মেঘকে নিয়ে স্কুলে যাচ্ছি সেদিন। বাপ-বেটা মিলে গল্প করতে করতে প্রতিদিন বাহাদুরশাহ পার্কের সামনে দিয়ে হেটে হেটে স্কুলে যাই— নানা কিছু দেখি, ভালো-মন্দ নানা বিষয়। মেঘ প্রশ্ন করে, আমি তার যথা সম্ভব উত্তর দেই। সমাজ, সংসারের বিষয়গুলো বোঝাতে চেষ্টা করি। সে একের পর এক প্রশ্ন করে যায়।
তো সেদিন— একটা গাছের উপর আমাদের দুজনের দৃষ্টিগোচর হলো। মেঘ আমাকে প্রশ্ন করে, বাবা ঐ গাছটা দেখেছ? আমি বললাম দেখেছি। সে আমাকে বলল, এটা কি বট গাছ? আমি উত্তরে বললাম, জ্বী এটা বট গাছ। মেঘ বট গাছটির নিচে দিয়ে যেতে যেতে বলে, বাবা বট গাছের উপর দেখো একটা দোলনা ঝুলানো। এটা এখানে ঝুলিয়ে রেখেছে কেন? আমি বললাম, দেখেছি। তবে কেন ঝুলিয়ে রেখেছে, তা আমি জানি না। আমরা এলাকাটি ক্রস করে মেঘের স্কুলে চলে গেলাম।
আমি বাসার ফেরার পথে, সেই গাছটির দিকে আর একবার তাকালাম। দোলনাটি তখনো ঝুলছে। আমি দেখলাম খুব কায়দা করে দোলনাটিকে এখানে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। দোলনাটির বাঁধন খুব শক্ত। সহজে সেখান থেকে পড়বে না। জানার আগ্রহটা বেড়ে গেল। বিশাল আকৃতির বটগাছ, দোলনা!
পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক এলাকায় দুই পথ শিশু, গাছের উপর বসে মাদক সেবনে ব্যস্ত, ৩ মে, ২০১৭ | ছবি: মনিরুল আলম।
নোট: ছেলেটির পরিচয় এড়াতে ফটোশপের সাহায্য নেওয়া হয়েছে।
মেঘের স্কুল ছুটি শেষে বাসায় ফিরছি, বাপ-বেটা মিলে। হঠাৎ মেঘ বলে, বাবা দেখ ঐ বট গাছটার উপর দোলনাটিতে দুইজন ছেলে বসে আছে। ওরা যেন সেখানে বসে কি করছে, ওরা যেন কি খাচ্ছে? আমি তাকালাম। দেখলাম, দুইজন পথ শিশু সেখানে বসে আড্ডা মারছে। আর মাদক সেবন করছে। সকলের ধরা ছোয়ার বাইরে, গাছের উপর, অথচ সবার সামনে। অনেকটা নিরাপদে চলছে, তাদের এই মাদক সেবন। দোলনাটিতে কায়দা করে বসে অনেকটা আড়াল করে, তারা বেশ আগ্রহ নিয়ে, পলিথিনে মোড়ানো 'ড্যান্ডি' নামক এই মাদক নিচ্ছে। সড়কের উপর দাড়িয়ে সঙ্গে থাকা মোবাইলটি দিয়ে বেশ কয়েকটা ছবি তুললাম, ভিডিও করলাম, কিন্তু নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা সেই শিশুরা আমার দিকে ফিরেও তাকালো না। যতটুকু জানি ড্যান্ডি একধরনের আঠা, যা মূলত জুতার সলিউশন নামে পরিচিত। এতে টলুইন নামে একটি উপাদান আছে। টলুইন মাদকদ্রব্যের তালিকায় আছে। সহজলভ্য এই মাদক, এসব পথ শিশুদের কাছে বেশ জনপ্রিয়।
বটগাছটির একটু সামনে একটি ট্রাক দাড়িয়ে। ন্যায্য মূল্যের চাল, ডাল, চিনি, তেল বিক্রির ট্রাকটি থেকে কেউ কেউ তাদের প্রযোজনীয় জিনিস ক্রয় করছেন, বেশিরভাগ ক্রেতা নিম্নবিত্তের- রিকশাওয়ালা, ফুটপাতের রিকশা মিস্ত্রী, চা বিক্রেতা, বোরকা পরা কিছু নারী সহ নানা চরিত্রের মানুষ।
গাছটির অপর দিকে পার্ক ঘেঁষে লাগানো ফুটপাত। সেই ফুটপাতের উপর বেঞ্চটিতে বসে হাতিয়ার সহ বেশ কয়েক জন পুলিশ কর্তব্যরত। তাদের কেউ কেউ মোবাইল ফোনে কথা বলছেন, কেউ সিগারেট ফুঁকছেন। সড়কটির উপর বিক্ষিপ্ত ভাবে দাড়িয়ে আছে বাস। হেলপার একটু পরপর চিৎকার করে যাচ্ছেন। সময় সময় যানজট লেগে যাচ্ছে সড়কটির উপরে। কলেজ- বিশ্ববিদ্যালেয়ের শিক্ষার্থীরা পার্ক এ বসে আড্ডা মারছে সহপাঠিদের সাথে।
সবকিছু ঠিকঠাক চলছে এখানে। কোথাও কোন সমস্যা নেই। লেনদেন, হিসাব নিকাশ সব ঠিক মতো চলছে। ফুটপাতের এইসব শিশুরা কোথায় কি করছে, ওরা গাছের উপর বসে নেশা করছে, নাকি কাগজ টোকাচ্ছে। নাকি ফুটপাতের উপর এই দিনের বেলা অঘোরে ঘুমাচ্ছে, নাকি ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করছে তাতে কারো কিচ্ছু যায় আসে না।
অথচ আমাদের রয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। রয়েছে বেশ কিছু সরকারি-বেসরকারি মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র।
এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, দেশে মাদকাসক্ত পথশিশুর সংখ্যা সাড়ে পাঁচ লাখ। এতো সব সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থা থাকার পরও যে বিষয়টা নেই তা হলো আন্তরিকতা। রাষ্ট্র, প্রশাসন এবং জনগন একটু আন্তরিক হলে, সচেতন হলে নষ্ট হয়ে যাওয়া এই সব শিশুদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা সম্ভব, অন্তত চেষ্টা করা যেতে পারে। কিন্তু কে নিবে সেই উদ্যোগ? রাষ্ট্র তো কিছু ব্যবস্থাপত্র দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে, সেই ব্যবস্থাপত্র সঠিক ভাবে কাছে লাগছে কিনা, সেটা কাজ করছে কিনা সেটা তদারকি করার দায়িত্ব কার?
রাষ্ট্র ব্যবস্থা সঠিক ভাবে কাজ করলে, তদারকি হলে নিশ্চয়ই ছোট শিশুকে নিয়ে স্কুলে যেতে যেতে দেখতে হবে না এরকম দৃশ্য। কিংবা ছোট শিশুটি তার বাবার হাত ধরে স্কুলে যেতে যেতে বলবে না, বাবা, ওরা গাছের উপর বসে ঐ সব কি খায়?