ইরানি চলচ্চিত্র ‘দি কাউ’ সামাজিক সম্প্রীতির এক অনন্য দলিল

মিন্টু শাহজাদা
Published : 29 May 2017, 06:36 PM
Updated : 29 May 2017, 06:36 PM

'দি কাউ' দারিয়ুস মেহরজুই এর পরিচালনায় ১৯৬৯ সালের ইরানি ছবি। এটি ইরানের একটি ক্লাসিক চলচ্চিত্র এবং বহুবিধ কারণে বিখ্যাত। গোলাম হোসেন সাঈদীর উপন্যাস ও চিত্রনাট্যে ছবিটির নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন ইজ্জাতোলাহ এনতেজামি।বলা হয়ে থাকে যে, ১৯৬৪ সালে ইরানি সিনেমা শিল্পের যে নববিপ্লবের সূত্রপাত ঘটেছিল 'দি কাউ' তার প্রথম দিকের প্রতিনিধি।

১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লব ঘটার পর কঠোর সেন্সরশিপের কারণে ইরানি সিনেমা শিল্প যখন সংকুচিত হয়ে পড়ার আশংকায় জর্জরিত ঠিক সে সময় 'দি কাউ' রাষ্ট্রীয় চিন্তক ও নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টিগোচর হয়। সকল সন্দেহকে পরাভূত করে সিনেমা শিল্প বিকাশের এক নতুন পথ উন্মোচন করে 'দি কাউ।' আজকের বিশ্বে ইরানি চলচ্চিত্রের সুমহান অবস্থানের পাটাতন নির্মাণে 'দি কাউ' এর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

নির্মাণে বাহুল্যবিবর্জিত 'কি কাউ (গাভ)' ছবির কাহিনী আবর্তিত হয়েছে গ্রামীন মধ্য বয়সী হাসান ও তার পালিত গরুকে কেন্দ্র করে। হাসান বিবাহিত এবং নিঃসন্তান। তার একমাত্র যক্ষের ধন গরুটি তার প্রাণাধিক প্রিয়। গাভীন গরুটিকে সে নিজ হাতে খড়কুটো খাওয়ায়। গোসল করায়। এমনকি গরুর সাথেই নানারকম আমোদ-আহ্লাদে মেতে থাকে। গ্রামে গরু চোরের (Bolouris) উৎপাত রয়েছে। চোরে গরু চুরি করে নিয়ে যেতে পারে এই ভয়ে সে গরুর সাথে গোয়াল ঘরে রাতও কাটায়। অতন্দ্র প্রহরীর মত রাতে খট করে আওয়াজ হলেও সে ঘুম ভেঙে চোখ খুলে চারপাশটা অবলোকন করে। একবার বিশেষ কারণে এক দিনের জন্য গ্রামের বাইরে যায় হাসান। এই সময়ে তার প্রিয় গরুটি কি এক অজানা কারনে মারা যায়। হাসানের স্ত্রীর গগনবিদারী কান্নায় পাড়ার লোকেরা ছুটে আসে এবং আতঙ্কিত হয়ে ওঠে এই ভেবে যে, হাসান কি করে এত বড় শোক সামলে নেবে। গরুটির মৃত্যু সংবাদ তাকে কি করে দেবে এবং দিলে তার প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে অথবা সে এই শোক সহ্য করতে পারবে কি না এ নিয়ে গ্রামবাসীর দুশ্চিন্তার শেষ নেই। এই নিয়ে গ্রাম প্রধানসহ পাড়ার মানুষের মধ্যে আলোচনা হয়। অনেক আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয় যে, হাসান আসলে বলা হবে, গরুটি হারিয়ে গেছে এবং খোঁজার জন্য লোক লাগানো হয়েছে। সবাই মিলে বাড়ির উঠোনে গর্ত করে মৃত গাভীন গরুটিকে তারা পুঁতে দেয়। পরের দিন হাসান আসে। পাড়ার লোকেরা খুব চিন্তিত হয়ে পড়ে। অবশেষে হাসান যখন জানতে পারে যে গরুটি নেই তখন সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। হাসান বিশ্বাস করতে শুরু করে হারিয়ে যাওয়া গরুটি সে নিজে। নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে গোয়াল ঘরেই দিন কাটে তার। গরুর মতই খড়কুটো খেতে শুরু করে। পাড়ার ধর্মীয় বিশ্বাস মোতাবেক হাসানের চিকিৎসা করানো হয়, কিন্তু  কিছু না হওয়ায় গ্রাম প্রধানসহ সিদ্ধান্ত হয় হাসানকে চিকিৎসার জন্য শহরের হাসপাতালে নিতে হবে। হাসপাতালে নেবার জন্য নানাভাবে তাকে বোঝানো হয়। কোনভাবেই রাজি না হওয়ায় গরুর মত বেঁধে টেনে হিঁচড়ে হাসানকে হাসপাতালের পথে নিতে থাকে গ্রামবাসী। টেনে হিঁচড়ে নেওয়ার সময় যখন কুলিয়ে উঠতে পারে না তখন নিজের অজান্তেই গরু খেদানোর মত করে আঘাত করতে থাকে হাসানকে। হঠাৎ তারা সম্বিত ফিরে পায় এবং ভীষন অসহায় বোধ করে। হাসানের জন্য মায়া হয়। গ্রামবাসী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। হঠাৎ হাসান গরু ছোটার মত হাত থেকে ছুটে যায় এবং পাহাড়ের ওপর থেকে পড়ে মারা যায়।

মোটামুটি এই হল দারিয়ুস মেহরজুই এর 'দি কাউ' সিনেমার কাহিনি। সিনেমাটির কাহিনিতে হাসান ও তার গরু মূল উপজিব্য হলেও মুলত উঠে এসেছে সমকালীন সমাজ এবং সামাজিক জীবনাচার। সমাজে বিদ্যমান ধর্মীয় বিশ্বাস, রীতিনীতি, অভ্যাস ও আচার-আচরণের এক অপূর্ব জীবনালেখ্য 'দি কাউ।' সমস্ত সিনেমা জুড়ে একটি ছোট্ট গ্রাম ও গ্রামের মানুষের পরস্পরের প্রতি সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি সবকিছুকে ছাপিয়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে। গ্রামের একমাত্র শত্রু চোর (Bolouris)এর উপদ্রব ঠেকানোর জন্য গ্রামের মানুষের সংঘবদ্ধভাবে প্রতিহত করার দৃশ্যগুলি চিরায়ত গ্রামীন ঐক্য ও অকৃত্রিম সম্প্রীতির এক চমৎকার সত্য হিসেবে প্রতিভাত হয়। হাসানের অবর্তমানে তার গরুর করুণ মৃত্যু এবং গ্রামের নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকল মানুষের হাসানকে নিয়ে উদ্বিগ্নতায় গ্রামীন সমাজের পারস্পরিক মমত্ববোধের চিরাচরিত রূপ দৃশ্যমান হয়। এ যেন গ্রাম নয়, সমস্ত গ্রাম মিলেই একটি পরিবার।

ছবিটি নির্মাণে কোন বাহুল্য নেই। সহজ সরল সাদামাটাভাবেই গল্পটি উপস্থাপন করা হয়েছে। সমস্ত চরিত্রই রিয়্যালিস্টিক। চিত্রনাট্যকার এখানে পরাবাস্তবতার অনুষঙ্গ প্রবেশ করালেও গল্প ছাপিয়ে সময় ও পারিপার্শ্বিকতাই প্রধান হয়ে উঠেছে। আজকের আধুনিক চলচ্চিত্রের সাথে তুলনামুলক শিল্প বিচারে এটি অনেকের কাছে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে হতে পারে। তবে এটাও বিবেচনায় নিতে হবে যে এটি ষাটের দশকের চলচ্চিত্র।প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার সম্ভব ছিল না তখন। গল্প বলার এমন সরল পদ্ধতি খুব কম চলচ্চিত্রেই দেখা যায়। ছবিটির বিষয় হয়ত অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয় তবে সমকালীন সমাজের যে বাস্তব চিত্রটি মহাসমারোহে উদ্ভাসিত হয় তা অধিক গুরুত্বপূর্ণ।সেই দিক বিবেচনা করেই একে মূল্যায়ন করতে হবে।

চলচ্চিত্র সমাজ বদলের অন্যতম হাতিয়ার। মানুষের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ এবং সম্প্রীতি রক্ষা ও নতুন করে তৈরিতে চলচ্চিত্র শক্তিশালী প্রভাব বিস্তার করতে পারে।আজকের বিশ্বে মূল্যবোধের অবক্ষয়, অস্তিত্বের সংকট, পারিবারিক ও ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা দূরিভূত করার জন্য ভাল চলচ্চিত্র নির্মাণ যেমন আবশ্যক তেমনি সংকট সৃষ্টি করে এমন নাটক কিংবা চলচ্চিত্র নির্মাণ থেকে বিরত থাকাও জরুরি। ভাল গল্প নির্বাচন, প্রশিক্ষিত অভিনয়শিল্পী, অভিজ্ঞ নির্মাতা, কলাকুশলী এবং এর সাথে নির্মাণে যত্ন ও ভালবাসা থাকলে আমাদের বাংলা চলচ্চিত্রশিল্পও একদিন বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে- দাঁড়াবেই দাঁড়াবে।

লেখকঃ গায়ক, কবি ও গদ্যকার