খেয়া নৌকার মাঝিদের ইফতার

মনিরুল আলম
Published : 22 June 2017, 09:02 AM
Updated : 22 June 2017, 09:02 AM

মৌসুিম বায়ু সক্রিয় হবার পর থেকে সারা দেশই ধুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ইফতার কিনতে যাবো এর মধ্যে হঠাৎ করে ঝম-ঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম— বৃষ্টিটা একটু কমলে তারপর ইফতারি কিনতে বের হবো!

এসব ভাবতে ভাবতেই মনে পরে গেল সে দিনের কথা। আচ্ছা এই বৃষ্টির মধ্যে বুড়িগঙ্গা নদীর খেয়া নৌকার মাঝিরা তাহলে কিভাবে ইফতার করবে? ওরা কি নৌকায় ছাতি মাথায় দিয়ে ইফতার করবে নাকি ঘাটের কোন এক জায়গায় আশ্রয় নিবে ইফতার করার জন্য। সেদিন তো নৌকায় বসে ইফতার করতে করতেই নানা সুখ-দুঃখের কথা হলো ওদের সাথে।

সারাদিন হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম করেও কেউ কেউ রোজা রাখেন। কিন্তু সেটা ওদের জন্য খুব কষ্টের হয়ে উঠে। ইউনুস মাঝি বলেন, কেউ রোজা রাখুক বা না রাখুক ইফতারের সময় আযান দিলে, এই নদীর উপরেই আমরা ইফতার করি। তখন ঘাটে নৌ চলাচল কমে যায়, পারাপার যাত্রীরা থাকেনা। আমরাও ক'জন মিলে, ছোলা-মুড়ি আর পেয়াজু দিয়ে ইফতার করি। কেউ কেউ আবার মসজিদে যায় ইফতার করতে।

শ্যালো নৌকা আর লঞ্চ চলাচলের শব্দ। সেই সাথে ভরা বর্ষার পানিতে ছোট ছোট ঢেউয়ে আমাদের নৌকাটি দুলতে থাকে। ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা না থাকলেও মনে মনে একটু ভয় হয়। ইউনুস মাঝি হাসতে হাসতে বলে, ভয় পাইয়েন না নৌকা শক্ত করে বাধা আছে, ডোবার কোন সম্ভাবনা নাই। আমি বলি ঠিক আছে। আপনার আয়-রোজগার সর্ম্পকে কিছু বলেন।

নৌকা ভাড়া আর ঘাটের ভাড়া বাদ দিয়ে প্রতিদিন ২০০-৩০০ টাকা থাকে। নৌকা ভাড়া ৪৫ টাকা দিতে হয় আর রাতে পাহারাদারকে দিতে হয় ৫ টাকা, ঘাট ভাড়া ৫০ টাকা। সারাদিন-রাতই এই ঘাটে নৌকা চলাচল করে।  পরিশ্রম বেশী করলে বেশী টাকা পাওয়া যায়। তবে এই কাজে অনেক খাটুনি; বেশী পরিশ্রম করা যায় না, শরীরে কুলায় না।

পশ্চিম আকাশে তখন সূর্য হেলে পড়েছে। খন্ড খন্ড মেঘে রঙ ছড়াতে শুরু করেছে। বুড়িগঙ্গা নদীর পানিতে তখন অন্য রকম প্রতিফলন দেখা যায়। যাত্রীদের পারাপার দেখতে দেখতে দূর আকাশের দিকে চোখ চলে যায়। মেঘের দল যাত্রা শুরু করেছে দূরে, বহু দূরে! এসব দেখতে দেখতেই পাশের মসজিদ থেকে আযানের ধ্বনি ভেসে আসে। ততক্ষনে ইউসুফ মাঝি ও তার সঙ্গী সাথীরা ইফতার নিয়ে বসে গেছে। নৌকার উপর একটা গামছা বিছিয়ে তাতে কিছু মুড়ি, পেয়াজু আর ছোলা একসাথে মাখিয়ে খেতে শুরু করেছে। আমিও তাদের সাথে ইফতারে শরিক হলাম।

বুডিগঙ্গা নদীতে নৌকার উপর বসে মাঝিদের ইফতার খাওয়া চলছে। (ছবি: মনিরুল আলম)

.

বুড়িগঙ্গা নদীর এপারে ওয়াজঘাট আর ওপারে কালীগঞ্জ। প্রতিদিন এই ঘাট দিয়ে শত শত যাত্রী পারাপার হয়। ইউসুফ মাঝিকে প্রশ্ন করি, আনুমানিক প্রতিদিন কত লোক পারাপার হয় এই ঘাট দিয়ে? ইউসুফ মাঝি আমতা আমতা করতে থাকেন।  তার পাশে বসা লতিফ মাঝি বলেন, তা ধরেন বিশ হাজার তো হইবই— আমাগো এই ঘাটে সারাদিন-রাইতে প্রায় ৩০০ নৌকা চলাচল করে। বড় নৌকাগুলাতে সাত-আট জন করে যাত্রী উঠে। আর ছোট গুলাতে (রিজার্ভ) এক দুই জন করে পারাপার হয়। লতিফ মাঝির কথায় সায় দেয়, ইফতার করতে বসা জামাল মাঝি।

চটজলদি ইফতার সেরে নৌকার মাঝিরা নামায আদায় করতে শুরু করে, উপস্থিত মাঝিরা নৌকার উপর চার জনের একটা ছোট জামাত দাঁড়িয়ে যায়, আর ততক্ষণে আমার ক্যামেরা ক্লিক হতে থাকে সেই মুহূর্তটি ধরে রাখার জন্য। খেয়া ঘাটটিতে পারাপারের জন্য যাত্রীদের ভিড় বাড়তে থাকে। এর মধ্যেই কোন এক মাঝিরে কন্ঠে ডাক শুনতে পাই, ঐ রিজার্ভ আহেন, এই দিকে। ঈদের কেনা-কাটা তাই সবার ব্যস্ততা যেন একটু অন্যরকম।

লঞ্চ টারমিনালের ঝলমলে আলো নদীর পানিতে প্রতিফলিত হয়ে এক অদ্ভুত আবহ সৃষ্টি হয়। ইউসুফ মাঝি সেই পানি কেটে কেটে আমাদের নিয়ে চলে ঘাটের দিকে।

লেখক : সাংবাদিক ও আলোকচিত্রী