হামাস-ইসরায়েলি মধ্যস্থতাঃ এরপর গন্তব্য কোথায়?

মেফতাউল ইসলাম
Published : 2 Dec 2012, 06:03 AM
Updated : 2 Dec 2012, 06:03 AM

ইসরাঈল ও হামাসের মধ্যে চলমান সংঘাতের মধ্যস্থতার পর নিউইয়র্ক টাইমস এর একটি বিশ্লেষণে এই হামলাকে ইরান হামলার পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে দেখানো হয়েছে। এই প্রতিবেদনটিকে উড়িয়ে দেয়ার কোন উপায় নেই। কেননা ইসরাঈল অনেক আগ হতেই ইরানে আক্রমণের জন্য তোড়জোড় করছেন। শুধু যুক্তরাষ্ট্রের গ্রীণ সিগন্যালের অপেক্ষায় তা আটকে আছে। কিন্তু এর মধ্যে ওবামা দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি যদি কূটনীতির মাধ্যমে ইরানকে প্রতিহত করতে ব্যর্থ হন তাহলে হয়তোবা ইসরাঈলকে ইরান আগ্রাসনের অনুমতি দেবেন। আর ইসরাঈলকে ইরান আগ্রাসনের অনুমতি দেয়া মানেই যুক্তরাষ্ট্র নিজেও এই যুদ্ধে জড়িয়ে যাবেন। কেননা ইরানকে দমন করা ইসরাঈলের একার পক্ষে সম্ভব না।

ইরান যদি আক্রমিত হয় তাহলে গাজা হতে হামাস এবং লেবানন হতে হিজবুল্লাহ ইরানের পক্ষে লড়বে। ফলে ইসরাঈলকে তিন দফা হুমকি সামলাতে হবে। ইরানের সতীর্থ গাজা হতে স্বল্প পাল্লার, লেবানন হতে মাঝারি পাল্লার এবং ইরান হতে দুরপাল্লার ক্ষেপনাস্ত্র হামলার মুখোমুখি হতে হবে ইসরাঈলকে। তাই ক্ষেপনাস্ত্র হামলার হাত থেকে বাঁচার জন্য ইসরাঈল ইতোমধ্যে 'আয়রন ডোম' নামে একপ্রকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে যা আকাশেই ধ্বংস করে দেবে প্রতিপক্ষের ছোড়া ক্ষেপনাস্ত্র। হামাস কর্তৃক ইসরাঈলে নিক্ষেপিত শত শত রকেটকে অকার্যকর করে দিয়ে ইসরাঈল তার সক্ষমতা প্রমাণ করেছে। অর্থাৎ নিজের প্রতিরক্ষায় ইসরাঈল যে শক্ত-সামর্থ্য তাই প্রকাশ পেয়েছে সাম্প্রতিক সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে।

এই সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে মিসরের প্রেসিডেন্ট মুরসি তার কূটনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় তুলে ধরেছেন। সাতদিন ব্যাপী হামলার পর মুরসিই সক্ষম হয়েছেন হামাস ও ইসরাঈলকে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে রাজি করাতে। এর মাধ্যমে প্রমাণ হল হামাসের প্রতি মুরসির একধরনের প্রভাব রয়েছে এবং হামাসও মুরসির প্রতি আস্থাশীল। মুরসি যদি দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা করতে ব্যর্থ হতেন তাহলে হতাহতের পরিমাণ আরও বেড়ে যেতে পারত এবং যুদ্ধ আরও দীর্ঘস্থায়ী হত। তাই মুরসি সকলের নিকট হতে বাহবা পাচ্ছেন। এ ঘটনার মধ্যে দিয়ে তিনি আরব বিশ্ব এবং যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

আবার এই সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে হামাস প্রভাবশালী সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। কূটনৈতিকভাবেও হামাসের গুরুত্ব অনেকটা বেড়ে গেছে। আক্রান্ত হওয়ার পরপরই গাজায় ছুটে গিয়েছিলেন মিসরের প্রধানমন্ত্রী হিসাম ফানদিল। তুরস্ক, কাতার, তিউনিসিয়ার নেতারা গাজার জন্য সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন। অথচ ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস নিজের জায়গা থেকে তা অসহায়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাই ঐতিহ্যবাহী সংগঠন ফাতাহকে পেছনে ফেলে আরব দেশগুলোর নিকট আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে হামাস।

তবে এই সংঘর্ষের মাধ্যমে ইরান একটি বিষয় উপলব্ধি করতে পেরেছে যে, তার ক্ষেপনাস্ত্র ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করতে হবে তাছাড়া তা ইসরাঈলে আঘাত হানতে সক্ষম হবেনা। কেননা ধারনা করা হয় সাম্প্রতিক সংঘর্ষে হামাসকে রকেট এবং ক্ষেপনাস্ত্র সরবরাহ করেছে ইরান। আবার ইরান এটাও প্রমাণ করতে পেরেছে যে তার তৈরি ক্ষেপনাস্ত্র দিয়ে জেরুজালেম এবং তেল আবিবে আক্রমণ করা সম্ভব। সুতরাং ইরানও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে অবহিত হয়েছে এই সংষর্ষের মাধ্যমে।

তবে কেউ কেউ গাজায় আগ্রাসনকে ইরান হামলার পূর্বপ্রস্তুতি ভাবতে নারাজ। অনেকে বলছেন এই যুদ্ধের উদ্দেশ্য একাধিক। ১. যুদ্ধের উন্মোদনায় উত্তেজিত করে ইসরায়েলি ভোটারদের আরও চরমপন্থী করে তোলা, যাতে অজনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর লিকুদপার্টি আগামী জানুয়ারীর নির্বাচনে আবার জিততে পারে। ২. জাতিসংঘের অধিবেশনে ফিলিস্তিন যাতে জাতিসংঘের সদস্যপদের জন্য ভোটাভুটির দাবি না তুলতে পারে। কেননা যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এ ধরনের ভোটাভুটি কঠিন হয়ে উঠতে পারে। ৩. আরবের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সরিয়ে মৌলবাদীদের সামনে আসার উসকানি জোগানো ও তারপর মৌলবাদ দমনের নামে বিভিন্ন দেশে অবরোধ আরোপ এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে ইরানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া। ৪. স্বাধীন ফিলিস্তিনের সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে সমগ্র ফিলিস্তিনকেই নিজেদের করায়ত্ত্ব করা।

মূলত এই মুহুর্তে ইরান আগ্রাসনের পূর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অনেক হিসাব কষতে হবে। কেননা বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ বদলে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিশালী মিত্র মিসরকে তারা আর এখন তাদের পাশে পাচ্ছেনা। অথচ ইরানে স্থলপথে হামলা চালাতে হলে মিসরের সুয়েজখাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আবার আরব বসন্তের ফলে যে দেশেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে সেখানেই ইসলামপন্থীদের জয়জয়াকার অবস্থা মার্কিনীদের চিন্তিত করে তুলেছে। ইতোমধ্যে লিবিয়ায় মার্কিন কনস্যুলেট অফিসে ইসলামী চরমপন্থীদের হামলায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতসহ আরও তিনজন কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। তাই এই মুহুর্তে ইরানে হামলা চালিয়ে নতুন কোন জঞ্জাল তৈরি করতে আগ্রহী হবেন না ওবামা প্রশাসন।