শিক্ষকের লাশের ওপর রাষ্ট্রের আন্তরিকতা

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ এর ব্লগ
Published : 17 May 2012, 06:11 AM
Updated : 17 May 2012, 06:11 AM

বাংলাদেশের আল বিলাতি মন্ত্রীদের কীর্তিকলাপ দেখে গায়ে ক্রোধের আগুন দাউ দাউ করে। একি আচরণ? টানা কয়েকদিন রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে আন্দোলন করলেন শিক্ষকরা। পুলিশের হাতে মারও খেলেন। গরম পানিতে গা পোড়ালেন। প্রাণও গেল একজনের। অবশেষে মন্ত্রী মহোদয়ের সুমতি হল! ডেকে পাঠালেন শিক্ষকদের। তথাকথিত বৈঠক করবেন। কম কথা! মন্ত্রী বৈঠক করবেন শিক্ষকদের সঙ্গে। তাও আবার বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের সঙ্গে। কত বড় উদারতা! মন্ত্রী কী মহান। কী দয়ালু।

আগে পুলিশ দিয়ে মার খাইয়ে নিয়ে এখন মিথ্যা আশ্বাসের মলম লাগানোর জন্য বুধবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষক ঐক্য পরিষদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে লোক দেখানো বৈঠকে বসলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী আফছারুল আমীন। শিক্ষকদের উপস্থিতিতেই দিলেন কিছু শান্তনার দাওয়াই। বললেন-'বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণের ব্যাপারে সরকারের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছার কমতি নেই।'

সদিচ্ছা! এই হচ্ছে সদিচ্ছার নমুনা? জুতা মেরে গরু দান করলেন 'মন্ত্রী মহোদয়'। আমার শিক্ষকের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে উপহাস করলেন! যখন শিক্ষকরা পুলিশের বুটে নিচে পিষ্ট হয়ে শাহবাগের রাস্তায় পড়ে আর্তনাদ করছিলেন তখন আপনার 'সদিচ্ছা' কোথায় ছিল মাননীয় মন্ত্রী? কোথায় ছিল 'আন্তরিকতা'? নাকি পুলিশের হাতে মার খেয়ে শিক্ষক মারা যাওয়ার পর আন্তরিকতা শব্দটি মনে পড়েছে? আপনি কি কখনও বিদ্যালয়ের বারান্দায় যাননি? শিক্ষকদের কিভাবে সম্মান দেখাতে হয়ে তাও শেখেননি বুঝি? হায়! দুর্ভাগ্য। আপনার নয়। দুর্ভাগ্য আমাদের। আপনার মতো মন্ত্রী দিয়ে চলছে শিক্ষার কাজ। তাও আবার কোমলমতি শিশুর হাতেখড়ির পর্ব। গোড়াতেই গলদ। আফসোস।

পুলিশের মার খেয়ে আহত হয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন জামালপুরের একজন শিক্ষক। কিন্তু শিক্ষকের ওপর প্রশাসনের দুর্ব্যবহার দেখে চরম অপমানবোধ নিয়ে তিনি চিরদিনের জন্য চলে গেছেন না ফেরার দেশে। মাননীয় মন্ত্রী হতে পারতো সেই শিক্ষকটি আপনারই বাল্যকালের শিক্ষাগুরু। কাজী কাদের নেওয়াজের শিক্ষকের মর্যাদা কাব্যটি পড়ার সৌভাগ্য কি আপনার হয়নি? না হলে পড়ে নেবেন। দেখবেন সেখানে দিল্লীর বাদশাহ আলমগীর কিভাবে শিক্ষককে তার যথাযোগ্য মর্যাদার চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছেন। সেই বাদশাহ'র তুলনায় আপনার অবস্থান কোথায় তা নির্ণয়ের ভার আপনার ওপরই ছেড়ে দিলাম।

রাষ্ট্রে কাছে অনুরোধ, দয়া করে শিক্ষকদের সঙ্গে উপহাস করবেন না। শিক্ষকরা এদেশের ক্ষতি চান না। তারা এদেশে জ্বালাও পোড়াও করেন না। তারা লাগাতার হরতাল দিয়ে দেশ অচল করে দেন না? রাজনীতির মঞ্চে দাঁড়িয়ে মিথ্যা পুঁথি পাঠ করেন না। কিন্তু তার পরও কেন তাদের রাস্তায় পড়ে মার খেতে হবে? একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের গায়ে পুলিশ হাত দিলে বিচারের দাবিতে দেশ কেঁপে ওঠে। সংসদ অধিবেশনে হট্টগোল বাঁধে। প্রতিবাদ সভা, মানববন্ধব, সেমিনার, ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুনে ঢাকাকে বিক্ষোভের নগরী করে তোলা হয়। কিন্তু এজন্য সৎ নির্ভীক শিক্ষক লাঞ্চিত হলে কেউ কথা বলে না? চুপ করে থাকে? যে দেশের বিরোধী দলের কয়েকজন নেতাকে কারাগারে পাঠানোর কারণে হরতাল ডাকা হয়েছে। কিন্তু একদিন আগে শিক্ষকদের নির্যাতন করার জন্য কোন কর্মসূচিই নেই? কোন আন্দোলন নেই? ভাবখানা এমন শিক্ষকরা এ সমাজের গুরুত্বপূর্ণ কেউ নন। সরকার কিংবা বিরোধীদল কারোই কিছু বলার নেই? এখন আর মহামান্য আদালতকে স্বপ্রণোদিত হয়ে কোন রুল জারি করতে শোনা যাবে না। জানতে চাওয়া হবে না-কেন ন্যায অধিকার চাইতে এসে প্রাণ দিতে হল মহামতি শিক্ষককে?

ধিক্ রাষ্ট্রযন্ত্রকে। ধি্ক এসব কচ্ছপগতির মন্ত্রীদের। সামান্য দাবি আদায়ে যে দেশে শিক্ষকদের মার খেতে হয় সে দেশে এসব অপদার্থ মন্ত্রী দিয়ে কোন কাজ নেই। শিক্ষকরা রাজপথে দিনের পর দিন শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে নিজেদের ন্যায় পাওনা চাইছেন আর মন্ত্রী মহোদয় রাজ্যের কাজে এতোই ব্যস্ত যে এদিকে তাকানোর সময় তার হয়ে উঠলো না। সময় হল পুলিশের হাতে মার খেয়ে শিক্ষকের প্রাণ যাওয়ার পর।

রাষ্ট্রের কাছে জাতির প্রশ্ন, কেন শিক্ষকদের দাবি দাওয়া জানতে আগেই বৈঠক করা হল না? কেন তাদের ওপর নির্যাতন চালালো পুলিশ? কার হুকুমে হয়েছে এসব? জাতীয়করণের দাবিতে শিক্ষকদের রাজপথে নামতে হলো কেন? প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পদ দখল করে থাকা মন্ত্রীর কাজ কী? বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের জাতীয়করণের প্রতিশ্রুতি দেয়ার পরও কেন তা বাস্তবায়নে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে? জানি এসব প্রশ্নের জবাব দেয়ার সময় রাষ্ট্র পরিচালকদের নেই। সময় হবে। একদিন জবাব দেয়ার সময় ঠিকই হবে। কিন্তু সেদিন জবাব শোনার মতো কেউ থাকবে না।

জনাব আফছারুল আমীন, অনেক কষ্ট ভারাক্রান্ত ব্যথিত হৃদয় নিয়ে কথাগুলো লিখেছি। যদি সুযোগ থাকতো কথাগুলো আপনাকে সরাসরি বলতাম। কিন্তু তা সম্ভব নয়। আপনার মতো মন্ত্রীর দর্শন পেতে যেখানে আমার গুরুজিকে পথে পথে মার খেতে হয়েছে; সেখানে আমার মতো অতিসাধারণ ছাত্রকে আপনার সাক্ষাত পেতে হয়ত জীবনটাই বলি দিতে হবে। কিন্তু আমার শিক্ষা জীবনের নায়কদের গায়ে হাত তোলা কঠিন বেয়াদবের শাস্তি না দেখে আমি মরতে চাই না।