মেয়ে তুমি নারী হচ্ছো

মেঘ
Published : 24 May 2016, 09:52 AM
Updated : 24 May 2016, 09:52 AM

বারো বছর বয়সটা গুরুত্বপূর্ণ। তার চাইতে মনে রাখার সময় ফেব্রুয়ারি মাস। এ সময় বইমেলা হয়। না হোক কিছু না কিছু বই কেনা যায়। কিন্তু এ কি! বইমেলা থেকে ফিরে হাফ প্যান্টে কেন খয়েরী খয়েরী দাগ! তবে কি আম্মু আরো একবছর আগে যা বলেছে তা শুরু হয়ে গেল! সারারাত আল্লাহর কাছে দোয়া করলাম এ জিনিস যেন আমার না হয়। কেউ দোয়া শুনলো না। যা হবার তাই হলো। মিনসট্রেশন শুরু হয়ে গেল। মায়ের পুরানো শাড়ির টুকরো পেলাম। সাথে তিনটা ফিতা। সাথে প্যান্টি। বৃষ্টির দিনে সে কাপড় আর শুকায় না। সবার চোখের আড়ালে সে কাপড় শুকানো এক দায়। স্কুলের ড্রেস ধবধবে সাদা। আমরা সবাই জামা উঠিয়ে বেঞ্চে বসি। একজন আরেকজনের পেছন চেক করে দেই যতবার উঠে দাঁড়াই হাঁটার জন্য ততোবার। ডিশ মাত্র এসেছে। মাঝে মাঝে জি-টিভি তে হুইসপারের অ্যাড দেখি আর ভাবি এগুলো কোথায় কিনতে পাওয়া যায়!

বেশি ফ্লো এর সময় তো মাথায় বাজ। ঐ কাপড়ের উপর তুলো দিয়ে রাবার ব্যান্ড দিয়ে আটকাতে হয় যেন তুলো এদিক সেদিক সরে না যায়। এগুলো লজ্জার কথা, কাউকে বলা যায় না। বান্ধবীরা এ বিশেষ দিনগুলোতে মুন্ডুপাত করি নারী জনমের। স্কুলের বাথরুমে যাবার কোন উপায় নেই। ভোর ৬.১৫ তে স্কুলের উদ্দেশ্যে রওনা হই, ফিরি বৃত্তির কোচিং করে সাড়ে চারটায় তাও পাবলিক বাসে। মাসের সাতদিন জীবন ফানাফানা। কোন মাসে পিরিয়ড মিস হলে আমরা বান্ধবীরা যারপরনাই খুশি।

বান্ধবীদের জিজ্ঞেস করি ওরা কী ইউজ করে। একই কথা কাপড়। একটা পুরানো টিনের ভেতর প্রয়োজন শেষ হলে কাপড়গুলো ধুয়ে শুকিয়ে বন্ধ করে রাখি পরবর্তী মাসের জন্য। স্কুল জীবনটা মাঝেই মাঝেই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যায় এই এক শারীরিক পরিবর্তনে।

এর ভেতর দেড়মাস একবার পিরিয়ড চলতেই থাকলো, এখন বুঝি আসলে ইনফেকশন হয়েছিলো। মা বাবা দুজন মিলে হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। বাসায় দুই ভাই বাবা চাচা। খুব কাছের বন্ধু হলো ছেলে। সে এক দ্বিধাগ্রস্ত লজ্জাজনক অবস্থা। খেলতে খেলতে কখন কাপড় কোথায় সরে যায়, কখন প্যান্টে দাগ লেগে যায়।

খুব বই পড়তাম, ম্যাগাজিন পড়তাম-দেখি শী নামক স্যানিটারি প্যাড এর বিজ্ঞাপন। কিভাবে কিনব জানি না। এর এর ভেতর আম্মু আব্বু দেশের বাইরে। বাসায় কটন বা তুলো শেষ। কলেজে সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা। আমি বান্ধবীকে বলি আমাকে কটন কিনে দিতে। সে বলে তার বিবাহিত কাজিনকে। তারা আমাকে কটন কিনে দেয় না। বুক ঠুকে চলে গেলাম বাসার কাছের আলী মেডিক্যাল হলে। মামা আমাকে বললো তাদের সেখানে শী নেই। আছে সেনোরা বেল্ট। কিনলাম। দশটার প্যাকেট পঞ্চাশ টাকা। সাল ১৯৯৫। আমার জীবন একটু বদলালো। কী যে কমফোর্ট! সেই কাপড়ের পুটুলি দুই উরুর মাঝে চেপে থাকার চাইতে অনেক আরাম।

এখনো ভাবি চারটা বছর কি অমানবিক কষ্ট শুধু তথ্যের অভাবে করেছি। আমাদের মা খালারা এভাবেই জীবন পার করে দিয়েছে।

খুব মনোযোগ দিয়ে এখনো সব স্যানিটারি প্যাডের গায়ে লিখা দাম দেখি- ফ্রিডম ষোলোটার প্যাকেট ২২০ টাকা, সেনোরা দশটার প্যাকেট ১০০ টাকা, প্যান্টি সিস্টেম, আর দীর্ঘশ্বাস ফেলি হাজার হাজার লাখ লাখ কিশোরী নারী এই কাপড় পরে মাসের বিশেষ দিনগুলো পার করছে, কেউ হয়তো স্কুলে যাচ্ছে না, কেউ কাজে যাচ্ছে না। কেউ পেছনে দাগ লেগে গেছে তাই শাড়ীর আঁচল বা ওড়না দিয়ে ঢেকে দ্রুত বাড়ির দরজায় ছুটছে।

বিশ টাকায় যদি দশটা স্যানিটারি প্যাডের প্যাকেট  পৌঁছে দেয়া যেত এসব কিশোরী নারীদের। প্রজনন স্বাস্থ্য বলতে নারীদের কিছু কি রক্ষা হয়!

ডাক্তার নই জানি না স্যানিটারী প্যাডে কি উপাদান ব্যবহার হয়, ব্যবসা বাড়াতে রক্তপাত বেশি করার কোন উপাদান ব্যবহার হয় কি না, যা পরবর্তীতে জরায়ু ক্যান্সারের কারণ হয়। ভাবি ভাবতে ভাবতে আবার ভুলে যাই। সেই ক্লাস এইটে পড়া মেয়েটার কথা মনে পড়ে যে ভোর ছটা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত একটা কাপড়ের তুলোর পুটুলি দুই উরুর মাঝে নিয়ে নারী জনমকে অভিশাপ দিতো অবিরাম…