ্যানের বাতাসে আলতো দোল খেতো- তখোনো বিছানা থেকে আধঘুম অবস্থায় দেখতাম কাইয়ুম স্যারের একটি অনবদ্য ইলাস্ট্রেশন। আমাদের চেতনে- বিশ্রামে এমনি করে তিনি পাতায় পাতায় অক্ষরের পাশাপাশি কি দারুণ করে বাংলাদেশকে মূর্ত করে তুলতেন। যেহেতু ছোটোবেলা থেকেই পত্রিকার সাহিত্য পাতা খুলে বসে থাকার অভ্যাস ছিলো, কোন ছবি বা বইয়ের মলাট দেখেই বলে দিতে পারতাম এইটা কাইয়ুম স্যার এর আঁকা। স্কুল পেরিয়ে কলেজ, কলেজ পেরিয়ে যখন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলাম তখনো জীবনের নানা অনুষঙ্গে তাঁকে খুঁজে পেতাম। আর নিজেও লেখালেখি করি বলে খোঁজ রাখতাম কার বইয়ের প্রচ্ছদ কে একেঁছেন। কাইয়ুম স্যার এর নামলিপির ফ্রন্টই ছিল একটি অন্য বাংলাদেশ। চেয়ে থাকতো আমার দিকে। খুব ইচ্ছে করতো আমার বইয়ের প্রচ্ছদ তাঁকে দিয়ে আকিঁয়ে নিতে।

২০১৩ সালে আমার কবিতার বইয়ের পান্ডুলিপি তৈরি করে যাই কাইয়ুম স্যারের বাসায়। আমি তখন সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে থাকি। আমার হল থেকে হেঁটেই স্যার এর বাসায় যাওয়া যায়। আজিমপুর ছাপড়া মসজিদের পাশে তাঁর বাসা। অনেক খোঁজ করে পেয়েছিলাম তার বাসা। কিন্তু যখনই যাই ভেতর থেকে বলা হয় তিনি বাসায় নেই। দুই তিনদিন এরকম হলো। মামুন নামে  একজন থাকতেন ওই বাসায়।  ডিসেম্বরের শীতের মধ্যে কাইয়ুম স্যার এর বাসার নিচে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমি একা নই, কতো প্রকাশক আর গুণগ্রাহী আসতেন, দেখা করতেন কিংবা ফিরে যেতেন। আমি তাঁর কাছে কোন ভাবেই পৌঁছাতে পারছিলাম না। মামুন ভাই আমাকে বলতো- প্রচ্ছদ আঁকাতে হলে অন্তত পাঁচ ছয় মাস আগে থেকে বলে রাখতে হয়, এখন তাঁর সময় হবে না – উনি ব্যাস্ত – উনি দেশের বাইরে –  উনি এইমাত্র বের হয়ে গেলেন – উনি আজ অসুস্থ…। আমি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু হতাশ হইনি। বারবার প্রত্যাখান হওয়াতে গো ধরে গিয়েছিলো। মামুন ভাইকে বলেই বসলাম, ছবি তো আপনি একেঁ দিবেন না! দিবেন কাইয়ুম স্যার। আপনি শুধু তাঁর সাথে আমাকে দেখা করিয়ে দিন। বাকিটা আমি বুঝবো…। মামুন ভাই আমার একের পর এক বার আমার ফিরিয়ে দিয়ে শেষ পর্যন্ত আমাকে বললেন আচ্ছা আগামীকাল সকালে আসেন। কতো সকাল গেলো! হায় রে সকাল। শীতের সকালে ফজরের নামাজের আগেই আমি গিয়ে আজিমপুরে কাইয়ুম স্যার এর বাসায় নিচে দাঁড়িয়ে থাকতাম । একদিন সুযোগ হলো। সেই ঘন্টাখানেক বসে থাকার পর ৮টার দিকে আমাকে দোতালায় ডাকা হলো। উনি দরজা খুলেই বললেন, কি চাই! আমি বললাম, একটা ছবি। উনি বললেন, সময় হবে না, শুধু শুধু বাসায় এসে বসে থাকছো। আমি বললাম, স্যার সময় না থাকলে অন্তত সাদা খাতায় এক দুই টান দিয়ে একটা গাধার স্কেচ  একেঁ দিন, আমি তা-ই নিয়ে বইয়ের প্রচ্ছদ বানাবো। স্যার বললেন , কি ঝামেলা রে বাবা! এসো, ভেতরে এসো।

আমি ভেতরে গিয়ে সোফায় বসলাম। স্যার কয়েক মিনিট পর এসে আমার সামনের সোফায় বসলেন। বললেন, আমার আঁকা ছবিই কেনো তোমার লাগবে? অনেকেই তো ভালো আকেঁ! আর তুমি তরুণ, তোমাদের  পালস বুঝে এমন আর্টিস্ট কিন্তু আছে অনেকেই। আমি বললাম, স্যার অনেক ছোটোবেলা থেকেই আপনার ছবি দেখে দেখে আমি অভ্যাস্ত। আমার বইয়ের জন্য ঠিক নয়, আমার ভালো লাগা থেকেই আমি এসেছি। কিন্তু কারও বাসায় আসলে, দেখা করতে তো কারণ লাগে! বইটা হলো কারণ। স্যার হাসলেন। স্যার এর বয়স ৮০ এর ওপরে। তার মানে আমার চেয়ে আড়াইগুণ বয়সি একজন বটবৃক্ষের নিচে দাঁড়িয়ে আছি বলে আমার মনে হলো। কথা বলতে বলতেই স্যার আমার কয়েকটা কবিতা পড়লেন, তারপর নাম কবিতাটা দিয়ে যেতে বললেন।

সপ্তাহ পর মামুন ভাই আমাকে ফোন দিয়ে জানালেন, আপনার প্রচ্ছদ হয়ে গেছে, এসে নিয়ে যেতে পারেন। আমি অনেকের কাছে শুনেছি কাইয়ুম স্যার প্রচ্ছদের জন্য কমপক্ষে দশ হাজার টাকা নেন (ঠিক কিনা জানি না)। সেই অনুসারে পকেটে দশ হাজার টাকা খামে ভরে নিয়ে তার বাসায় গেলাম। শীতের সকাল। আমার ভক্তি ছিলো তাঁর প্রতি। একজন শিল্পীকে যতটুকু আমার সাধ্য আমি পারিশ্রমিক দেবো। টাকাটা কিভাবে দেবো খালি এটাই ভাবছিলাম, তিনি আবার বিব্রত বা বিরক্ত হবেন না তো! মামুন ভাই ওপর তলা থেকে ছবি নিয়ে এসে আমাকে দিলেন।  আমি বললাম, স্যার এর সাথে দেখা করা যাবে না? উনি বললেন না করলেই ভালো, উনার শরীর ভালো না। আমি খামটা মামুন ভাইয়ের হাতে দিয়ে বললাম তাহলে এটা উনাকে দিন প্লিজ। মামুন ভাই খাম নিয়ে ওপরে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই ওপর থেকে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আমাকে ডাকলেন। আমি গেলাম। কাইয়ুম স্যার আমাকে বললেন, তুমি না বললে তুমি আমার ছাত্র! টাকা নিয়ে এসেছো কেনো! এতো টাকা কোথায় পেয়েছো!। আমি কিছু না বলে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার হাতে ঊনার আঁকা ছবি। স্যার বললেন 'টাকা নিয়ে যাও তুমি। আর প্রচ্ছদের কাজ শেষ হলে একদিন এসে ছবিটাতে আমার অটোগ্রাফ নিয়ে যেও। ছবিটা হারিও না যেনো! যতদিন লেখালেখি করবে কাছে রেখে দিবে। '

কাইয়ুম স্যার এর শেষ কথাগুলো এখনো আমার মনে পড়ে। তাঁর আঁকা ছবি আমি হারাইনি। হারাবো না। ভালো থাকুন স্যার। ভালো থাকুন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী।