রাসূল (সা.) এর শান্তি স্থাপনের শিক্ষা ও আমাদের কর্তব্য

মেহেদী হাসান
Published : 14 Dec 2016, 04:40 AM
Updated : 14 Dec 2016, 04:40 AM

ইসলাম একটি আধুনিক ধর্ম যার বয়স ১৫০০ বছর প্রায়। যুগে যুগে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নবীদের উপর আল্লাহ রব্বুল ইজ্জাত বিভিন্ন দায়িত্ব ও শরীয়ত প্রদান করেছেন শুধুই নিয়ম-নীতি প্রচলনের জন্য নয় বরং মানবতার কল্যাণে শান্তি স্থাপনের জন্য। এক এক শরীয়ত হল এক এক অঞ্চলের জন্য, এক এক বিধান হল এক এক স্থান কাল পাত্র ভেদে মানবের জন্য। কিন্তু নবী মহাম্মদ (দ:) হলেন বিশ্ব নবী, যিনি সকল বিশ্বের জন্য রহমত স্বরূপ। তার আদর্শ কোন নতুন আদর্শ নয়, আর সকল নবীর শরীয়তের মতই তার আদর্শ। কিন্তু তিনি পেয়েছেন চূড়ান্ত ফয়সালা মহান রব্বুল আলামীনের তরফ থেকে যা অনন্তকালের জন্য শ্রেষ্ঠ বিধান। আর সেটি হল কুরআনুল করীম।

সর্বযুগের সকল নবীর সঙ্গে তিনি নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করতে নিষেধ করেছেন, তিনি বলেছেন সকল নবীরাই সমান মর্যাদার, কেউ কারো থেকে উন্নত নয়। কিন্তু নবী মহাম্মাদ (সা.) শেষ নবী হিসেবে একটি অবস্থানে মাত্র, আর তা হল তার আদর্শ, তার প্রতি নাজিল কিতাব ও তার ধর্ম ইসলাম হল আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে চূড়ান্ত ফয়সালা। হযরত মুহাম্মাদ (সা.) আর সকল নবী ও মহান পুরুষদের মতই নিষ্পাপ। তিনি যা আদর্শ স্থাপন করেছেন তার দু'একটি দিকে নজর না দিলে লিখা অধুরা হয়ে থাকবে।

নবী মহাম্মাদ শুধু যে একজন পন্ডিত হিসেবে, বড় ব্যক্তি হিসেবে বুজুর্গ হিসেবে বা সন্যাসী হিসেবে ঘরে বসে ছিলেন তা কিন্তু নয়, তিনি সমাজের সকল স্তরের সাথে মিশেছেন, সবার দ্বারে দ্বারে গিয়েছেন সত্য ও ন্যায়ের কথা বলে দাওয়াত দিয়েছেন সত্যকে ও শান্তিকে আঁকড়ে ধরার জন্য। আর এজন্য তিনি নির্যাতিত হয়েছেন বহুবার। মানুষের বিপদে এগিয়ে গেছেন, সমাজ থেকে অন্ধকারকে দূরীভূত করেছেন। তিনি ৪০ বছর বয়সে নবুয়ত্ব পেলেও তার জীবনে ছোট বেলা থেকেই তিনি মানুষের হিত সাধনে ছিলেন বদ্ধ পরিকর।

তিনি সমাজের হানাহানি দূর করতে যুব সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন, যাতে গোত্রে গোত্রে দাঙ্গা হাঙ্গামা না বাঁধে। এজন্য তিনি সকল গোত্রের যুবকদের নিয়ে তৈরি করেছিলেন হিলফুল ফুজুল বা শান্তি সংঘ। গোত্রে গোত্রে মারামারি ও যুদ্ধবিগ্রহ থামাতে এটি সচেষ্ট হয়। কিন্তু, বর্তমান মুসলিমরা কি সেই আদর্শ লালন করছে? দেশে দেশে আজ কিছু মুসলিমদের কারণে সমস্ত মুসলিম জাতির দুর্নাম হয়ে যাচ্ছে। আজ ইসলাম ধর্মের মত এতবড় আলিশান ধর্ম কিনা কলঙ্কিত!

অপরদিকে, নবী মহাম্মদ (সা) শুধু যে মানবের জন্যই রহমত স্বরূপ ছিলন তা না। তিনি সকল জীবের প্রতি দয়ালু ছিলেন। তার কয়েকটি উদাহরণ দেখি-

হযরত মহাম্মাদ (সা.) মক্কা বিজয়ের জন্য সৈন্য সামন্ত নিয়ে মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। পথের মধ্যে দেখলেন একটি কুকুর পাহাড়ের পাদদেশে বাচ্চা প্রসব করেছে কিন্তু কুকুরটির শরীরে কিছুই না। কুকুরটি পিপাসার্ত ও ক্ষুধায় কাতর দেখে রসূল (সা) তার যাত্রা থামালেন, একজন সৈনিককে দায়িত্ব দিলেন এই কুকুরের সেবা করার জন্য। তিনি বললেন আমরা মক্কা বিজয় করে ফিরে না আসা পর্যন্ত তোমার দায়িত্ব হল এই কুকুরের হেফাজত করা, তার খাবার পানির ব্যবস্থা করা। তুমি বিনিময় জিহাদের সওয়াব পাবে। আলহামদুলিল্লাহ ……….

জিহাদ মানে যে শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মস্তক ছেদনই শুধু নয় বরং একটি নিরীহ কুকুরের সেবাতেও জিহাদের মর্যাদা অর্জন সম্ভব এমন নির্দেশনা কি বর্তমান জিহাদি মুসলীমরা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে? একটি পাখি নিয়ে একজন সাহাবী রসূল (সা.) কাছে এসেছিলেন, রসূল সেই সাহবীকে নির্দেশ দিলেন পাখির ছানাকে তাদের মায়ের বাসায় ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু, বর্তমান মুসলিম নামের নামধারী সন্ত্রাসীদের কাছে কি পশু পাখি তো দূরের কথা মানুষেরও ঘরে ফেরা নিরাপদ?

একজন সাহাবী বিড়ালকে খুব ভালবাসতেন, রাসূল (সা.) খুশি হয়ে সেই সাহাবীর নাম দিলেন বিড়ালের পিতা যিনি বিশাল হাদিস বিশারদ কিন্তু পরিচিতি হয়েছে রসূলের দেয়া নামে আবু হুরাইরা বা বিড়ালের পিতা হিসেবে। এটা কি পশু প্রেমের নিদর্শন নয়? অথচ আমরা মুসলিমরা ক' বেলা পশুর সেবা করি, মানবের সেবা তো করিইনা!

একজন পতিতা নারী পিপাসার্ত কুকুরকে কূপ থেকে পানি তুলে পান করিয়েছে শুনে রসূল (সা.) বললেন ঐ নারীর জন্য জান্নাতের ফয়সালা হয়ে গেছে, তার সকল গুনাহ মাফ হয়েছে। অথচ নারীটি মুসলিম ছিলনা, কারণ মুসলিম হলে পতিতাবৃত্তি করতো না। কিন্তু আমরা অন্য ধর্মের মানষকে বলি সে মালাউন সে জাহান্নামী! এমনকি সে যত সৎ ও ন্যায়পরায়ণ হোক না কেন তাকে গালি দিতে দ্বিধাবোধ করিনা। এটা কি মুসলিমদের স্বভাব হওয়া উচিৎ?

রসূল (সা.) দাস মুক্তিকে উৎসাহ যুগিয়েছেন, তিনি বলেছেন দানের উৎকৃষ্ট পর্যায় হল একজন গোলামকে মুক্ত করে দেয়া।
তিনি নারীদের মর্যাদা প্রদান করেছেন, আরবে নারীদের কোন মর্যাদা ছিলনা, শুধুই ভোগ্যপণ্য ভাবা হত, কিন্তু রাসূল বলেছেন নারী ও পুরুষ উভয়েই সমভাবে একজন মানুষ। এমনকি পিতার সম্পত্তিতে অধিকার দিয়েছেন নারীদের সাথে সাথে স্বামীর সম্পত্তিতে অধিকার দিয়েছেন। কিন্তু একজন পুরুষের সম্পত্তির অধিকার শুধু পিতার অংশে। শিক্ষার অধিকার দেয়া হয়েছে, এমনকি বলা হয়েছে প্রতিটি নর ও নারীর জন্য শিক্ষা অর্জন করা ফরজ। কন্যা শিশুর ভ্রূণ আজ ধ্বংস করা হচ্ছে। এই প্রচলন ছিল আরব জুড়েই। সে সময়ে ভূমিষ্ঠ শিশু কন্যা সন্তান হলে হত্যা করা হত, কিন্তু রসূল (সা) কন্যা সন্তান হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন সাথে সাথে কন্যা সন্তানকে আল্লাহর নিয়ামত হিসেবে ঘোষণা করেছেন।

রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সকল ধর্মের মানুষের সম অধিকার নিশ্চিত করেছেন। মুসলিমদের জন্য ইসলামিক আইনে আর পাশাপাশি ইহুদীদের জন্য ইহুদী শরীয়তের আইনে বিচার করা হত মদীনা নামক রাষ্ট্রে, যে রাষ্ট্রের প্রধান ছিলেন স্বয়ং নবী মহাম্মদ (সা)! এমনকি মদিনা সনদে সকল ধর্মের অনুসারীদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করে অনুচ্ছেদ রচনা করেছিলেন।

পিতামাতার প্রতি সন্তানের সদাচার দায়িত্ব, মুরব্বিদের প্রতি সন্মান, প্রতিবেশিদের প্রতি দায়িত্ব, আত্মীয়-স্বজনদের অধিকার, গরীবের অধিকার, এতিমের অধিকার নিশ্চিত করা, ছোটদের প্রতি ভালবাসা এসব নিশ্চিত করেছেন তার জীবন বিধানের মাধ্যমে।

এক কথায় ইসলাম হল একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা যাতে কিনা সকল জীবের সকল ধর্মের সকল জাতের লোকের জন্য কল্যাণ রয়েছে। তাই রসূল (সা.) এই শিক্ষা আমাদের অন্তুরে ধারণ করতে হবে দেহ ও মন দিয়ে। আমাদের উচিত সমাজে শান্তি স্থাপনের জন্য রাষ্ট্রের সু-শৃঙ্খলার জন্য রাষ্ট্র প্রধানদের অনুশাসন মেনে নেয়া, যা রাসূলের শিক্ষা থেকে পেয়ে থাকি।