হরতালের অনিন্দ্য কান্তি মুখাবয়ব

মেহেদী হাসান
Published : 19 Dec 2012, 05:17 AM
Updated : 19 Dec 2012, 05:17 AM

বিভিন্ন কারনে অনেক ভাবে আমাদের পরিচিত-অপরিচিত শব্দগুলোর অন্তর্গত অর্থ পরিবর্তিত হয়ে যায়। শব্দের মূলগত অর্থের রুপান্তর সাধিত হয়- সাধারনত যখন ধীরে ধীরে ঐ মূল অর্থের কাছাকাছি কোন কাজ ঐ শব্দের আড়ালে সংঘটিত হতে থাকে এবং ক্রমান্বয়ে আরো দূরে সরে যায়। এবং প্রজন্ম হতে প্রজন্ম- শম্বুক গতিতে এই পরিবর্তনটি ঘটতে থাকে। এবং একসময় আমরা ভুলে যায় ঐ শব্দটির মূলগত অর্থ। তা নিয়ে অবশ্য কারো কোন ধরনের খেদ নেই বা থাকতে পারেনা। এটা প্রত্যেকটা ভাষার সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এভাবে আমাদের ভাষায়ও অনেক সচল এবং অচল শব্দ নতুন নতুন অর্থ নিয়ে আমাদের হাজির হয়েছে। পেছনে পড়ে যাওয়া অচল শব্দগুলো নতুন প্রান পেয়ে আবার সামনের কাতারে চলে আসতে থাকে। ভাষার নিজস্বগতিতে এগিয়ে চলার অবিরাম প্রক্রিয়ার একটি শক্তিশালী অংশ হিসেবেও একে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু দুঃখ হয় যখন দেখি কোন শব্দের মূলগত অর্থ বিকৃত হয়ে যায় বা অতিমাত্রায় নেগেটিভ অর্থে পরিবর্তিত হয়। তেমন একটি শব্দ হচ্ছে এই হরতাল। এই হরতাল শব্দটি আর পূর্বের অর্থে নেই-প্রায়ই অনেকটাই বিকৃত হয়ে গেছে। হরতাল হচ্ছে জনগনের রাজনৈতিক দাবী আদায়ের একটি হাতিয়ার-হরতাল ঘোষিত দিনে গাড়ি চাকা ঘুরবেনা এবং সকল ধরনের অফিস-আদালত, কলকারখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং দোকান পাট বন্ধ থাকবে। এবং জনগন স্বতস্ফুর্তভাবে হরতাল পালন করবে- তার নিজস্ব দাবী দাওয়া দৃঢ় হাতে আদায় করার জন্য। পরিবহন শ্রমিকরা ওই দিন নিজেরাই গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বের হবেনা, জনগনও রাস্তায় এসে গাড়িতে উঠে বসবেনা অফিস-আদালতে যাওয়ার জন্যে। ছাত্র-ছাত্রীরাও কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া থেকে বিরত থেকে ঐ দাবী-দাওয়া গুলো রাস্তায় ঘুরে ঘুরে প্রচার করে জাতির বিবেকের দায়িত্বটি পালন করবে। হরতালের মূলগত অর্থ নিয়ে আমার এই আলোচনা হয়তো অনেকেরই মনে খটকা লাগাবে। হয়তো মনে মনে বা জনসম্মুখেই বলতে থাকবে উনি আবার কেমনতরো কথা বলা শুরু করলেন! এরকম করে আর হরতাল হয় নাকি, আমাদের মধ্যে কেউ দেখেছে এমনতরো হরতাল।

হরতাল কি আর এভাবে হয় নাকি! হরতাল মানে তো রাস্তায় গাড়ি পোড়ানো, ভাঙ্গচুর, পুলিশের সাথে ধাওয়া-পালটা ধাওয়া, ইট-পাটকেল নিক্ষেপ, আগুন ধরে যাওয়া পরিবহন বাসে সাধারন যাত্রীদের পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া, ঘরের ভেতরে আমেজ করে বসে রঙ্গীন টেলিভিষনের পর্দায় ভাবলেশহীন সংবাদ পাঠিকার মুখে শোনা এবং সরাসরি ভিডিও চিত্রে দেখা- চোখে, মুখে, সারা শরীরে রক্তাক্ত অবস্থায় কিছু মানুষের উদ্ভ্রান্ত ঘুরে বেড়ানো এবং অনেক মায়ের কোল খালি করে সদর রাস্তায় নির্দিদ্ধায় ঘুমিয়ে পড়া কিছু গাঢ় লাল রঙের লাশ। এবং তার পরের দিন সংবাদ পত্রের হেডলাইন দেখে- গাড়ি পোড়ানো এবং আহত-নিহত মানুষের সঠিক তত্ত্বতালাশ নিয়ে রাস্তা-ঘাটে অফিস-আদালতে ব্যপক আড্ডার আমাজে মজে যাওয়া।

হরতাল শব্দটির অবিকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার জন্যে বামপন্থীরা অনেকদিন যাবত চেষ্টা চালিয়ে আসছে। হরতালের মত একটি জনগনের দাবী আদায়ের হাতিয়ারকে তারা নষ্ট হতে দিতে চায়নি। অনেকদিন যাবত তারা আপ্রান চেষ্টা করে আসছে। এর মধ্যে তারা বিভিন্ন সময় কিছুটা সফলও হয়েছে। কিন্তু পূর্নাঙ্গ সফলতা এর পূর্বে আসেনি যেমন এসেছে গত ১৮ ডিসেম্বরের ডাকা হরতালে। এই হরতালের দাবীগুলোও ছিল একেবারে জনগনের প্রানের দাবী। অনেক দিন যাবত অত্যাচারিত, নিপীড়িত, শোষিত হতে হতে তাদের মধ্যে যে ক্ষোভের বারুদ জমা হচ্ছিল সেগুলোর মধ্যে আগুন জ্বালানোর আহব্বান ছিলো বামপন্থীর আহুত এই হরতালে। জনগন বধির হয়ে বসে থাকেনি। তারা সাড়া দিয়েছে, তাদের বুকের ভেতরে পুঞ্জিত ক্ষোভের বারুদ আগুনের একটু ছোঁয়াচ পেয়েই দাউদাউ দাবানলের মতই জ্বলে উঠেছে।

আর পুলিশ-পুলিশতো শুধু পুলিশ নয় ওরাও এই দেশেরই জনগন, মা-বাবা, বৌ, স্বামী, সন্তান-সন্তনি নিয়ে এই দেশেই বসবাস করে এবং এদেশেরই জল, মাটি, হাওয়ায় বেড়ে উঠেছে- এই কথাটি মাঝে মাঝে আমরা অনেকেই ভুলে যাই। ঐ মোটা খসখসে খাকি ইউনিফর্মের আড়ালে তাদেরও বুক আছে, হৃদয় আছে, ক্ষোভ আছে, তাদেরও তোলপাড় করে, আছে দাবী-দাওয়া। তারা সমাজের শোষক শ্রেনীর কেউতো নয়- বরঞ্চ ওরা কৃষক, শ্রমিক, মজু্র, শোষিতের সন্তান এবং নিজেরাও অনেক বেশী শোষিত। নিতান্ত পেটের দায়ে দাসত্বের পোশাক গায়ে চেপেছে বলে আত্মাটাকে তো আর বিক্রি করে দেয়নি বা কারো কাছে বন্ধকও রাখেনি। পুলিশ লাইনে এই পুলিশদের জীবন-যাপনের করুন চিত্র আমি নিজের চোখে দেখেছি। ওদের সাথে তিনবেলা খেয়ে, কয়েক রাত্রি ঘুমিয়ে ওদের বেদনার কিঞ্চিত পরিমান হলেও অনুভব করতে পেরেছি। ওদের সাথে কথা বলে জেনেছি ওরাও আন্দোলন করে, মাঝে মাঝে অনেক বেশী ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়ে পুলিশ লাইনে ভাংচুরও চালায়। কিন্তু তাদের সেই আন্দোলন দূর্ভেদ্য দেয়ালের অন্তরালে গুমরে মরে। মিডিয়ার সুতীক্ষ্ণ লেন্সও সেখানে প্রবেশ করতে পারেনা। চিরদিনের মতো থেকে যায় আমাদের দৃষ্টি সীমানার বাইরে। হৃদয়ে খামচে ধরা অনেকবেশী জ্বলুনিতে তারা যদি পুঁজিবাদী-লুটেরা ধনিক গোষ্ঠীর রাষ্ট্রের দাসত্বের শৃঙ্খল রাজপথে ছুড়ে ফেলে দেয় তাহলে তো অবাক হওয়ার কিছু নেই। বরঞ্চ এটাই তো অনেকবেশী স্বাভাবিক-এরকমটাই হওয়া উচিত।

পরিবহন শ্রমিকরা নিজ থেকে গাড়ী চালানো বন্ধ রেখেছে, মধ্যবিত্ত জনগন রাস্তায় বের হয়ে অফিস-আদালতের উদ্দেশ্য গাড়ীতে উঠে বসেনি, নিম্ন মধ্যবিত্ত জনগন আজকের বাজারে যাদের অবস্থা দিন আনে দিন খাওয়ার মত তারাও তাদের ছোটখাট দোকানপাট বন্ধ রেখেছে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ঢোল-তবলা নিয়ে সার বেঁধে গনসঙ্গীত গাইতে গাইতে রাস্তায় নেমে এসেছে। হরতালের যৌক্তিক দাবী-দাওয়া এবং দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সমন্ধে জনগনকে সচেতন করে তুলছে। এইতো হরতাল-হরতালের অন্তর্গত অর্থই তো ঐ! বামপন্থীদের অনেকদিনে কর্মপ্রচেষ্টায় হরতাল আবার তার নিজস্ব স্বরূপ ফিরে পায়েছে। হরতালের বীভৎস, বিকৃত, দগদগে ঘা ওয়ালা পোড়া মুখ নিয়ে ফিরে গেছে। আমরা আর ঐ বীভৎসতা চোখের সামনে দেখতে চাই না। ঐ পথ থেকে আমরা ফিরে এসেছি-শ্বাপদ-সঙ্কুল ভরপুর ঘিন ঘিনে নোংরা তৈলাক্ত রাস্তায় আর আমরা পা বাড়াতে চাইনা।

আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যেন বলতে পারে এই আঠারো ডিসেম্বর তারিখে প্রগতিশীলরা হরতালকে শ্বাপদের হাত থেকে রক্ষা করেছিল তারপরে আর কোন দিন জনগনের অধিকার আদায়ের অন্যতম হাতিয়ার তার অনিন্দ্যকান্তি মুখ নিয়ে ধারালো দাঁত-নখের লোমশ মানব জন্তুদের আস্তানায় ফিরে যায় নাই। এই দায়িত্ব এখন আমাদের সবার-সকল শ্রেনী-পেশার জনগনের।